চিন্তালাপ

কোভিড ১৯ : পরিবেশের ভবিষ্যৎ ও আমাদের করণীয়—ফাহাদ হোসেন ফাহিম

একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী জুড়ে যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের ম্যারাথন রেসে আমাদের উপচে পরা ব্যস্ততার হিড়িক, ঠিক তখনই কোভিড-১৯-এর স্পর্শের ধূসরতা মানুষকে আত্মজিজ্ঞাসায় বাধ্য করেছে প্রবলভাবে। জনজীবনে নেমেছে বিপর্যস্ততার শামিয়ানা। ২০১৯ সালের শেষদিকে ছড়িয়ে পড়া কোভিড–১৯ মহামারিকে ‘কালো রাজহাঁস ঘটনার’ সমতুল্য হিসেবে কল্পনা করা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে বাইরে খোলা জায়গায় কালো রাজহাঁস দেখতে পাওয়া খুবই বিরল ঘটনা। তেমনিভাবে বিগত কুড়ি বছরে আমরা ৬টি মহা হুমকির সম্মুখীন হয়েছি—সার্স, মার্স, ইবোলা, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, সোয়াইন ফ্লু ও করোনা ভাইরাস। আমরা পাঁচটি বড় ধরনের হুমকি থেকে বাঁচতে পারলেও ছয় নম্বর বিভীষিকার কালো হাত থেকে বাঁচতে পারিনি। করোনাও কালো রাজহাঁসের মতো বিরল এক ভাইরাস—যা মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। বদলে গেছে পৃথিবীর পরিবেশ; সর্বংসহা পরিবেশ একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাসে প্রাণবন্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।


বেলজিয়ামের রয়েল অব অবজারভেটরির বিজ্ঞানীদের মতে, লকডাউনের ফলে পৃথিবীর ওপর চাপ কমে গেছে অনেক বেশি। পৃথিবী কাপছে কম। দূষণহীন পৃথিবীর আকাশ হয়েছে আগের চেয়েও দশ শতাংশ বেশি অন্ধকার। ফলে তারার উজ্জ্বল্য বেড়েছে চল্লিশ শতাংশ। আগের দূষিত আকাশ থেকে যেখানে ভেনাস দেখা যেত না, এখন সেখান থেকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভেনাস। কোপারনিকাস অ্যাটমসফিয়ার মনিটরিং সার্ভিস এবং কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস-এর তথ্য মতে, বরফে আচ্ছাদিত উত্তর মেরুর আকাশে ওজন স্তরের ১০ লাখ বর্গ কিলোমিটারের যে বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি নিজ থেকেই সেরে উঠেছে। কারন হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীর শিল্পায়নের চাকা স্থবির হয়ে পড়ায় পৃথিবীর পরিবেশ প্রকৃতি যে বিশ্রামের সুযোগ পেলো, তারই ফলে এই ওজন স্তরের গর্ত ভরাট হয়েছে।


২০০২ সালে প্রথম বাংলাদেশে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিল ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি। এরপর ২০১১ সালে বঙ্গোপসাগরে একবার এবং ২০১৮ সালে সুন্দরবনের পশ্চিম অংশে আরেকবার গোলাপি ডলফিনের দেখা পাওয়া গিয়েছিল। এবার ২৩ মার্চ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টের কাছে আবারও দেখা মিলেছে সেই গোলাপি ডলফিনের। আজকে হয়তো মৌন ধরণীর বুকে জেগেছে প্রতিশোধের বিষাণ। কিছুদিন পূর্বেও মানব সৃষ্ট করুণ দাবানলের দাবদাহে বন পুড়েছে এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকাসহ সর্বত্র; পুড়েছে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনও। বিধস্ত হয়েছে বন্য প্রাণির বাসস্থান, উজাড় হয়েছে পাখিদের বিচরণ স্থল। কোনো প্রাণী বাঁচল না মরল, প্রাইমেট বর্গের মানুষের দৃষ্টি নেই সেখানে! আজ প্রাইমেট বর্গের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জীবনে নেমে এসেছে কালো ছায়া। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পরিবর্তন ঘটছে পরিবেশে। গর্জে উঠেছে প্রকৃতি। মানব সমাজের ইটের পরে ইট, মধ্যে মানুষ কীট নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করে ছিনিয়ে নিয়েছে নিজের সবুজ। সবুজ পৃথিবী আজকে হাসছে সন্দংশিকায়। মানুষ আজ ধরাশায়ী ক্ষুদ্র এক অনুজীবের করোনা ভাইরাস কাছে। চীনের উহান থেকে যার উৎপত্তি এবং ব্যাপিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীব্যাপী। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে সারাবিশ্বের অর্থনীতিকে। কেড়ে নিচ্ছে অমিত প্রাণ। কোভিড ১৯ কি পারবে আমাদের জাগাতে? আমরা পরিবেশ বিনষ্টের যে নিগড় তৈরি করেছি, তা থেকে মুক্ত হয়ে সবুজে ফিরে যেতে সমর্থ হব কি? নাকি রয়ে যাব যেই, সেই!


পৃথিবী আমাদের, পরিবেশ আমাদের। তাই পরিবেশকে দূষণমুক্ত রেখে সুন্দর ভবিষ্যত রচনা করার দায়িত্বও আমাদেরকেই নিতে হবে। সুন্দর ও নির্মল পরিবেশ যেমন মানুষের জীবনে বয়ে আনে শান্তির অদুরন্ত ঝরণাধারা, তেমনি খারাপ ও দূষিত পরিবেশ মানুষের জীবনে নিয়ে আসে অশান্তির নরক জ্বালা। যান্ত্রিক সভ্যতার বয়ে আনা কলুষিত পরিবেশের নির্মম প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে পৃথিবী জুড়ে। রবীন্দ্রনাথ একেই বলেছিলেন সভ্যতার সংকট। আর সেই সংকট মোকাবিলায় আমাদের পদক্ষেপ হোক:


1. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রতিরোধের জন্য সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালানো এবং বাড়তি জনগণের জীবন ধারণের জন্য মৃত্তিকা ও গাছের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা।


2. নির্বিচারে বৃক্ষনিধন নিয়ন্ত্রণ করা এবং বৃক্ষরোপন অভিযানকে অধিকতর জোরদার করা।


3. শিল্প কারখানার বর্জ্য পদার্থসমূহ পানিতে না ফেলে পরিশোধিত করার ব্যবস্থা করা এবং বিদেশ থেকে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য আমদানি বন্ধ করা।


4. বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কলকারখানার দহন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করা এবং আবাসিক এলাকার বাইরে পরিকল্পিতভাবে শিল্প কারখানা স্থাপন করা।


5. শব্দদূষণ প্রতিরোধের জন্য পুরনো গাড়ি আমদানি বন্ধ করতে হবে। মাইক, লাউড স্পিকারের শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা এবং ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।


6. তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং আনবিক বোমার পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।


7. কীটনাশক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে এবং ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদেরকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তুলতে হবে।


8. অধঃমুখী পানির স্তর নিয়ন্ত্রণের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে পানি খরচ ও ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।


9. পরিবেশ দূষণকারী ‘ডার্টি ডজন’ ও প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে তার ব্যবহারও। আনতে হবে তার বিকল্প, বাড়াতে হবে হবে গ্রীন কেমিস্টির ব্যবহার।


10. বাস্তুতন্ত্রের জীবজ পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।


11. টু স্ট্রোক যানবাহন নিষিদ্ধ করা এবং পরিবেশ আদালত গঠন করার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করা।


12. আমাদের দেশে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিবেশ মনিটরিং সেল ও তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত পরিবেশ শিক্ষাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।


13. পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি হচ্ছে সর্বোত্তম উপায়। ‘মানুষের পরিবেশ’ শীর্ষক এক অধিবেশন হয়েছে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালে। ১৯৯০ সালে আর্থ সামিট হয়েছে রিওডি জেনিরোতে। আজকে বিশ্ববাসীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একই পতাকাতলে সমবেত হয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা।


ড. আদিল মুহাম্মদ খানের ভাষায় বলতে চাই, বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীর পরাবাস্তবতা এখন নির্মম বাস্তব। ঘণ্টাধ্বনি বাজছে প্রবলভাবে, আগেও বেজেছে বহুবার। আমাদের ঘুম ভাঙেনি, এবার কি আমরা সম্মিলিত ভাবে ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পারব? ধরিত্রী মৌন হয়ে সৃষ্টির সেরা মানবজাতির দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। ধরিত্রীকে বাঁচাতে পরিকল্পনা ও উন্নয়নের নতুন দর্শনে পৃথিবীকে কি আমরা নবরূপে সাজাতে পারব? পরিবেশবিজ্ঞানী Peter Walliston বলেছেন, Environmental pollution is a great threat to the existence of living beings on the earth. একদিকে মানবসভ্যতার ক্রমবর্ধমান চাহিদা, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ রোধ, নিঃসন্দেহে জটিল একটি কাজ। তবুও ভাবলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখপানে সোনালী ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়। ৭ম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এদেশের জীববৈচিত্র্য ও অনুপম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ” A sleeping beauty emerging from mists and water.” এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে সতত ধরে রাখার মাধ্যমে ভবিষ্যতে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বিকাশ ঘটানো তাই সরকারের পাশাপাশি আজকে আমাদের সম্মিলিত এবং নৈতিক দায়িত্বও বটে। আমাদেরকে এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরি পাড়। আমাদের প্রত্যয় হোক।


“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

© ফাহাদ হোসেন ফাহিম
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান
| বিশ্বমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *