চিন্তালাপ

পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতা ও এর প্রতিকার—সারা বিনতে আনোয়ার

বর্তমানে আমাদের যুবসমাজের অবক্ষয়ের পেছনে যতগুলো কারণ দায়ি, তন্মধ্যে অন্যতম পর্নোগ্রাফি।

এক কথায় যাকে বলা যায় চরিত্র ধ্বংসের মোক্ষম হাতিয়ার।

যার বৃদ্ধি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। আর নীরব ঘাতকের মতো আমাদের তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের অতল গহ্বরে।

পর্নোগ্রাফি: সংক্ষেপে পর্ন বা পর্নো অনানুষ্ঠানিক ব্যবহার। ইংরেজি Pornography.

যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সেই সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন বা বিস্তারিত আলোচনা।

পর্নোগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে উপস্থাপন করা হতে পারে, এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বই, সাময়িকি, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, পেইন্টিং, অ্যানিমেশন, সাউন্ড রেকর্ডিং, ভিডিও এবং ভিডিও গেইম। যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, ভিডিওচিত্র, অডিও ভিজুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, অঙ্কিত চিত্রাবলি বা অন্য কোনো ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য বিষয়—যার কোনো শৈল্পিক মূল্য নেই—তা পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হবে।

অধিকন্তু যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, পত্র-পত্রিকা, মূর্তি, কার্টুন বা প্রচারপত্র পর্নোগ্রাফি হিসেবে বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা একটি জরিপে দেখা গেছে স্কুল পড়ুয়াদের ৮০–৮৫ ভাগই পর্নোগ্রাফি দেখে। এই জরিপটি করা হয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ওপর।

আর তাতে দেখা যায়—পর্নোগ্রাফি তারা ছবি, ভিডিও এবং টেক্সট আকারে ব্যবহার করে। এসব পর্নোগ্রাফির আবার বড় অংশই দেশে তৈরি।

এই শিক্ষার্থীরা প্রধানত মোবাইল ফোনে, অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখে। এর বাইরে ট্যাব, ল্যাপটপেও দেখে।

আবার পেনড্রাইভ ব্যবহার করে তা বিনিময়ও করে।

অন্য একটি জরিপের ফলোআপে দেখা যায়, ৩০–৩৫ বছর যাদের বয়স, তাদের শত ভাগই একবার হলেও পর্নোগ্রাফি দেখেছেন। নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখে ৯০ ভাগ। এভাবে বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে পর্নোগ্রাফির প্রবনতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে বাংলাদেশের কোনো আইন নেই ব্যাপারটা এমন নয়, আইন ঠিকই আছে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আইন থাকা সত্ত্বেও এই প্রবণতা দিনদিন হ্রাস পাওয়ার বদলে ভয়ানক গতিতে আরও বাড়ছে।

যদিও বিটিআরসি ৫৬০টি পর্নোসাইট বন্ধ করেছে; কিন্তু পর্নোগ্রাফির জগৎ তো আর এই ৫৬০টি সাইটে আবদ্ধ নেই, তার আছে এক বিশাল ফিল্ড। আর এর ব্যবহারকারীদের ভালো করেই জানা আছে—কীভাবে ওই বন্ধ সাইটে প্রবেশ করতে হয়।

পর্নোগ্রাফি বৃদ্ধির কারণসমূহ:

আমাদের দেশে পর্নোগ্রাফি বৃদ্ধি পাওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো:

১. ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা।

২. অল্প বয়সেই বাচ্চাদের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি ধরিয়ে দেওয়া।

৩. অনলাইনে পর্নোসাইটাগুলোর অবাধ বিচরণ।

৪. রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব সাইটগুলোর ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি না করা।

৫. যেহেতু পর্নোগ্রাফি একটি বেআইনি ব্যবসা, সেহেতু এর সীমাবদ্ধতা ছাড়ালে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করা।

৫. পরিবারের সদস্যদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা না দেওয়া।

৬. অসৎ চরিত্রের বন্ধু ও মানুষের সঙ্গ দেওয়া।

৭. পর্নোসাইটগুলোতে সিকিউরিটি ব্যবস্থা শিথিল করা।

৮. পরিবারের ছোট সদস্যদের প্রতি পর্যাপ্ত পরিমাণে যত্নশীল না হওয়া ও খেয়াল না রাখা।

৯. টিভি চ্যানেলগুলোতে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বিনোদন।

১০. অপসংস্কৃতি অনুসরণ।

পর্নোগ্রাফির নেতিবাচক প্রভাব:

১. অতিরিক্ত পর্নের নেশা ড্রাগের মতোই মারাত্মক। সেটা ড্রাগ, মদ বা সিগারেটের মতোই আসক্তি তৈরি করে। পর্ন দেখলে মস্তিষ্কে একটা ‘ফিল গুড’ রাসায়নিক তৈরি হয়। এর নাম ডোপামিন। একটানা পর্ন দেখলে মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন সামান্য ডোপামিন ক্ষরণে উত্তেজনা তৈরি হয় না। আরও বেশি ডোপামিনের জন্য মস্তিষ্ক আরও বেশি পর্নের রসদ খোঁজে এবং আসক্তি বাড়িয়ে তোলে।

২. অতিরিক্ত পর্নের আসক্তি সম্পর্কের ক্ষতি করে। যত বেশি পর্ন দেখবেন, ততোই আপনি একটা অলীক ফ্যান্টাসি জগতে চলে যাবেন। এর ফলে বাস্তবের সম্পর্কগুলো আর আপনাকে সুখ দিতে পারবে না। যা সম্পর্কের অবনতির প্রধান কারণ।

৩. অতিরিক্ত পর্ন মানসিক রোগের জন্ম দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পর্ন দেখা হয় একা, সমাজের চোখ এড়িয়ে। যার ফলে ধীরে ধীরে একটা অপরাধবোধ জন্ম নেয়। যা থেকে ভবিষ্যতে মানসিক রোগ হতে পারে।

৪. পর্ন দেখলে লোকজনের ইরেক্টাইল ডিসফাংশান হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। অতিরিক্ত পর্ন রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট করে এই রোগের সৃষ্টি করে।

৫. পর্ন মানুষকে বদমেজাজি ও খিটখিটে করে তোলে। দেখা গেছে একেবারে সাদামাটা পর্নও অতিরিক্ত দেখলে তা দর্শকের মানসিকতায় প্রভাব ফেলে।

পর্নোগ্রাফি(অশ্লীলতা)ব্যাপারে ইসলামি কি বলে:

আল্লাহ তাআলা অশ্লীলতা সম্পর্কে কুরআনে বলেন, আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন। যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য……. [সূরা আল-আরাফ, ৭:৩৩]

যারা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি; আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। [সূরা নূর, ২৪:১৯]

আর তোমরা যিনার কাছে যেও না, নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ। [সূরা আল-ইসরা,  ১৭:৩২]

হে মুমিনগণ, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।

আর যে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তখন সে (শয়তান) নির্লজ্জতার ও মন্দ কাজের আদেশ করবে।

[সূরা নূর, ২৪:২১]

মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্রতা। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। [সূরা নূর, ২৪:৩০–৩১]

নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। [আল-ইসরা ১৭:৩৬]

প্রতিকারের উপায়:

ইসলামে আছে অশ্লীলতাসহ সব ধরনের পাপাচারের পার্মানেন্ট সলিউশন।

আল্লাহ বলেন—হে ইমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো।

তার নৈকট্য অর্জনের জন্য রাস্তা তালাশ করো, এবং তার রাস্তায় জিহাদ করো। যাতে এসবকিছুর ফলে তোমাদের সফলতা অর্জিত হয় দুনিয়াতেও, আখিরাতেও।

[মায়িদা, ৫:৩৫]

১. তাকওয়া (আল্লাহর ভয়) এক অতন্দ্র প্রহরী। একান্ত নির্জনতায় এবং নিশুতিরাতের অন্ধকারেও যে জিনিস মানুষের অন্তরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করে, তা হলো আল্লাহ তাআলার ভয়।

২. পরনারী থেকে দৃষ্টি নিচু করতে হবে।

৩. হারাম রিলেশন থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

৪. যেসব জিনিস পর্ন দেখার উৎসাহ জোগায়, সেসব থেকে দূরে থাকতে হবে। যেমন: গানবাজনা, মুভি ও বাজে বন্ধু।

৫. চিন্তা: (যে আজ আমি পর্ন দেখব)। ডিভাইস: (মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি)

জায়গা: (ঘর বা কোনো কক্ষ) এই তিনটি জিনিসের যেকোনো একটি বাদ দিন, দেখবেন পর্ন আর দেখা হবে না।

৬. মসজিদে নিয়মিত সালাত আদায় করুন।

৭. মাঝে মাঝে সাওম রাখার অভ্যাস করুন। ইনশাআল্লাহ এর দ্বারা আপনারা পর্ন আসক্তি দূর হয়ে যাবে।

৮. কিছু সময় জিকির করুন। আর খুব দুআ করুন। বেশি বেশি তাওবা করুন।

৯. অবসর সময়ে বই পড়ুন, বা শখের কোনো কাজ করুন।

১০. নিজের ক্রিয়েটিভিটিকে কাজে লাগান। তাতে বাজে চিন্তা থেকে দূরে থাকবেন।

১১. ঘরে বা কক্ষে একা থাকবেন না। আলো বাতাসযুক্ত স্থানে থাকুন।

১৩. মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে নিষিদ্ধ সাইটগুলো ব্লক করুন।

এত কিছুর পরও যদি আসক্তি ফিরে আসে, তাহলে নিজেকে শাস্তি দিন। যেমন: আমি আজ পর্ন দেখলে ১০০০ টাকা দান করব বা ১০ রাকাত নফল সালাত আদায় করব।

ওপরের এসব নিয়মগুলো মেনে চললে ইনশাআল্লাহ এসব থেকে মুক্তি মিলবে।

অভিভাবকদের জন্য কিছু পরামর্শ:

আপনি যদি এখনো সচেতন না হোন বা আপনার পরিবারের সদস্যদের সতর্ক না করেন, তাহলে আপনার অনেক প্রিয়জনও এই ভয়ানক আসক্তিতে পড়ে যেতে পারে। যার ভবিষ্যত নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই এর বিরুদ্ধে এখনই কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

১. পরিবারের সদস্যদের প্রতি যত্নবান হোন।

২. কোনো সদস্য একাকিত্ব বা হতাশায় ভোগে কিনা সে ব্যাপারে লক্ষ রাখুন।

৩. পরিবারে দ্বীনি পরিবেশ কায়েম করুন।

সর্বোপরি আমাদের পরিবার, সমাজ তথা দেশের প্রতিটি মানুষকেই সচেতন হতে হবে।

এবং প্রত্যেকেরই সৎ ইচ্ছা থাকতে হবে আমি পারব এই অন্ধকার জগৎ থেকে নিজেকে মুক্ত কর‍তে, আমাকে পারতেই হবে।

দেখবেন আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আপনাকে সঠিক পথ দেখাবেন ইনশাআল্লাহ।

পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে পড়ুন :

মুক্ত বাতাসের খোঁজে

 

© সারা বিনতে আনোয়ার
সিয়ান বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Back to list

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *