সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স। ৫৪ বছরের ছোট্ট একটা জীবন। ৩৩ বছরই যার কেটেছে অশ্বপৃষ্ঠে। ১৭ বছরের শাসনকাল। ১৭ মাসও নির্বিঘ্নে রাষ্ট্র চালাতে পেরেছেন কি-না সন্দেহ! সর্বদাই ছুটতে হয়েছে শত্রুর পিছু-পিছু। দেশ থেকে দেশান্তরে। চিতার ক্ষিপ্রতায় চষে ফিরতে হয়েছে পাহাড়, জঙ্গল, মরু-বিয়াবান আর সমুদ্র উপকূলে।
আধুনিক মিশর, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক ছিল তাঁর অবাধ বিচরণক্ষেত্র। তিন মহাদেশ ছিল কুরুক্ষেত্র।
তাঁকে একসাথে লড়তে হয়েছে তিন-তিনটি দুর্ধর্ষ পরাশক্তির সাথে। তার দুর্দান্ত থাবায়ই মোঙ্গলদের পিলে চমকে উঠেছিল। ক্রুসেডমানসে ভীতি ছড়িয়েছিল। গুপ্তঘাতকরা পথ হারিয়েছিল।
ক্রুসেড যদি তাকে দিয়ে থাকে অমরত্ব; মোঙ্গলবধ করে তুলেছে আরও গৌরবদীপ্ত। গুপ্তঘাতক নিধন তার কীর্তিতে চড়িয়েছে আলাদা মাহাত্ম্য।
তীব্রগতি, বজ্রথাবার কারণে ক্রুসেডারদের চোখে তিনি ছিলেন ‘দ্য প্যান্থার’—চিতারাজ। ক্রুসেডের দীর্ঘ ইতিহাসে খ্রিস্টানরা তার হাতেই সর্বশেষ ও প্রচণ্ড মার খায়। বস্তুত তার কঠোর কষাঘাতেই যবনিকাপাত ঘটে অন্তহীন ক্রুসেডের। ফলে তার ছিল আরও একটি ইউরোপীয় অভিধা—‘শেষ আঘাত’।
তিনি ছিলেন মামলুক সুলতান। তাঁর হাতেই মামলুক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর হাতেই জয়রথ থেমে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল তাতারি গোষ্ঠী। পরাজিত হয়েছিল ক্রুসেডাররা। বন্দি হয়েছিল ফ্রান্স সম্রাট। নির্মূল হয়েছিল হাশাশিনরা। খ্রিস্টানদের হাত থেকে উদ্ধার হয়েছিল বায়তুল মাকদিস। এ রকম রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে বইটি লিখিত।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সুলতান বাইবার্সের সেসব কালজয়ী উপাখ্যান, বর্ণাঢ্য বীরত্বগাঁথা বহুকাল ধরেই পর্দাবৃত হয়ে আছে। চেপে রাখা হয়েছে সুকৌশলে। এই বই চায়, সামান্য হলেও মহাকালের ঘনকালো সে পর্দা সরে যাক। অনালোচিত ইতিহাসের দ্বার খুলুক। প্রজন্মের চিন্তায় গতি পাক।
Muhammad Tamimul Ihsan –
|| বুক রিভিউ ||
▪︎বইয়ের নাম: সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স দ্য প্যান্থার
▪︎লেখক: ইমরান আহমাদ
▪︎প্রকাশক: কালান্তর প্রকাশনী
▪︎বইয়ের ধরন:ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব
▪︎প্রচ্ছদমূল্য: ২৭০/-
▪︎প্রকাশকাল: জুলাই ২০২০ (তৃতীয় সংস্করণ ও চতুর্থ মুদ্রণ)
■ শুরুর কথা:
তুর্কি মুসলিমদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে,”যে জাতি তার পূর্ব পুরুষের ইতিহাস ভূলে যায়,সে জাতির অধঃপতন কেউ ঠেকাতে পারেনা”। আমাদের সমগ্র মুসলিম জাতির অবস্থটাও হয়েছে ঠিক অনুরুপ। নিজের শেকড় ভুলে আমরা মেতে উঠি পাশ্চাত্যের এক জগন্য খেলায়। যেখানে ক্রুসেডার,টেম্পলার নাইটদের দেখানো হয় নায়ক আর সেখানে আমাদের দেখানো হয় নারীলোভী,অর্থলোভী ভোগ-বিলাসিতা প্রিয় এক জাতি হিসেবে।আসলেই কি আমরা এমনটা ছিলাম। প্রকৃত ইতিহাস কী বলে?আমাদের বীরত্ব গাঁথাকে তো এক প্রকার আড়াল করে রাখা হয়েছে বলা যায়। তাই আজ আলোচনা করবো আমাদেরই এক চিতারাজ সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স সম্পর্কে। যিনি তীব্রগতি ও বজ্রথাবার কারণে ক্রুসেডারদের চোখে ছিলেন দ্য প্যান্থার—চিতারাজ।
■ কাকে নিয়ে লেখা বইটি:
লেখক ইমরান আহমাদ কর্তৃক রচিত এই ইতিহাসের বইটির নায়ক মুসলিম সালতানাতের এক অবিস্মরণীয় সিংহপুরুষ দ্য প্যান্থার খ্যাত সুলতান আবুল ফাতিহ আল মালিকুজ জাহির রুকনুদ্দিন বাইবার্স আল বানুকদারি। যিনি ছিলেন উম্মত্ত ক্রুসেডের ত্রাস,বর্বর মোঙ্গলদের বিনাশ,হারামি ফেদাইনদের অভিশাপ। তিনিই ছিলেন মূলত ক্রুসেডের কোমর ভাঙ্গার কারিগর। যার লৌহ কঠিন থাবায় ক্রুশের নাগপাশ থেকে দ্বিতীয়বার মুক্ত হয়েছিল পবিত্র মাসজিদুল আকসা।সর্বাধিক চার চারটি ক্রুসেড যুদ্ধ যিনি একাই তার সৈন্য নিয়ে সামলিয়েছেন। তিনিই পৃথিবীর একমাত্র মুসলিম সেনাপতি যিনি ইউরোপের কোনো সম্রাটকে খাঁচায় পুরেছেন। বাগদাদের কসাইখ্যাত নরখাদক হালাকু খানকে যিনি সর্বদাই রেখেছেন দৌড়ের উপর।আনাতোলিয়া,হোমস,বিরা ও আইনে জালুতের যুদ্ধে মোঙ্গলদর্প তিনিই চূর্ণ করেছেন। সেই মহান মুসলিম সেনাপতির জীবনপরিক্রমা নিয়েই রচিত ইতিহাসের এই অসাধারণ বইটি।
■ বই আলাপন:
বইটিকে ভাগ করা হয়েছে বেশ অনেকগুলো ভাগে। যেখানে শুধু সুলতান বাইবার্সের বর্ণাঢ্য জীবনীই উঠে আসেনি,এসেছে তার সমসাময়িক অন্যান্য ঘটনাগুলোও। মোট দু’শ পনেরো পৃষ্ঠায় উঠে এসেছে আল মালিকুজ জাহির সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের জীবনী।
• প্রথম অংশে আলোচনা করা হয়েছে সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের জন্ম,জন্মস্থান,বংশপরিচয়,দাশবাজারে বিক্রি,আইয়ুবি বাহিনীতে সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স কীভাবে সৈনিক পদ লাভ করলেন তা নিয়ে। এছাড়াও তৎকালীন আইয়ুবী সাম্রাজ্য নিয়ে এক ছোটোখাটো বিশ্লেষণ ছিলো অধ্যায়টিতে।
• দ্বিতীয় অংশে উঠে এসেছে সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের ক্রুসেডারদের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে। যেখানে বাইবার্সের হাতে প্রিন্স রবার্টের শোচনীয় পরাজয়,সম্রাট নবম লুইয়ের পরাজয় ও বন্দীদশার চিত্র অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এরপর মিশরে মামলুকদের আগমন, খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে মোঙ্গল তান্ডব নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে অধ্যায়টিতে।
• বইটির তৃতীয় অংশে আলোচনা করা হয়েছে মোঙ্গলদের পরিচয়, চেঙ্গিস খানের বংশধর, হাশাশিনদের নিয়ে। বাগদাদে আব্বাসি খিলাফাহর পতন,মোঙ্গলদের তান্ডব এসব নিয়েই একপ্রস্থ আলোচনা করা হয়েছে বইটির এি অংশে।
• বইটির চতুর্থ অংশে এসে আলোচনা করা হয়েছে আইনে জালুত যুদ্ধ নিয়ে। যেখানে মোঙ্গলদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিলেন সুলতান সাইফুদ্দিন কুতজ এবং সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স। মোটকথা অধ্যায়টিতে আইন জালুত যুদ্ধের এক পূর্ণাঙ্গ রুপ পেশ করা হয়েছে।
• বইটির পঞ্চম অংশে এসে সুলতান কুতজ হত্যা,হত্যার কারণ,মামলুকদের সিংহাসন আরোহরনের পদ্ধতি, রুকনুদ্দিন বাইবার্সের সুলতান হওয়া এসব নিয়েই বিস্তর আলাপ করা হয়েছে। হালাকু খান ও ভন্ড ফেদাইন গ্রুপের কোমর ভাঙ্গার গল্পও উঠে এসেছে অধ্যায়টিতে। বাগদাদের খিলাফাহ ফিরিয়ে আনা, ক্রুসেড নির্মূলে বাগদাদের অবদান, বার্কে খান-বাইবার্স মৈত্রীচুক্তি,হালাকু-বার্কে দ্বন্দ্ব, কারাকের যুদ্ধ এসব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই অংশে এসে।
• বইটির ষষ্ঠ অংশে এসে সম্পূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে ক্রুসেড যুদ্ধ নিয়ে। দ্বিতীয়বার আল আকসা পুনরুদ্ধার হসপিটালার নাইট,টেম্পলার নাইটদের কোমর ভাঙ্গা,এন্টিয়ক আক্রমণ, হাশাশিনদের নির্মূল করা, সপ্তম,অষ্টম,নবম এবং দশম ক্রুসেড মোকাবিলা, বাইবার্সের বিজয়রথ এগুলো নিয়েই চমৎকারভাবে আলোচনা করা হয়েছে এই অংশে।
• আর সর্বশেষ আলোচনা করা হয়েছে আল মালিকুজ জাহির সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্সের ইন্তেকাল ও দাফন নিয়ে। এক নজরে সুলতান বাইবার্স নামে ছোট্ট একটা রিমাইন্ডার দিয়ে দেওয়া হয়েছে বইটির শেষাংশে। মহান আল্লাহ সোনালী যুগ পরবর্তী উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ এই যোদ্ধাকে যথাযথ প্রতিদানে সম্মানিত করুন।আমিন।
■ আলোচনা-সমালোচনা:
ইতিহাসের বইয়ের একটা কলঙ্ক আছে।সবাই বলে থাকে ইতিহাসের বইয়ের মতো বোরিং আর কাঠখোট্টা বই নাকি দুনিয়াতে নাই। তাই অনেকেই ইতিহাসের বই ছুঁয়েও দেখতে চায় না। কিন্তু দ্য প্যান্থার বইটির শব্দচয়ন বেশ সাবলীল আর সুখপাঠ্য।একবার বইটি নিয়ে বসলে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না এমন টাইপ বই। বইটিতে সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয়টি হলো বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। সুলতান রুকনুদ্দিন বাইবার্স, এক মামলুক দাস কীভাবে পুরো মোঙ্গল ও ক্রুসেড শক্তিকে নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন। এই সুদূর গাঙ্গেয় বদ্বীপে বসেও বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখায় সাহস সঞ্চার করেছে বইটি। প্রয়োজনীয় টীকা ও তথ্য সংযোজন বইটিকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। এতো এতো ভালো লাগার পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমতিও চোখে পড়েছে। যেমন সুলতান বাইবার্স যেসব জায়গায় অভিযান চালিয়েছেন তা যদি মানচিত্রের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা যেতো তাহলে বইটি আরো প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় হতো।
■ প্রচ্ছদ-পৃষ্ঠাসজ্জা:
হার্ডকভারের বই নিয়ে আমার আনার এলার্জি থাকলেও বইটির বাঁধাই এবং প্রচ্ছদ দারুন ছিলো।দুর্গের ছবি এক আলাদা ভাবগাম্ভীর্য বহন করছে। এছাড়াও বইটির লিখনশৈলী,পৃষ্ঠাসজ্জা,টীকা আর শব্দচয়নও ভালো লাগার মতো।
■ কারা পড়বেন এবং কেন পড়বেন…??
দিন দিন যেন আমরা অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছি। মুসলিমদের পশ্চাদপসরণ দিন দিন যেন বেড়েই।অথচ আমরা কি আসলেই এমন জাতি ছিলাম।আমরা জয় করেছি মিসর,সিরিয়া আর অজেয় কনস্টান্টিনোপল। তারপরও কেন এত হীনম্মন্যতা….!! নতুন করে ক্রুসেড আবার জেগেছে কিন্তু জি|হা|দ কি আর জেগেছে,জেগেছে কি ক্রুসেড দমনে বাইবার্স আর গ্রেট সালাদিনের তরবারি। নিজের বিবেককে, নিজের ঘুমন্ত বোধকে জাগ্রত করতে যারাই চান তাদের জন্য বইটি আরেকটা মাস্টারপিস।
■ শেষ কথা :
দিনশেষে বইটি পাঠকপ্রিয় হোক,মুসলিম উম্মাহর চেতনা জাগরনে বইটি যেন সহায়ক হয়। মহাকালের ইতিহাসের ঘনকালো সে পর্দা সরে যাক। অনালোচিত ইতিহাসের দ্বার খুলুক। প্রজন্মের চিন্তায় গতি পাক। আবার জেগে উঠুক যুগের নতুন বাইবার্স-সালাদীন।
কবির ভাষায়,
“তুমি উঠে এসো তুমি উঠে এসো মাঝি মাল্লার দলে,
দেখবে তোমার কিশতী আবার ভেসেছে সাগর জলে।”
★ ব্যক্তিগত রেটিং: ৫/৫
▪︎রিভিউয়ার: মুহাম্মাদ তামিমুল ইহসান