সাহাবীরা হলেন নববী ইলমের ধারক ও বাহক। কিন্তু, তাদের জীবনী সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা সাধারণত খুব কম। বেশিরভাগ মানুষ ১০-১২ জনের বেশি সাহাবীর নাম পর্যন্ত জানেন না, তাঁদের জীবনী জানা তো অনেক দূরের কথা!
.
‘তারা ঝলমল’ বইটি ৩২ জন সাহাবীর জীবনের গল্প নিয়ে। নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে তাঁদের সম্পর্ক কেমন ছিলো, নিজেদের শ্রেষ্ঠ গুণটি কিভাবে তারা ইসলামের তরে কাজে লাগিয়েছেন এই নিয়েই ‘তারা ঝলমল’।
Copyright © 2025 Seanpublication.com
Arafat Shaheen –
বই: তারা ঝলমল
বর্তমান সময়ের তরুণ লেখকদের মধ্যে আরিফুল ইসলাম এক পরিচিত নাম। এ পর্যন্ত তিনি যে চারটি বই লিখেছেন—আর্গুমেন্টস অব আরজু, প্রদীপ্ত কুটির, চার তারা এবং তারা ঝলমল তা পাঠকমহলে ‘ব্যাপক’ সাড়া জাগাতে না পারলেও মোটামুটি যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এর আগে আযান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘চার তারা’ নামক বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে চার মাজহাবের স্তম্ভখ্যাত ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইমাম শাফেয়ী (রহ.)-কে নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
ইতিহাসের গলি-ঘুপচিতে ঘুরে সোনালি যুগের মুসলিমদের জীবনকাহিনী পড়ার প্রতি লেখকের ঝোঁকের পরিমাণ বোধহয় একটু বেশিই! এজন্যই পরের বইটি অর্থাৎ ‘তারা ঝলমল’-এ পৃথিবীর সবচেয়ে সোনার মানুষ সাহাবিদের জীবনী নিয়ে আলোচনা করেছেন।
•
‘তারা ঝলমল’ বইয়ে সর্বমোট ৩২ জন সাহাবির পবিত্র জীবনকথা নিয়ে মোটামুটি ‘সংক্ষেপে’ আলোচনা করা হয়েছে। এখানে একটা বিষয়ে আলোকপাত করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। বাংলা ভাষায় নবীজি কিংবা সাহাবিদের জীবনীচর্চার ইতিহাস মোটামুটি পুরনোই বলা চলে। তবে এটা অত্যন্ত দুঃখের যে এই বিষয়ে বাংলা ভাষার মৌলিক গ্রন্থের পরিমাণ হাতে গোনা। সাম্প্রতিক সময়ে সিরাত ও সাহাবিদের জীবনী নিয়ে বহুসংখ্যক অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও মৌলিক বই রচনার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি।
বয়সে তরুণ হলেও আরিফুল ইসলাম মৌলিক কাজের দিকে এগিয়ে এসেছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।
‘তারা ঝলমল’ বইটি বেশ আগ্রহ নিয়েই পুরোপুরি শেষ করেছি। এক্ষেত্রে লেখক আমাকে হতাশ করেননি। তার বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখার মতো। যেহেতু মাত্র ১৯২ পৃষ্ঠার বইয়ে ৩২ জন সাহাবির জীবনী এসেছে, তাই লেখায় ‘মেদ’ থাকার কোনো সুযোগ নেই; একেবারে ঝরঝরে লেখা।
লেখায় আরেকটা বিষয়ে নতুনত্ব এনেছেন আরিফুল ইসলাম। সাধারণত জীবনীর ক্ষেত্রে যার জীবনী লেখা হচ্ছে, শিরোনাম হিসেবে তার নামটি থাকে। কিন্তু এখানে সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। অর্থাৎ শিরোনামে কোনো সাহাবির নামোল্লেখ নেই! তাহলে কীভাবে লেখা হয়েছে? উদাহরণ দিই—
প্রথম লেখাটি হযরত বিলাল ইবনু রাবাহ রা.-কে নিয়ে। আমরা সবাই জানি, বিলাল রা. ইসলাম গ্রহণের আগে ক্রীতদাস ছিলেন। তাই তিনি যখন ইমান আনেন তখন তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হতো। তাঁকে মরুভূমির তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে রাখা হতো। এ সময় তাঁর মুখ দিয়ে বের হতো—আহাদুন আহাদ।
তাই বিলাল রা.-এর জীবনীর শিরোনাম হলো ‘আহাদুন আহাদ’।
ব্যাপারটা মজার না?
•
উহুদ যুদ্ধে হযরত তালহা রা.-এর অসীম বীরত্বের কারণে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে জীবন্ত শহীদ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাই তাঁর জীবনীর শিরোনাম ‘জীবন্ত শহীদ’।
ঠিক একইভাবে আবদুর রহমান ইবনু আউফ রা.-এর ক্ষেত্রে ‘ওপরের হাত নিচের হাত অপেক্ষা উত্তম’, খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রা.-এর ক্ষত্রে ‘অজর তলোয়ার’ শিরোনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
এভাবে প্রত্যেক সাহাবির ক্ষেত্রেই শিরোনামে তাঁর নাম ব্যবহার না করে তিনি সবার কাছে যে নামে পরিচিত ছিলেন সেই নামে বা তিনি যে কর্মের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন সেই শব্দবন্ধকে শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই বিষয়টা আমার কাছে বেশ অভিনব বলে মনে হয়েছে। শিরোনামের কারণে কৌতুহল দমনের জন্য হলেও বইয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে পাঠককে।
অসংখ্য ভালোলাগার মধ্যে দু-একটি মন্দলাগা থাকা অস্বাভাবিক নয়। আমার কাছেও একটা বিষয় একটু ‘মন্দ’ লেগেছে। সেটা হলো—কিছু বাক্যের মধ্যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। যেমন প্রথম লেখাতেই—’এই আগুন গরম পাথরের ওপর একটা ডিম ভেঙে দিলে ডিমটি ফ্রাই হতে বেশিক্ষণ লাগবে না’। এই বাক্যের ‘ফ্রাই’ শব্দটি আমার কাছে যুতসই ঠেকেনি। এখানে বিকল্প শব্দ ব্যবহার করা যেত সহজেই। হয়ত আমার এরকম লেখা পড়ার অভ্যাস কম বলেই এমনটা মনে হয়েছে।
•
ভূমিকাতে লেখক ঘোষণা দিয়েছেন ‘তারা ঝলমল’ বইয়ের পরবর্তী আরও কয়েকটা খণ্ড আসবে। সেখানে তিনি অন্য সাহাবিদের নিয়েও আলোচনা করবেন। তাই আমার মনে হয়েছে এই বইয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করার দরকার ছিল; সাহাবিদের জীবনসংশ্লিষ্ট অন্য ঘটনাগুলোও এখানে আনা যেত। অবশ্য যারা নতুন পাঠক তাদের জন্য অবশ্য এতটুকু আলোচনাই যথেষ্ট হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো—বাংলা ভাষায় এই ধরনের মৌলিক বইয়ের যে ঘাটতি রয়েছে, সেখান থেকে যে আমরা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে পারি এই বই তারই দৃষ্টান্ত। আমি আশা করি, পরবর্তী খণ্ডগুলোও পাঠকের কাছে দ্রুত চলে আসবে। ‘তারা ঝলমল’ বইয়ের সাহাবিদের মতো আমাদের জীবনটাও ঝলমলে হয়ে উঠুক। আল্লাহ লেখক এবং আমাদের মতো পাঠকদের উত্তম প্রতিদান দিন।