[১]
‘লেখাটা সুন্দর, বেশ সুন্দর! অনেক আবেগ আর ভালোবাসার রঙের মিলনমেলা যেন! প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো। পয়েন্ট শুড বি নোটেড: লেখাটার প্রেমে, লেখকের নয়। ’ইংরেজিতে একটা কথা আছে, Don’t judge a book by it’s cover. তবে একটা বয়সে আবেগ এসব উক্তি-টুক্তি আর মানে না। সে বয়স থাকে কিছুটা নদীর স্রোতের মতো। বাতাস যেদিকে নিয়ে যায়, সেদিকেই যায়। সে বয়সে আবেগের কাছে জ্ঞানবুদ্ধি সব লোপ পায়। সমাজ, বাবা-মা, সম্মান, আত্মমর্যাদা, কোনো কিছুর পরোয়াই থাকে না যেন। নফসের খাহেশাত আর শয়তানের বিছানো সূক্ষ্ম জালকে মনে হয় সমুদ্রের তটে বিছানো আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র।
সেই বয়সটায় চোখ থাকে ছটফটে, মন থাকে ফুরফুরে, হাসি-কান্নার এক অন্য জীবন। চোখ যা দেখে, মন যা বলে তাই ভালো লাগে। বাস্তব লাগে। লেখকের প্রেমি-প্রেমি, দুষ্টু-মিষ্টি লেখায় মন নেচে উঠে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। জীবনের চাহিদা ভিন্ন।
ফেসবুক, ইউটিউবে আজ সেলিব্রেটিদের প্রেমে পড়া এক সামাজিক ব্যাধির আকার ধারণ করেছে। টিনেজার মেয়েরা ভেড়ার পালের মতো সবাই এক দিকেই ছুটছে। ইসলামিক, অনৈসলামিক কোনো ব্যবধান নেই। সবাই প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। একে কি ব্যাধি বলা চলে?
হ্যাঁ ব্যাধিই তো! এমন একটা মানুষ, যাকে না চিনে- না বুঝে দিন-রাত তার প্রেমের স্বপ্ন দেখে ইসলামের সব বিধিবিধানকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া মানুষটিকে অসুস্থই বলা চলে। সে ভীষণ অসুস্থ। শরীরের নয়; মনের ব্যাধি লেগেছে তার।
গড়ে টিনেজার মেয়ে-ছেলেরা সবচেয়ে বেশি এই অসুখে ভুগে। কাউকে দেখলেই চোখের তারা ঝিকিমিকি করে, বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়, লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠে। বোকা ছেলে-মেয়েগুলো এটাকেই ভালোবাসা মনে করে বসে।
কারও লেখা বা কথা তার ভিতরের পরিচয় বহন করে না। সে ইসলামিক বক্তা বা লেখক হলেই সে প্রচুর আল্লাহওয়ালা হয়ে যাবে এমনটাও না। কেউ শুধুমাত্র প্রেমের কিছু কবিতা লিখলেই যে সে বিরাট প্রেমিক হয়ে যায় এমনও না। স্যোশাল মিডিয়া হলো এমন একটা জগৎ, এখানে কেউ নিজেকে যেভাবে দেখাতে চায়- সেভাবেই দেখানো যায়। শুধু একটা সুন্দর প্রচ্ছদ। যা মানুষ নিজের সঙ্গে লেপ্টে রাখে।
করণীয় আছে। অনেক দায়িত্ব আছে। আবেগকে নিয়ন্ত্রন করা শিখতে হবে। বোধশক্তিকে কোনো দিন লোপ পেতে দেওয়া যাবে না। শয়তানের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো, মানুষের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা। তা হতে দেওয়া যাবে না। কখনোই না।
[২]
وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی ‘তোমরা জিনার নিকটবর্তীও হয়ো না’ খেয়াল করুন, কুরআনের আয়াতে কিন্তু বলা হয়নি, জিনা করো না; বরং বলা হয়েছে ‘তার নিকটবর্তীও হয়ো না’। (বনি-ইসরাইল: ৩১)
চোখ দিয়ে পর-পুরুষকে দেখা, এটাও জিনা। চোখের জিনা। শয়তান প্রথমেই কিন্তু আমাদের মনে হারাম প্রেমের রঙ ঢালবে না। সে এক ধাপ এক ধাপ করে আগায়। প্রথমে চোখ দিয়ে তাকে দেখাবে, ভালো লাগবে, তারপর তার ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে হবে, ধীরে-ধীরে তার পোস্টগুলো কপি-শেয়ার থেকে শুরু করে কমেন্ট করা, কোনো কিছুই বাদ যাবে না। এই তো শুরু হয়ে গেল খেলা!
এরপর এমন একটা পর্যায় আসবে যে নিজেকে থামাতেই পারা যাবে না। বা হয়তো তখন আল্লাহ থেকে এত দূরে সরে পড়ে যাওয়া হয় যে, নিজেকে থামাতে ইচ্ছেই করে না।
এই রোগের চিকিৎসা হলো shoot when seen. প্রথমেই যখন খাহেশাত তৈরি হবে, আউযুবিল্লাহ বলে চোখ বন্ধ করে সোজা নফসকে গুলি মেরে পিঠ দেখিয়ে চলে আসতে হবে। খেল প্রথমেই খতম।
শয়তানের দ্বিতীয় আরেকটি চাল হলো, হারাম জিনিসটাকেই হালাল চোখে দেখানো। শুরুটা হবে এভাবে, ‘আমি তো দীনদার পাত্রই চাচ্ছি, এজন্যই তাকে পছন্দ করি। একটু কথা বলেই দেখি, বিয়ে হলে দুজন মিলে আল্লাহ তাআলার রাস্তায় বের হয়ে পড়ব। তাহাজ্জুদের সময় একে অপরের ওপর পানি ছিটিয়ে দেব, খুনসুটি করব, চিমটি কাটব, সুন্নাত মেনে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করব, আহা, কী সোনালি সংসার!’
ভুল! ‘গোড়ায় গলদ’ বা আরেকভাবে বলা যায় ‘গোড়ায় বলদ’। শয়তান বলদ বানাচ্ছে। দীনের নামে পরপুরুষের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। গায়েবের ইলম না থাকার কারণে আমরা ভালোকে খারাপ আর খারাপকে ভালো মনে করি। আল্লাহ তাআলার বলেন,
‘হতে পারে তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করো, যা আসলে তোমাদের জন্যই ভালো। আবার তোমরা এমন কিছু পছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য খারাপ।’ (বাকারাহ:২১৬)
আজকের জামানায় জুলাইবিব রা.-এর মতো কোনো ছেলের বায়োডাটায় কোনো মেয়েই রাজি হবে না। জুলাইবিব রা.-এর জন্যও হয়নি। পরবর্তী সময়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বিবাহের প্রস্তাব পাঠান এক নারীকে। অথচ দেখতে কালো, সম্ভ্রমহীন এই জুলাইবিবের মৃত্যুর পর হুরেরা তাকে নূরের পালঙ্কে চড়িয়ে নিয়ে গেছে। যে ছেলেটাকে ভালো মনে করছি সে ছেলেটাই যে ভালো হবে, এমন কি গ্যারান্টি?
হারামকে হারাম চোখে দেখে তা থেকে সরে আসাই মুমিনের পরিচয়। শয়তান আর মুমিনের মধ্যে পার্থক্যই হলো, শয়তান ভুল করে তওবা করে না, মুমিন তওবা করে।
[৩]
‘কেউ আমার ফিলিংস বুঝে না’ কথাটার দ্বারা কী বোঝায়? আল্লাহ তাআলা আর সেই মানুষটার মাঝে পর্দা পড়ে গেছে। একটা ভারী পর্দা। যেই মন আল্লাহ জন্য ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকে, সেই মন অন্য কারও জন্য উৎসর্গ হতে পারে না। একটা সময় এই মূল্যহীন এট্রাকশন হতাশার দিকে নিয়ে যায়। দুনিয়া অন্ধকার হতে থাকে। কাউকে পাশে না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেকে।
প্রথমেই রব্বুল আলামিনে কাছে সাহায্য চাইতে হবে। অনুশোচনা থাকতে হবে। সঠিক পথে চলার চাহিদা থাকতে হবে। বিশ্বাস, ভরসা রাখতে হবে- সারা দুনিয়া ছেড়ে গেলেও আল্লাহ আমার হাত ছাড়বেন না! দ্যাট মেইক আ ম্যান স্ট্রং। কেউ জানুক না জানুক, আল্লাহ তো জানে। ভিতরের সাদা-কালো সবই তার জানা। যা লুকাতে চাই, বা প্রকাশ করতে চাই, সব।
সেলিব্রেটিদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। লোকে তাদেরকে আইডল মানে। যদিও এটা করা উচিৎ নয়। আইডল মানার জন্য অনেক সালাফ আছেন। সাহাবিরা আছেন।
অনর্থক কথা, কাজ, কবিতা লেখা থেকে বিরত থাকাই উত্তম। যে বিষয়গুলো ফেতনার সাথে সংশ্লিষ্ট তা এড়িয়ে চলাই ভালো। যেসব বিষয় মানুষের কাজে আসবে না, ইসলামের দিকে দাওয়াত দিবে না, সে সকল বিষয় সবার সামনে উপস্থাপনের দ্বারা শুধুমাত্র সময়ই অপচয় হয়।
বিভিন্ন ধরণের লেকচার শোনা যেতে পারে। বই পড়লে, কুরআন হাদিসে সময় দিলে মানুষের এত প্রেমে পড়ার সময় থাকে না। জীবনের ব্যস্ততা তখন এসবের দিকে মুখ ঘোরাতে দিবে না।
সবচেয়ে ভালো হয় বিয়ে করে ফেললে। বিয়ে হারাম সব বিষয় থেকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
পরিশেষে, নিজের সাথে নিজেরই কথা বলা লাগবে। ভুল-ঠিকের মধ্যে পার্থক্য করা শিখতে হবে। কিছু কথা নিজের সাথেই যাক না হয়ে, যে কথা হয়নি বলা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের জীবনগুলোকে হালাল প্রেমের রঙে রাঙিয়ে দিক। হারাম প্রেমের গ্লানি মুছে, রাত্রি শেষে, স্নিগ্ধ ভোরে তাকদিরের বেঁধে দেওয়া প্রিয় মানুষটির হাত ধরে যেন আমরা বলতে পারি,
‘আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে’
© খাদিজা রায়হানা
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
Alhamdulillah. I have been inspired and learned by this blog. Shukriya 😊