বই

লোকে শুধু ধর্মীয় বই কেনে কেন? — জাহিদ রাজন

ইউরোপ আমেরিকাতেও মাত্র দুইভাগ বই আটানব্বই ভাগ ব্যবসা করে। যে কোনো প্রকাশককে অনেকগুলো সম্ভাব্য বই ছাপিয়ে এই রিস্কটা নিতে হয়- হয়তো কোনো একটা বই ভাল করবে।


আমি ওয়েস্টার্ন লেখকদের গত পাঁচ-সাত বছরে যতদূর বুঝেছি – একেকটা বই ফিকশন বা নন-ফিকশন যে ধরনেরই হোক না কেন, একজন লেখক অনেক সময় নিয়ে একটা বই লেখেন।


লেখকরা কত কষ্ট করে একটা বই লেখেন, নন-ফিকশন বইয়ের ক্ষেত্রে এটি আপনি খুব সহজে ধরতে পারবেন শুধু রেফারেন্স সেকশনটা দিয়ে। এছাড়া প্রায় প্রত্যেক ভালো লেখকের নিজের একটা রিসার্চ গ্রুপ থাকে। পিয়ারদের প্রফেশনাল গ্রুপ থাকে – যেখানে বই লেখার পর তারা অন্যান্য এক্সপার্টদের মতামত নিয়ে থাকেন। এই বিষয়ে তারা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন এবং অনেকগুলো পেপার পাবলিশ করে এরপর একটা বই লেখেন।


আর ফিকশন রাইটিং তো এমনিতেই অনেক কঠিন।


হেমিংওয়ের নামে একটা কথা প্রচলিত আছে – “There is nothing to writing. All you do is sit down at a typewriter and bleed.”

একজন ফিকশন রাইটার আপনাকে তার বর্ণনা এবং লেখা দিয়ে যে ট্যুর করিয়ে আনতে চান এর জন্য আসলে রক্ত-ঝরানো পরিশ্রম করতে হয়। লেখা আর কাটা, কাটা আর লেখা, লেখার চেয়ে অনেক বেশি এডিট এবং আবারো লেখা এই করে চলে জীবন।


ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে কপিরাইট ‘ল’ নিশ্চিত করবে – আপনি যদি অনেক কষ্ট করে লেখেন এবং একটা বই বাজারে চলে, আপনি প্রায় বাকি জীবন এই বইয়ের রয়ালটি দিয়ে চলতে পারবেন।

পশ্চিমে একজন লেখক একটা বই লেখেন, এরপর অন্তত দুইবছর এই বইয়ের ওপর বিভিন্ন জায়গায় লেকচার দেন, টেড-টক দেন, প্রশ্নের উত্তর দেন। সেমিনার করেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দেন। ভালো বই মানুষ হয়ত কেনে, কিন্তু এ ধরনের এংগেইজমেন্টের কোন বিকল্প নেই। একজন লেখকের কথা শুনে, প্রশ্ন করে – তার সাথে পাঠকের যে মানবিক সম্পর্ক তৈরি হয় – এটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়েও কাছাকাছি।


আমি যেকোনো বই কেনার আগে একজন লেখকের কিছু টেড-টক বা ইন্টার্ভিউ এবং তার কিছু লেখা – অন্ততপক্ষে তার লেখার বইয়ের বিষয়াদি এবং তার লেখার ধরনের সাথে পরিচিত হতে চাই। টাকা দিয়ে কিনব এবং সময় দিয়ে পড়ব। যে সময় আমাদের আছে, এটাকে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানোর জন্য আপনাকে অবশ্যই সিলেক্টিভ হতে হবে। নাসিম তালেব মনে করেন, যেকোনো কাজে আপনার সাফল্য নির্ভর করছে আপনি কী করছেন তার ওপর না, বরং আপনি কী কী বাদ দিতে পারছেন তার ওপর।


“They think that intelligence is about noticing things are relevant (detecting patterns); in a complex world, intelligence consists in ignoring things that are irrelevant (avoiding false patterns).”

বাংলাদেশে এবার যেসব বই বেস্ট-সেলার হয়েছে, সেসব বইয়ের লেখকদের লেখা সবার ভালো লাগছে না। ঠিক আছে, এটা ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার। কিন্তু বরাবরের বেস্ট-সেলার লেখকরাও তো ধরেই নিয়েছিলেন- ‘বোতল ভুত’ লিখে পাঠকদের বোতলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবেন। সবাইকে সবসময় এরকম বোকা ভাবা ঠিক না। গত দশ-বিশ বছর রাজত্ব করার পরেও তারা নিজেদের সামান্য আপডেট করার প্রয়োজন মনে করেন নি।


ধর্মীয় বইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অনেক সেলিব্রেটি লেখক ভুলে যান – ক্লাসিক বই ছাড়া প্রায় সব বইয়ের আবেদন সীমিত। আপনি কয়বার কোনো একজন লেখকের বই উল্টে-পাল্টে পড়েন? ধর্মীয় বইয়ের প্রয়োজনীয়তা সার্বজনীন, আরো অনেকদিন পড়েও এই বই থেকে উপকৃত হতে পারেন বলে এর পাঠকরা মনে করেন। এই যে টাইমলেস ফিচার, এটা যদি আপনি অর্জন করতে চান অবশ্যই ভেবে দেখবেন – আপনার বই এখন থেকে পাঁচ-দশ বছর পর প্রাসঙ্গিক থাকবে কিনা?

এতবছর ধরে আলোকিত মানুষ তৈরির কাজ যারা করলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেন, পত্রিকায় লিখলেন, সভা সমিতিতে বক্তৃতা দিলেন, টক-শো করলেন; আপনারা কেন নতুন পাঠক তৈরি করতে পারলেন না? এই জায়গাগুলো তো হুজুররা দখল করে রাখেনি। বড়-বড় লেখকরা বই লেখেন অথচ বইগুলো নিয়ে কোনো সুন্দর আলোচনা হয় না, সমালোচনা বা রিভিউ হয় না, তারাও পাঠকদের সাথে এংগেইজ হন না; তাদের শুধু খেদ – লোকে তাদের বই কেনে না! অথচ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি – কোন শিক্ষক যদি ক্লাসে একটা সুন্দর ঘটনার রেফারেন্স দিয়ে একটা বইয়ের কথা বলেন, ক্লাসের দশজন ছাত্র আছে – যারা এ বইয়ের বিষয়ে আগ্রহী হয়।


ভালো বই লিখেও কেউ যে সফল হবেন -তার গ্যারান্টি কোন মার্কেটেই নেই। তবে ভালো লিখতে থাকলে হয়তো মানুষ একটা পর্যায়ে কারো লেখা পড়বে এই সম্ভাবনা থাকে। অনেক প্রস্ততি থাকলে ভাগ্যের সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। বাংলাদেশের লেখকদের শুধু অভিমান – লোকে আমার বই কেনে না কেন? আমি তো ভালো বই লিখেছি, এখন তো কেবল লোকেদের ঠেকা!

© জাহিদ রাজন
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *