প্রতিনিধি এবং প্রশাসকদের নিয়োগ করার প্রাক্কালে উমার রা. একটি দলিল লেখাতেন। কয়েকজন আনসারকে সেই দলিলের সাক্ষী রাখা হতো। তাতে শর্ত আরোপ করা হতো যে, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধি কোনো অনারবীয় ঘোড়ায় চড়তে পারবেন না, মিহি আটার রুটি খাবেন না, চিকন সুতার কাপড় পরবেন না এবং বিপদগ্রস্ত মুসলিমদের প্রয়োজনের সময় তাদেরকে বিমুখ করতে পারবেন না। তারপর তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন।’
এই শর্তগুলোর ফলে প্রশাসকরা একটি সাধারণ, সংযমী জীবনযাপন করতে এবং জনগণের প্রতি নম্র আচরণ করতে বাধ্য থাকতেন। উম্মাহর চরিত্র সংশোধনের প্রথম ধাপ হলো মধ্যম মানের সাধারণ জীবনযাত্রা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং যানবাহন ব্যবহারে তাদেরকে অভ্যস্ত করানো।
*
খালিফাহ হওয়ার পর একদিন উমার রা. মনে মনে ভাবছিলেন, আমি তো এখন খালিফাহ। আমার চেয়ে ভালো আর কে আছে! নিজের দম্ভিত মনকে শাসন করতে অতীতের কথা মনে করিয়ে দিলেন। মিম্বারে উঠে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আজ সেসব দিনের কথা মনে পড়ছে। আমি তখন আমার খালার গবাদি পশু চরাতাম। তিনি ছিলেন বানু মাখযূম গোত্রের। আমাকে তিনি মুঠো ভর্তি খেজুর কিশমিশ দিতেন। সারা বেলার জন্য ওগুলোই যথেষ্ট ছিল। কি নিদারুণ যাতনাময় দিন ছিল সেগুলো!’ বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মনের অজান্তে।
মিম্বার ছেড়ে দাঁড়াতেই আবদুর-রাহমান ইবন আওফ তাকে থামালেন, ‘এ কী করলেন আমিরুল-মুমিনিন? আপনি তো নিজেই নিজের মান খোয়ালেন!’
‘একা একা বসে ভাবছিলাম আমি তো খালিফাহ। আমার চেয়ে ভালো আর কে আছে? তাই নিজেকে মনে করিয়ে দিলাম একসময় কী ছিলাম আমি!’
অন্য একটি বর্ণনামতে তিনি বলেছিলেন, ‘নিজের মধ্যে কিছু [অহমিকা] চোখে পড়ল। তাই চাইলাম নিজেকে একটু নামিয়ে আনতে।’
*
তার অন্তরের আল্লাহভীরুতা, বুদ্ধির প্রখরতা, দৃষ্টির দূরদর্শিতা, ব্যক্তিত্বের মূর্ছনা এবং নেতৃত্বের মুনশিয়ানার কাছে এই উম্মাহ চিরকাল ঋণী।
সত্যিই আবু বাক্রের পর উমারই ছিলেন উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তান। এই উম্মাহ ও ফিতনার মাঝে তিনি ছিলেন এক অভেদ্য দেয়াল, এক বন্ধ দরজা। আততায়ীর হাতে তার শহিদ হওয়ার মধ্য দিয়ে যেদিন সেই দরজা ভেঙে গিয়েছে; আর তা বন্ধ করা যায়নি—যাবেও না হয়তো আর কোনোদিন।
*
ইসলামের ইতিহাসে উমার ইবনুল-খাত্তাব যেন রোমাঞ্চের প্রতিশব্দ। ঠিক যেদিন তরবারি হাতে হত্যা করতে নেমেছিলেন নবীজিকে, সেদিনই ইসলাম বরণ করেন এই লৌহমানব। ঘোরতর শত্রু থেকে এক লহমায় হয়ে ওঠেন ইসলামের অন্যতম শক্তি।
নবীজির হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল যে মুসলিম-রাষ্ট্র, আবু বাকরের হাতে যে-রাষ্ট্র পার করেছে কৈশোর, উমারের সময়ে সেই ইসলামি রাষ্ট্র যেন ১৮ বছরের টগবগে তরুণ। ব্যক্তিত্বের মূর্ছনা আর নেতৃত্বের মুনশিয়ানায় দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রের সীমানা। তার হাতেই প্রতিষ্ঠা পায় রাষ্ট্রীয় নানা অবকাঠামো। বর্তমান সময়ে উম্মাহর এই টালমাটাল অবস্থায় একে সঠিক আইলের উপর রাখতে প্রয়োজন এমনই এক শক্ত ব্যক্তিত্ব। হয়তো তার এই জীবনীর আলোয় বেরিয়ে আসবে তেমনই এক ভবিষ্যৎ নেতা! ইনশাআল্লাহ।
nayeem_sharder –
মক্কার ভূমি যখন দাওয়াতের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত। ঠিক সেই মূহুর্তেই উমর নামে এই মরু সিংহের ইসলামে পদার্পণ। ইসলামের ৪০ তম মুসলমান হযরত উমর রা.। সাহাবিরা তার সঙ্গ পেয়ে যেন, উষ্ণ হৃদয়ের মাঝে শীতল হাওয়ার খোজ পেলো।
উমর রা. সাফ সাফ জানিয়ে দিলো, গোপনীয়তা নয় প্রকাশ্যে পালন হবে আমার দ্বীন। হামজা রা. ও উমর রা. দুই কাতারে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো ইসলামের প্রথম মিছিলে। সাথে ছিলো হযরত মোহাম্মদ স. নিজেও। মসজিদুল হারামের সামনে এমন দাপটে মিছিলে কাফেররা বিস্মিত। বিশ্বনবি স. এই বীরত্বের সাক্ষী হয়ে তাকে ফারুক উপাধীতে আরো সম্মানিত করলেন।
তিনি ইসলামের ২য় খলিফা। বিনয়, নম্রতা, ধৈর্য ও সহনশীলতায় ভর করে ১০ বছরের একটি বৃহৎ শাসনামল। সমাজিক জীবন ও সংস্কারে রেখেছে অসাধারণ অবদান। খেলাফতের ঘোষণার শুরুতে আবু বকর রা: এর কাছে উমর রা. এর কঠোরতা নিয়ে সাহাবিদের ছিলো নানা প্রশ্ন। আবু বকর তার উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টাদের বলেছিলেন : “আমার কোমলতার জন্য তার (উমর) কঠোরতা ছিল। যখন খিলাফতের ভার তার কাঁধে আসবে তখন সে আর কঠোর থাকবে না। যদি আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে কাকে আমি আমার উত্তরসূরি নিয়োগ দিয়েছি, তবে আমি তাকে বলব যে আপনার লোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছি”।
উমর রা: তার শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রীক ব্যবস্থায় পরিচালিত করেন। পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হত। কিছু ক্ষেত্রে উমর পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন-
১) উমর সর্বপ্রথম পাবলিক মিনিস্ট্রি প্রথা চালু করেন যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের রেকর্ড লিপিবদ্ধ করা থাকত। গভর্নর ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপিও রেকর্ড হিসেবে রক্ষিত থাকত।
২) আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনি প্রথম পুলিশ বাহিনী নিয়োগ দেন।
৩) জনতা বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে তিনি প্রথম তাদের শৃঙ্খলায় আনেন।
তিনি জ্ঞানীদের বিশেষ ভাবে কদর করতেন। ইলম অর্জনে শিক্ষার্থীদের দিতেন উৎসাহ। তিনি মক্কা, মদিনা, বসরা, কুফা, সিরিয়ার ইত্যাদি পাঠশালা গুলো উন্নত করেন। উমর রা. বলেন, “তুমি নেতা হওয়ার পূর্বে ইলম অর্জন কর”।
আমি মনে করি, বর্তমান মুসলিম উম্মাহের নেতৃত্বের শুরুতে উমর র. জীবন পড়া আবশ্যক। কেননা, তার খেলাফতের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার উদাহরণ। এই বইটি আপনাকে তার জীবনের বিশুদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরবে। একজন পাঠক হিসেবে এতে শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি। আক্ষেপের বিষয় ২য় খন্ড এখনো এলো না😥।