fbpx
সংশয়বাদী
সংশয়বাদী

সংশয়বাদী

লেখক : ড্যানিয়েল হাকিকাতজু
প্রকাশনী : Ilmhouse Publication
বিষয় : অন্ধকার থেকে আলোতে
পৃষ্ঠা : 266, কভার : পেপার ব্যাক, সংস্করণ : ১ম

260

Share This Book:

ক্যাশ অন ডেলিভারী

৭ দিনের মধ্যে রিটার্ন

ডেলিভারী চার্জ ৬০ টাকা থেকে শুরু

Description
যেসব মুসলিম প্রাণে বেঁচে গেল তারা এবং তাদের সন্তানেরা মগজধোলাইয়ের শিকার হয়ে একসময় মডার্নিটি এবং এর মতবাদগুলো গ্রহণ করতে শুরু করল। পশ্চিমা শিক্ষা-ব্যবস্থা, মিডিয়া, সাহিত্য এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে মুসলিমদের মনে গেঁথে দেয়া হলো, ‘আধুনিক = ভালো’।
.
আধুনিকায়িত মুসলিমরা গ্রহণ করল এক প্যারাডক্সিকাল চিন্তা–মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব ফিরে পাবার চাবিকাঠি হলো আধুনিকতাবাদ। কর্তৃত্বের অবস্থানে ফিরে যেতে হলে অনুসরণ করতে হবে পশ্চিমের। আধুনিক পশ্চিমের মতবাদ, দর্শন, রাজনীতি, লাইফস্টাইল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি–অনুকরণ করতে হবে সবকিছু। এই ধারণা আজও অতটাই শক্তিশালী যতটা ছিল ২০০ বছর আগে। আর গতকালের মতো আজও এ ধারণা মিথ্যা।
.
যে মানুষ প্রগতিবাদে বিশ্বাসী–যে মনে করে মানুষ ক্রমেই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে, আজকের মানুষ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক নৈতিক–সে কীভাবে বিশ্বাস করবে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রজন্ম এবং পরবর্তী দুই প্রজন্ম? এ দুই অবস্থান একইসাথে ধারণ করা সম্ভব না। কিন্তু কলোনাইযড মুসলিমের মন এই দুই সাংঘর্ষিক অবস্থানের মধ্যে সমন্বয়ের জন্যে নানান কসরত করতে থাকে।
.
‘হয়তো সমাধান ইসলামের সংস্কার করার মধ্যে। হয়তো সমাধান ইসলামকে আধুনিকতার মাপকাঠিতে আপডেট করায়। হয়তো ইসলামের যা কিছু লিবারেলিসম, সেক্যুলারিসম, নারীবাদ, বস্তুবাদ, বিজ্ঞানবাদ, ইত্যাদির সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলো মুছে ফেললেই সমাধান হবে!
.
মুসলিমরা আজ ব্যাপকভাবে যেসব সংশয়ে আক্রান্ত হচ্ছে, এ ধরনের চিন্তাগুলোই তার উৎস। এই সংকট ও সংশয়গুলোর মুখোমুখি হলে আধুনিকাতাবাদ দ্বারা কলুষিত মুসলিম মন চিন্তা করে আধুনিকতার ছাঁচে ফেলে ইসলামকে কাটছাঁট করার, অর্থাৎ ইসলামকে বিকৃত করার। কিন্তু দ্বীন ইসলামকে বিকৃত করার বদলে তাদের আসলে আধুনিকতাবাদের ছাঁচকে ভাঙার চিন্তা করা উচিত। আর আধুনিকতার ছাঁচকে ভাঙতে হলে ওইসব মতবাদ আর তন্ত্রমন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ করতে হবে, যেগুলো আজ মুসলিমদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।
.
মুসলিম মন যখন এই বিষাক্ত মতবাদগুলোর আবর্জনা থেকে মুক্ত হবে, সে যখন চিন্তার দাসত্বের শেকলকে ছিঁড়বে, আধুনিকতার মগজধোলাই থেকে বের হয়ে আসবে, যখন তার চিন্তার বি-উপনিবেশিকরণ হবে–তখনই ইসলামের বিশুদ্ধ আলোতে সে স্পষ্টভাবে বাস্তবতাকে বুঝতে শিখবে।
Author

Author

ড্যানিয়েল হাকিকাতজু

Reviews (11)

11 reviews for সংশয়বাদী

  1. Naimur_Naahid

    [রিভিউ: সংশয়বাদী]

    • বই সম্পর্কে:

    ~ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।’ — এখানে দ্বীন বলতে আল্লাহ তাআলা যা বুঝিয়েছেন তা হল – ওয়ার্ল্ডভিউ; আরেকটু বিস্তৃত ভাবে বললে ইসলাম এমন একটি লেন্স যা দিয়ে আমরা পুরো সৃষ্টিজগতকে দেখি। সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিকতার ভিত্তি হচ্ছে ইসলাম। ইসলামই হচ্ছে সমগ্র ভালো-মন্দের একমাত্র মাপকাঠি। ঠিক এই জায়গাগুলোতেই ইসলাম ও বর্তমান আধুনিক লিবারেল -সেকুলার ওয়ার্ল্ডভিউ এর মূল সংঘাত; যা চায় ইসলামকে ‘উপাসনালয়ের ধর্ম’ বানাতে।

    ~ বর্তমানে আইডিওলজির মাঠে ইসলাম — মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, অধিপতি কর্তৃক মনোনীত, ও লিবারেল-সেকুলারিজম — নাপাক, অসভ্য, মুশরিক, কাফের কর্তৃক তৈরিকৃত, পরস্পর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৮ ও ১৯ শতক জুড়ে এই লিবারেল সেক্যুলারিজমের বিষবাষ্প বহনকারী ইউরোপ পুরো বিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে স্থাপন করেছিল অভিশপ্ত উপনিবেশ। একে একে তাদের সশস্ত্র সৈন্য দেশ ত্যাগ করলেও সেসব অধিকৃত দেশগুলোতে তারা রেখে গিয়েছিল অগণিত বুদ্ধিবৃত্তিক দাস। তারা সভ্যতার এমন পাঠ শিখিয়ে গিয়েছিল যা বর্তমান সময়ে এসে উম্মাহর সবচেয়ে বড় ফিৎনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের এমনভাবে ব্রেনওয়াশড করেছে যে, আমরা একদিকে নিজেদেরকে মুসলিম বলেও দাবি করি অন্যদিকে ইসলাম যে আমাদের নৈতিকতার মানদন্ড দেয় তাও মেনে নিতে অস্বীকার করি। নানান ছল-ছাতুরিতে আমরা শরীয়তের হুকুম-আহকাম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতেও দ্বিধা করি না। পরাজিত মন মানসিকতা থেকে পাশ্চাত্যের ফ্রেমওয়ার্কে বেঁধে দেওয়া ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মু্ক্তচিন্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, নারীবাদ, গণতন্ত্র, সর্বজনীন মানবাধিকার ইত্যাদিকে ‘ইসলামেও আছে’ এমন প্রমাণ করার চেষ্টা করছি।
    কিন্তু কখনো কি আমরা এমন প্রশ্ন করেছি মুক্তচিন্তার মুক্ত বলি কখনো মুক্ত হতে পারে কিনা ? কখনো কি প্রশ্ন তুলেছি ধর্মীয় স্বাধীনতার পসিবিলিটি নিয়ে ? ফেমিনিজম, ডেমোক্রেসি বা হিউম্যানিজমের মোরাল ভ্যালু নিয়ে কি আমাদের মনে কখনো প্রশ্ন জেগেছে ? সম্ভবত আমরা এমনটা চিন্তা করতে পারিনি। কারণটা অনুবাদকের মুখ থেকেই শুনুন — “আধুনিকতার ঠিক করে দেওয়ার চিন্তা ছক আর কাঠামো থেকে আমরা সহসা বের হতে পারি না। এর ভেতরেই আমাদের চিন্তা। আধুনিকতার মতবাদগুলোর প্রস্তাবনা আর অনুসিদ্ধান্ত গুলোকে আমাদের কাছে ‘কমনসেন্স’, স্বতঃসিদ্ধ অথবা সপ্রমাণিত বলে মনে হয়। ”

    ~ ইসলামের ঐশ্বরিক সৌন্দর্য সবসময়ের জন্য কনস্ট্যান্ট; যা যে কোন ধরনের প্রশ্ন করার ঊর্ধ্বে। আমরা এটা মন-মগজ দিয়ে বিশ্বাস করি। তাই আমরা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি পাশ্চাত্য সভ্যতাকে। মূলত এই কাজটাই ড্যানিয়েল হাক্কিকাতযু করেছেন তার ‘The Modernist Menace To Islam’ বইয়ে; যেটির ৮০ টি প্রবন্ধের সমন্বয় হল ‘সংশয়বাদী’। চলুন জেনে নিই বইটিতে কোন্ কোন্ বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লেখা হয়েছে।

    • বইটিতে যা আছে :

    বইটিতে মোট অধ্যায়ে আছে ১৩ টি। প্রতিটি অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে স্ব স্ব বিষয়ের উপর এক বা একাধিক প্রবন্ধ। অধ্যায়গুলো হলো :
    ১. নাস্তিকতা ;
    ২. গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ;
    ৩. সাম্য, মুক্তি, স্বাধীনতা ;
    ৪. নারীবাদ;
    ৫. হিজাব;
    ৬. বিজ্ঞানবাদ;
    ৭. লিবারেলিসম;
    ৮. নৈতিকতা ও প্রগতিবাদ;
    ৯. মর্ডানিটি;
    ১০. সংস্কারপন্থী ও মর্ডানিস্ট মুসলিম;
    ১১. যৌনতা ও যিনা;
    ১২. অন্যান্য;
    ১৩. সংশয়বাদী।

    প্রতিটি অধ্যায় চমৎকার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। শাখা-প্রশাখা বাদ দিয়ে প্রতিটি বিষয়ের মূল কেন্দ্র-বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রতিটি লেখাতে প্রকাশ পেয়েছে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য। প্রতিটি প্রবন্ধে আপনি মানবরচিত নাপাক মতবাদের দুর্গন্ধ টের পাবেন। প্রতিটি লাইন আপনাকে চিন্তা করাবে।

    • লেখক সম্পর্কে:

    ~ চমৎকার মেধাবী এই লেখকের জন্ম পাশ্চাত্যে। পড়াশোনাও করেছেন সেখানকার সেরা সেরা ইউনিভার্সিটি গুলোতে। বিশ্ব বিখ্যাত সব নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ ও দার্শনিকদের সান্নিধ্যে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন ফিজিক্স ও দর্শনে। নিয়মিতই আলিমগণের সান্নিধ্যে থেকে দ্বীন চর্চা করছেন। ইসলামের খেদমত করছেন আলসানা ইনস্টিটিউট এর মাধ্যমে।

    ড্যানিয়েল হাক্কিকাতযুর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তিনি সবসময় ফোকাস করেন ঘটনার ভেতরের ঘটনাটাকে। অস্থায়ী, অস্থিতিশীল সকল মতবাদের মৌলিক ভিত্তি নাড়িয়ে তার জুড়ি নেই।

    • অনুবাদক :

    ~ আসিফ আদনান । বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তি অঙ্গনের রাহবার। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন অর্থনীতিতে । সম্পাদনা করেছেন সত্যকথন, মুক্ত বাতাসের খোঁজে ও ইসলামী ব্যাংক এর মত মাস্টারপিস বই। চিন্তাপরাধ তার একমাত্র মৌলিক বই। সংশয়বাদী বইটির অনুবাদ চমৎকার হয়েছে। পড়ে বুঝার উপায় নেই যে এটা অনুবাদ বই।

    ~ হাক্কিকাতজু ও আসিফ আদনানের লেখার ধরণ কাছাকাছি হলেও আসিফ আদনানের লেখায় রয়েছে বিশেষ বৈচিত্র। লেকচারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও ওনার লেখার জুড়ি নেই!

    • প্রচ্ছদ নিয়ে কথা :

    ~মূল বইয়ের চেয়ে অনুবাদকৃত বই এর প্রচ্ছদটা ব্যতিক্রম। সুন্দর কোট-টাই পরিহিত এক ভদ্রলোক কিন্তু তার মাথা খাঁচায় বন্দী। এটা দ্বারা মূলত এটাই বুঝানো হয়েছে যে, বর্তমান তথাকথিত এই মডার্নিটি মানুষকে শেখায় যে ‘তুমি মুক্তচিন্তক’। কিন্তু এই মুক্তচিন্তার নামে মর্ডান এটি মূলত দখল করে নেয় ব্যক্তির মগজকে। তখন ব্যক্তি আর পাশ্চাত্যের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির বাইরে চিন্তা করতে পারে না।
    প্রচ্ছদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে দারুণ সৃজনশীলতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। বিষয়বস্তুর সাথে প্রচ্ছদের রয়েছে চমৎকার মিল।

    • সমালোচনা :

    ~ বইয়ের আলোচনা, বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি শুধু বইয়ের বাইন্ডিং নিয়ে দুইটা কথা বলতে চাই । আমার মতে ১৪ ফর্মার উপরের সকল বইয়ের বাইন্ডিং শক্ত হার্ডকভার হওয়া উচিত। বিশেষ করে এটার মত এমন গুরুত্বপূর্ণ বই এর ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। তাহলে আমরা যারা নিজেদের পাঠাগারের জন্য সংগ্রহ করে রাখতে চাই, বেশি সংখ্যক মানুষকে পড়াতে চাই তাদের জন্য একটু সুবিধা হয় আরকি…।

    || আসুন সংশয়বাদী হই। নিজের মন-মগজ থেকে পাশ্চাত্যের দুর্গন্ধযুক্ত চিন্তা-চেতনাকে ছুড়ে ফেলে প্রস্ন করতে শিখি পাশ্চাত্যকে ||

    °°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°

    বই : সংশয়বাদী
    লেখক : ড্যানিয়েল হাক্কিকাতযু
    অনুবাদক : আসিফ আদনান
    প্রকাশনি : ইলমহাউস পাবলিকেশন
    পৃষ্ঠা : ২৬৬
    নির্ধারিত মূল্য : ২৬০ টাকা

  2. Ashraf Zaman

    Thik bolechen bhai

  3. Arafat Shaheen

    রিভিউ: সংশয়বাদী

    ২০১৯ সালের মার্চে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের নিয়ে বেশ বড় পরিসরে লেখক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আয়োজক কমিটির সঙ্গে কাজ করার সুবাদে দুই বাংলার অনেক বড়ো বড়ো লেখককে একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সে সময় এমন একটি ঘটনার স্বাক্ষী হই, যাতে নিজেকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য হই। একদিন আমি একজন লেখককে (তিনি ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এবং পশ্চিম বাংলার একটি কলেজের অধ্যাপক। সবচেয়ে বড়ো কথা—নাম দেখে তাকে একজন মুসলিম হিসেবেই আমি মনে করেছি) সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর না দিয়ে হুট করেই বলে বসলেন, এই আরবির জন্যই কি তোমরা ভাষা আন্দোলন করেছিলে? এই কথাটি বাংলায় বলা যায় না?

    সালামের জবাবের প্রতীক্ষায় থেকে একজন মুসলিমের কাছ থেকে এমন কথার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ফলে কী জবাব দেবো কিছুই ভেবে বের করতে পারলাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তবে ভেতরে ভেতরে আমার মুসলিম সত্তা ফুঁসে উঠছিল ঠিকই। মহান আল্লাহ যে সিস্টেম সারা দুনিয়ার মুসলিমদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তুমি তার বিরোধিতা করার কে! বিষয়টি নিয়ে পরে অনেক ভেবেছি। এই ভাবনা থেকেই পরবর্তী সময়ে আমি ইসলাম সম্পর্কে গভীরভাবে জানার চেষ্টা করেছি; নিজের শেকড়ের কাছে ফিরে আসার জন্য আকুলতা অনুভব করেছি ব্যাপকভাবে।


    একটা সময় অমুসলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমান সময়ে এসে অনেক মুসলিমই নিজের পরিচয় নিয়ে একধরনের হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। তেমনই একজন মানুষ হলেন আমার আলোচিত ওই ব্যক্তি। শুধু তিনি একা নন—এই সমাজে নিজেকে ‘স্যেকুলার’ হিসেবে পরিচয় দেয়া অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক ধারণা লালন করে থাকে। তাদের মতে—ইসলাম হলো সেকেলে চিন্তাধারা। পনেরো শত বছর আগের চিন্তাধারা এখন কে মেনে নেবে! এ সমস্ত প্রশ্ন কিন্তু আজ মুসলিম সোসাইটির ভেতর থেকেই আসছে। সুতরাং এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়ে যদি অচিরেই তাদের চিন্তার উৎসসমূহ বন্ধ করা না যায়, তাহলে তা মহামারির মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। আর পশ্চিমাদের চিন্তার লেজুড়বৃত্তি করা এসব ‘চিন্তানায়কদের’ যদি যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের চিন্তার অসারতা এবং ইসলামের গৌরবগাঁথা বুঝিয়ে দেয়া না যায়, তাহলে সংকট উত্তরোত্তর বেড়ে যাবে বলেই মনে করি।

    পশ্চিমা মুলুকে জন্ম নেয়া ও সে সমাজকে ভেতর থেকে দেখার ফলে ড্যানিয়েল হাকিকাতযু তার সমস্যাগুলোও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার ফলে সে বিষয়েও তার জানাশোনা তার দশজনের চেয়ে কম নয়। ফলে তিনি যখন পশ্চিমাদের ভণ্ডামি ও মিথ্যাচার নিয়ে কথা বলবেন, তখন তা অবশ্যই মনোযোগ সহকারে শোনার দাবি রাখে।


    ড্যানিয়েল হাকিকাতযু মূলত একজন দ্বায়ী। তিনি বক্তৃতা এবং লেখনীর মাধ্যমে বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যাসমূহ যেমন—নাস্তিকতা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীবাদ, হিজাব, বিজ্ঞানবাদ, লিবারেলিসম, নৈতিকতা ও প্রগতিবাদ, মডার্নিটি, সংস্কারপন্থী ও মডার্নিস্ট মুসলিম, যৌনতা ও যিনা নিয়ে বেশ বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করেছেন। এখানে আমাদের একটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে—এ সমস্ত আলোচনা কোনো ভাসা ভাসা জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়, বরং ইসলামের মৌলিক গ্রন্থসমূহ এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ ঘেটে তবেই লেখা হয়েছে। ‘সংশয়বাদী’ নামের অসাধারণ এই বইটি বাংলায় রূপান্তর করেছেন সাড়া জাগানো ‘চিন্তাপরাধ’ বইয়ের লেখক আসিফ আদনান। সুতরাং এটি যে কোনো কাঁচা হাতের কাজ নয় তা সহজেই অনুমেয়।

    এবার আসুন দেখা নেয়া যাক বইয়ের আলোচ্য বিষয় কী কী।


    নাস্তিকতা:
    মানব সভ্যতার জন্য এই রোগ বহু পুরনো। তবে নাস্তিকতা কখনোই মানুষের ওপর এরকম সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে হাজির হতে পারেনি যেমনটা হয়েছে ‘ফরাসি বিপ্লব’ পরবর্তী সময়ে। তখনই রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করে দিয়ে নাস্তিকতার সয়লাব ঘটানো হয়েছে। ইউরোপীয়রা ‘এনলাইটমেন্ট’-এর নাম নিয়ে মূলত অন্ধকারের দিকেই পতঙ্গের মতো ছুটে চলেছে। তারা এমন এক পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর রয়েছে—যেখানে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু থাকবে না। নাস্তিকরা মনে করে তাদের কোনো বিশ্বাস নেই। কিন্তু প্রকৃত কথা হলো—এই অবিশ্বাসও তাদের একপ্রকার বিশ্বাস; যাকে টিকিয়ে রাখতে তারা যেকোনো ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিতে পিছপা হয় না। নাস্তিকতার মুখোশ উন্মোচন এবং তা থেকে মুসলিমদের ঈমান হেফাজত করার জন্য সাতটি প্রবন্ধ রয়েছে; যা একজন বিশ্বাসীর বিশ্বাসকে আরও পোক্ত করে তুলবে।

    গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা:
    এই দুটি শব্দ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আজকের পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই নিজেদের অতি প্রগতিশীল হিসেবে প্রমাণ করার জন্য পশ্চিমাদের বানানো গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে। মুসলিম জাতির গর্ব করার মতো অতীত থাকার পরও তাদের এই সিস্টেম মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। উসমানী সাম্রাজ্যের পতনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় মুসলিম ভূখণ্ডে, তার সুযোগ নিয়েই পশ্চিমা শক্তি চেপে বসে আমাদের ওপর।
    স্যেকুলার রাষ্ট্র যতই নিজেদের গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বলে প্রচার করুক না কেন, তারা কখনোই নিজেদের বানানো সিস্টেমের বাইরে কিছু সহ্য করে না। নিজেদের সুশীল হিসেবে পরিচয় দেয়া এসব রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু যেন ইসলাম এবং মুসলিম জাতি! বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার দিকে তাকালেই এর সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। এই বিষয়টি নিয়েও দারুণ আলোচনা রয়েছে।

    সাম্য, মুক্তি, স্বাধীনতা:
    এই স্লোগান দিয়েই ইউরোপ থেকে ধর্ম নামক বিষয়টিকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। তারা যে সাম্যের কথা বলে, তা কখনোই নিজেদের সীমানা অতিক্রম করতে পারেনি। তারা যে মুক্তি এবং স্বাধীনতার কথা বলে, তা মূলত ছিল শয়তানের দাসত্বে বন্দী হওয়া। পৃথিবীর সকল দেশে তারা তাদের এই স্লোগানকে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের শয়তানি চক্রান্তকেই শুধু বাস্তবায়ন করে চলেছে। অথচ অনেক অবুঝ মুসলিম তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিগভ্রান্ত হচ্ছে। ইসলাম কখনোই অবাধ স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় না। কিন্তু পশ্চিমা শয়তানেরা ব্যক্তিস্বাধীনতার নাম করে হরহামেশাই আল্লাহর দেয়া সীমানা লঙ্ঘন করছে। ফলে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে বিপর্যয়। কীভাবে একজন মানুষ শয়তানি এই মতবাদ থেকে বের হয়ে আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমানার মধ্যে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পারে, তা এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়।

    নারীবাদ:
    পশ্চিমারা যে মতবাদের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে তা হলো নারীবাদ। সাধারণ অবস্থায় এই মতবাদে তেমন কোনো ঘৃণা উদ্রেককারী বিষয় দেখা না গেলেও বাস্তবে এই মতবাদ মুসলিম জনপদগুলোতে বানের জলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। নারীদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে নামে প্রচারিত হলেও, এই মতবাদ মূলত শেষ পর্যন্ত একজন নারীকে চরমভাবে ধর্মবিদ্বেষী করে তোলে। কারণ, একজন নারীবাদী মনে করে, ধর্ম তার স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। লেখক নারীবাদ বিষয়ক লেখাগুলোতে দেখিয়েছেন একজন মুসলিম নারী কীভাবে চারটি পর্যায় অতিক্রম করে একসময় চরম ইসলামবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। নারীবাদ বিষয়ে এমন গঠনমূলক লেখা এর আগে আমি পড়িনি। পুরো বইয়ের মধ্যে এই অধ্যায়টি আমার কাছে সবচেয়ে চমকপ্রদ মনে হয়েছে।

    হিজাব:
    হিজাব বা পর্দা মুসলিম নারীদের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত পদ্ধতি। কেউ যদি পর্দাকে অস্বীকার করে কিংবা পর্দা নিয়ে কোনো মুসলিম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তাহলে তার ঈমান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। অথচ পশ্চিমা পণ্ডিতদের পাল্লায় পড়ে আজকাল মুসলিম সোসাইটির নারীরা পর্দা বিষয়ে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করা শুরু করেছে। এমনকি অনেকেই প্রকাশ্যে পর্দার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছে। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে—পশ্চিমারা যতই ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলুক না কেন, যে মুসলিম নারী আল্লাহর ইচ্ছা মেনে পর্দা করেন, তাকে তারা সেকেলে বলে তাচ্ছিল্য করে। কী ডাবলস্ট্যান্ডার্ড! সুতরাং পর্দা নিয়ে নাস্তিকরা যে-সকল প্রশ্ন করে থাকে, তার যৌক্তিক জবাব এই অধ্যায়ে পাওয়া যাবে।

    বিজ্ঞানবাদ:
    বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আজকাল কিছু পণ্ডিত ইসলমাকে বাতিল ঘোষণা করতে চায়। অনেক মুসলিম এজন্য বিজ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাদের সাথে আপোষ করতে চায়। কিন্তু একথা কিছুতেই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে—বিজ্ঞান ক্ষণে ক্ষণে তার রং পাল্টায়। আজকের প্রতিষ্ঠিত থিওরি আগামীকাল বাতিল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর বাণী অকাট্য; তাতে কোনো ভুল কিংবা পরিবর্তনের সামান্যতম সুযোগ নেই। এই বিষয়গুলো লেখক দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

    লিবারেলিসম, নৈতিকতা ও প্রগতিবাদ:
    পশ্চিমা দর্শনে বলা হচ্ছে, আমার কাজে যদি কারো ক্ষতি না হয়, তাহলে তা আমি সানন্দে করতে পারি। ফলে তারা নিজস্ব চিন্তায় নৈতিকতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে নিয়েছে। নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভেবে বাকি দুনিয়ার মানুষকে নিচু শ্রেণি মনে করছে তারা। ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীর যে-কোনো দেশে হামলা করার বৈধতা পেয়ে গেছে যেন! উন্নতি এবং প্রগতির নামে তারা এমন মতাদর্শ পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছে, যার বিষে একেবারে নীল হয়ে যাচ্ছে বাদবাকি দুনিয়া। এই সংকটকে মোকাবিলা করার পন্থা পাওয়া যাবে এই অধ্যায়দ্বয়ে।

    সংস্কারপন্থী ও মডার্নিস্ট মুসলিম:
    ইউরোপ-আমেরিকার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ না হওয়ায় আজকাল অনেক মুসলিম ইসলামে সংস্কারের কথা বলা শুরু করেছে। তারা এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলছে, যেগুলো সংস্কার কিংবা সামান্য পরিবর্তন করা হলেও ইসলাম তার মূল থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়বে। তাদের মতে—পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ইসলামকে বিচার করতে হবে। তারা যেটা ভালো বলবে সেটা ভালো, আর খারাপ বললে তা খারাপ। কিন্তু কখনো তারা এই প্রশ্ন নিজেকে করে না যে— আমাদের কাছে পবিত্র কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী থাকার পরও কেন আমরা অন্যের দারস্থ হবো? বর্তমান সময়ে ছড়িয়ে পড়া এই ভয়াবহ ফিতনা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রয়েছে বইয়ে।

    যৌনতা ও যিনা:
    পশ্চিমা জগত আজ অবাধ যৌনাচারে আক্রান্ত। এই বিষয়ে তারা যেন একেবারে লাগানহীন হয়ে পড়েছে! ফলে তাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে অন্তহীন সমস্যা। ইসলামের সুনির্দিষ্ট যৌনতা বিষয়ক শিক্ষা থাকলেও আজকাল সুকৌশলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌনশিক্ষার নামে বেহায়াপনার বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সয়লাব রুখতে হলে সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

    সংশয়বাদী:
    এই অধ্যায়ের নামেই বইটির নামকরণ। সুতরাং এটি যে এই বইয়ের সারনির্যাস তা সহজেই অনুমেয়। আজ পশ্চিমা সভ্যতা ইসলামি জীবনব্যবস্থার ওপর আক্রমণাত্মক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে; আর আমরা—মুসলিম জনপদ শুধু তাদের সে আক্রমণ ঠেকাতেই ব্যস্ত রয়েছি। কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন চলা যাবে না। তাহলে উপায় কী?
    হ্যাঁ, উপায় অবশ্যই আছে। আর সেটা হলো—রক্ষণশীলতার খোলস ছুঁড়ে ফেলে আমাদের আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তারা যে সকল মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেগুলোর বিরুদ্ধে সংশয় প্রকাশ করতে হবে। তাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে হবে—কেন তোমাদের এই মতবাদ শ্রেষ্ঠ? তাদের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে বিশ্ববাসীর সামনে। তারা যেমন ইসলাম বিষয়ে সংশয়বাদী, তেমনি আমাদেরও পশ্চিমা দর্শনের বিরুদ্ধে খাঁটি সংশয়বাদী হয়ে উঠতে হবে।


    এতক্ষণ আমরা বইয়ের আলোচ্য বিষয়গুলো তুলে ধরলাম। এখন অনুবাদ নিয়ে কয়েকটি কথা বলছি। বইটির অনুবাদ করেছেন সুলেখক আসিফ আদনান। তার জানাশোনার পরিধি উপলব্ধি করেছি ‘চিন্তাপরাধ’ পড়তে গিয়ে। এবার তাকে অনুবাদক হিসেবেও চিনে নেয়ার সুযোগ হলো। অনেকেই অভিযোগ করেছেন—অনুবাদ কঠিন হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে একদমই সেরকম মনে হয়নি। বরং এরকম ভারি বিষয়ের অনুবাদ যেমন ধীরস্থির হওয়া প্রয়োজন সেরকমই হয়েছে। তবে বইটি পড়া সময় অবশ্যই কিছু পরিভাষা যেমন—মডার্নিটি, মেটাফিযিক্স, সেক্যুলারিসম, লিবারেলিসম, নায়ালিসম এরকম আরও কিছু শব্দের সঙ্গে পরিপূর্ণরূপে পরিচিত থাকতে হয়। তা নাহলে একটু কঠিন মনে হতেই পারে। এই বইটি পাঠকদের বহুদিন সংরক্ষণ করতে হবে নিঃসন্দেহে। তাই বইটি পেপারব্যাক না হয়ে হার্ডকাভার হলে ভালো হতে।

    অবশেষে বইটি সম্পর্কে এককথায় অনুবাদক আসিফ আদনানের ভাষায় বলছি, ‘ইসলাম ও আধুনিকতার ওয়ার্ল্ডভিউয়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের প্রকৃতি ও বাস্তবতা সম্পর্কে দুঃখজনকভাবে আমাদের মধ্যে আজও অনেক বিভ্রান্তি কাজ করে। এখানে যে আদৌ কোনো দ্বন্দ্ব আছে সেটাই অনেকে বোঝেন না বা বুঝতে চান না। পশ্চিমা লিবারেল ক্রুসেইডের মোকাবিলার জন্য এই দুই ওয়ার্ল্ডভিউয়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের বাস্তবতা উপলব্ধি করা এবং এই লড়াইয়ের উপযুক্ত কৌশল বেছে নেয়া অত্যন্ত জরুরি। আমি আশা করি ‘সংশয়বাদী’ এ ক্ষেত্রে সহায়ক হবে, বিইযনিল্লাহ।’

  4. Amit Hasan

    ■ শুরুর কথা-

    “সংশয়বাদী” এর সরল অর্থ করলে যা বোঝায় যে কোনো কিছু নিয়ে সংশয়ে আছে কোনটি সঠিক বা বেঠিক সেটি নিয়ে সে দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে। প্রকৃত মুসলিম কখনও তার অন্তরে ধর্মকেন্দ্রিক কোনো সংশয়কে আশ্রয় দিতে পারে না। কারণ একজন প্রকৃত মুসলিমের অন্তর হবে ওহীর নূর দ্বারা পরিপূর্ণ। তাই সেই অন্তরে কোনো সংশয় স্হান পেতে পারে না। অথচ আজকের মুসলিম সমাজে এর উল্টো প্রতিবিম্ব প্রতীয়মান। কারণ ভিনদেশী মতবাদের ছোঁবলে আসক্ত সমাজের প্রতিটি রন্ধ্র। ইসলামি মতবাদ ভুলে আমরা আজ লিবারেল ও সেকুল্যারিস্টদের মতবাদের স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে আমরা মূল ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আজ এসকল মতবাদে বুঁদ হয়ে ইসলাম থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। তাদের মস্তিষ্কে চিন্তা চেতনায় সংশয় কাজ করছে যে কোনটি সঠিক মতাদর্শ? আমরা যদি সেই মতবাদগুলোর স্রোতে হারিয়ে যেতে না চাই তাহলে আমাদের উচিত সেই মতবাদ গুলোকে ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ করা। যাতে আমরা কোনো সংশয়ে পতিত না হই। এই কাজটি সহজ করে দিয়েছেন ড্যানিয়েল হাকিকাতজু তার “The Modernist Menace To Islam” বইটিতে। যার বাংলা অনুবাদ”সংশয়বাদী”

    ■ বইটির বিষয়বস্তু-

    মূল বইটি ১৩ টি অধ্যায়ে সুসজ্জিত। প্রতিটি অধ্যায় আবার সুনির্দিষ্ট পরিচ্ছদে বিভক্ত।

    ▪ প্রথম অধ্যায়: এই অধ্যায়ে নাস্তিকতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। নাস্তিকদের মতাদর্শ লিবারেল-সেকুল্যারিস্ট, তাদের সব কর্তৃত্ববাদী আচরণ, তাদের উদ্ভাবিত সকল দর্শন ইসলামের আলোকে মূল্যায়িত করা হয়েছে, বিজ্ঞানকে ভালোবাসার মাধ্যমে স্রষ্টার ভালোবাসাকে যে অবমাননা করা হয় তা উঠে এসেছে। স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণে তাদের সৃষ্ট এম্পিরিসিসম নীতিকে ভুল প্রমাণ করেছেন। নাস্তিক্যবাদের সমূলে আঘাত করা হয়েছে।

    ▪দ্বিতীয় অধ্যায়: এই অধ্যায়ে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেকুল্যারিজম যে নিরপেক্ষ নয় বরং তারা নিজেরা বস্তুবাদী আইন তৈরি করে ইসলামের আইনগুলোকে বর্বর প্রমাণ করতে চায় এবং তা মুসলিমদের মস্তিষ্কে বিষিয়ে দিতে চায়। লেখক দেখিয়েছেন স্বৈরাচারী শাসকরা কিভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে উসকে দিয়ে শরীয়াহকে প্রতিস্থাপিত করতে চায়। এছাড়া গণতন্ত্র ও ইসলামী শাসন কোনটি উওম অনুত্তম তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন যুক্তির মাধ্যমে।

    ▪তৃতীয় অধ্যায়- এই অধ্যায়ে উঠে এসেছে ধর্মীয় শিক্ষা ও সেকুল্যার শিক্ষার পার্থক্য, বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতাকে কেন সম্মান করে না? ইসলামের ইনসাফভিত্তিক সাম্যতা, ইসলাম কি স্বাধীনতার ধর্ম কিনা। আমাদের কি ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সমর্থন করা উচিত কিনা? শরীয়াহসম্মত বাকস্বাধীনতা।

    ▪চতুর্থ অধ্যায়: সেকুল্যারিস্টদের গড়ে উঠা ফেমিনিজম তথা নারীবাদ, তা কিভাবে ধাপে ধাপে ধর্ম বিদ্বেষ গড়ে তুলছে যার ফলাফল নারীদের ইসলাম ত্যাগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইসলামে নারী ও মাতৃত্বের মর্যাদা, নারীবাদের সমালোচনার সঠিক পন্থা, পুরুষতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক গুলোরও মূলোৎপাটন করা হয়েছে এ অধ্যায়ে।

    ▪পঞ্চম অধ্যায়: সেকুল্যারিস্টদের কাছে হিজাবের আইন শোষণ কেন? তার উত্তর লেখক ইসলামী শরিয়াহর আলোকে আলোকপাত করেছেন। নারীবাদ ও হিজাবের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের পরিচয় তুলে ধরেছেন। হিজাব ও নারীর ক্ষমতায়নে ফেমিনিস্টদের ভ্রান্তি গুলোকে অপনোদন করেছেন। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বন্ধে হিজাবের আদৌ কোনো কার্যকরী ভূমিকা আছে কি নেই? তার যুক্তি খন্ডন করা হয়েছে।

    ▪ষষ্ঠ অধ্যায়: কুরআনের বৈজ্ঞানিক বিস্ময়, বিজ্ঞানের বাস্তবতা, ইসলামের সাথে বিজ্ঞানের সাংঘর্ষিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।

    ▪সপ্তম অধ্যায়: লিবারেলিসমের ও সেকুল্যারিস্টদের মতাদর্শের নৈতিক অগ্রগতি, এর সহিষ্ণুতা, এদের ভন্ডামির অপনোদন করেছেন। যাতে একজন মুসলিম সংশয়ে পতিত না হয়।

    ▪অষ্টম অধ্যায়: নৈতিকতা প্রতিটি ধর্মেই একটি মূল বিষয়বস্তু। লিবারেল ও সেকুল্যারিস্টদের দর্শনে নৈতিকতার সাথে তাদের সৃষ্ট প্রগতিবাদের অসাড়তা এবং তাদের সৃষ্ট প্রগতিবাদ যে ইসলাম পূর্ব অপশক্তির সৃষ্ট তা প্রতীয়মান। জ্ঞানের ধারণার সাথে আধুনিক মতবাদ ও ট্র্যাডিশনের পার্থক্য ইসলামের আলোকে মূল্যায়িত করা হয়েছে। সত্যিকারের মুক্তচিন্তকের বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতার সঠিক পথনির্দেশনা সহ ভালো মানুষ হতে ধর্মীয় মূল্যবোধ কতটুকু কার্যকর তা লেখক তুলে ধরেছেন।

    ▪নবম অধ্যায়: মডার্নিটি তথা আধুনিকতাবাদের শাখা সমূহ এর বৈশিষ্ট্য সমূহ এর সাথে ট্র্যাডিশনের বিরোধিতা এই অধ্যায়ে উঠে এসেছে। ইসলামের সাথে আধুনিকতাবাদের সংঘাত এবং সেই সংঘাতের ফলাফল পেশ করেছেন। নববী যুগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।

    ▪দশম অধ্যায়: এই অধ্যায়ে লেখক একজন ট্র্যাডিশনাল মুসলিম ও আধুনিকতাবাদী মুসলিমের বৈশিষ্ট্য বা পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। কমিউনিস্ট ইসলামের ব্যর্থতা তা থেকে আমাদের শিক্ষা, মুসলিম বিশ্বকে পশ্চিমা বিশ্ব কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে? মুসলিম বিশ্বের পশ্চাৎপদের কারণ ইসলাম কিনা তা বিশ্লেষণ করেছেন।

    ▪একাদশ অধ্যায়: যৌনতা যেন আজ এক সহজলভ্য পণ্য হয়ে উঠেছে। আর এর কারণ আজকের পশ্চিমা বিশ্বের যৌন দুর্দশা যা তারা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যৌনতার ব্যাপারে ইসলামী মূল্যবোধ লিবারেল সেকুল্যারিস্টদের থেকে কেন যৌক্তিক ও নৈতিক ভাবে শ্রেষ্ঠতর তা লেখক প্রমাণ করেছেন। যৌন শিক্ষার উদ্দেশ্য, ইখতিলাত তথা নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলাফল ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে খন্ডন করেছেন। সর্বশেষে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা কেন যৌনতাকে বেশি প্রাধান্য দেয় তার কারণ সমূহ ব্যক্ত করেছেন।

    ▪দ্বাদশ অধ্যায়: নাস্তিকরা উত্থাপন করে ইসলাম তলোয়ারের মাধ্যমে প্রচার হয়েছে। আদৌ কি তাই? একজন মুসলিম সংশয়বাদীর মনে ও তা গভীর দাগ ফেলতে পারে। এই অধ্যায়ে লেখক জেনেভা কনভেনশান, সর্বজনীন মানবাধিকার ও প্রথম বিশ্ববাদের আলোকে তাদের উত্থাপিত প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্ব সমকামিতাকে আজ মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে যেসব নীলনকশা হাতে নিয়েছে তা তুলে ধরেছেন।

    ▪ত্রয়োদশ অধ্যায়: বইটির সর্বশেষ অধ্যায়ে আজকের মুসলিম উম্মাহর অবস্থান কেন দূর্বল, এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে করণীয়সমূহ, আধুনিকতার মাঝে ইসলামকে বোঝার উপায় কি? মুসলিম সংশয়বাদী হওয়ার অর্থ কি? বিষয়গুলো ব্যক্ত করেছেন। পরিশেষে, একজন মুসলিম সংশয়বাদীর জবানবন্দী দিয়ে বইটির ইতি টানা হয়েছে।

    ■ পাঠ পরবর্তী পর্যালোচনা-

    ▪বইটির প্রতিটি পাতায় লেখক নাস্তিক্যবাদ ও তাদের সৃষ্ট মতাদর্শের অপনোদন করেছেন এবং তাদের প্রতি আরো প্রশ্নের বান ছুড়ে মেরেছেন। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার কাছে বইটি চমৎকার লেগেছে। বইটি পাঠ শেষে পাঠক বা পাঠিকা নিজেদের মধ্যে থাকা অনেক সংশয়কে ছুড়ে ফেলতে পারবেন আশা করা যায়। মুসলিম সংশয়বাদীদের অন্তরে একটু হলেও গভীর প্রভাব বিস্তার করবে যে ইসলামই সঠিক,যৌক্তিক মতাদর্শ। লিবারেল সেকুল্যারিস্টদের মতাদর্শের সাথে ইসলামী মূল্যবোধের মূল্যায়ন করতে পারবেন। বইটি পাঠের সময় কিছু পরিভাষা জটিল মনে হলেও অনুবাদক সেগুলো টীকা আকারে ব্যাখ্যা করেছেন যার ফলে পঠনে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। অনুবাদ যথেষ্ট সরল ও প্রাঞ্জল মনে হয়েছে। বইটির বিষয়বস্তুর সাথে বইটির প্রচ্ছদটি মানানসই হয়েছে বলে মনে হয়েছে।

    ▪বইটিতে মুদ্রণজনিত কিছু বানান ভুল পরিলক্ষিত হয়েছে। সূচিপত্রের সাথে বইটির মধ্যকার শিরোনাম গুলোতে সামান্য অমিল রয়ে গেছে পরবর্তী সংস্করণে আশা করি এ বিষয়গুলো পরিশোধন করা হবে। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বইটি হার্ডকভারে হলে আরও দৃষ্টিনন্দন হতো পড়তে ও সংরক্ষণে আরো সহজবোধ্য হতো।

    ■ বইটির প্রয়োজনীয়তা-

    বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বইটি পাঠের মাধ্যমে একজন পাঠক বা পাঠিকা জানতে পারবে-

    ১৷ নাস্তিকতার স্বরূপ তাদের সৃষ্ট বিভিন্ন মতাদর্শ।

    ২৷ লিবারেল সেকুল্যারিস্টরা কিভাবে সেই মতাদর্শ গুলো আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে?

    ৩৷ তাদের সৃষ্ট মতাদর্শ গুলো কিভাবে মুসলিমদেরকে সংশয়বাদী করছে আর এই সংশয়বাদীর ফলাফলই বা কি হচ্ছে? বা ভবিষ্যতে কি হবে?

    ৪৷ সর্বশেষে, তাদের সৃষ্ট প্রতিটি দর্শনকে আমরা কিভাবে ইসলামী মূল্যবোধের সাহায্যে ছেদন বা মোকাবেলা করতে পারি। কিভাবে তাদের উত্থাপিত প্রশ্নের বিপরীতে তাদেরকে প্রশ্নের জালে জর্জরিত করতে পারি?

    ■ শেষ কথা-

    আধুনিকতাবাদ কখনোই কোনোদিন ইসলামের সমুন্নত মর্যাদাকে ছোট করতে পারবে না। ইসলাম সব সময়ই তাঁর সমুন্নত অবস্থানে অধিষ্ঠিত থাকবে। তাই একজন মুসলিমের ও উচিত সর্বদা সমুন্নত ইসলামের সাথে তাল মিলিয়ে চলা কোনো বস্তুবাদী আদর্শের সাথে নয়?

    “যা তোমার পালনকর্তা বলেন তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হয়ো না।”[১]

    ▪রেফারেন্স:
    ১. সূরা আলে ইমরান- ৬০

    ■ বই বৃত্তান্ত-

    ▪নাম- সংশয়বাদী
    ▪লেখক- ড্যানিয়েল হাকিকাতজু
    ▪অনুবাদ- আসিফ আদনান
    ▪বিষয়- অন্ধকার থেকে আলোতে
    ▪কভার- পেপারব্যাক
    ▪পৃষ্ঠা-২৬৬
    ▪প্রচ্ছদ মূল্য-২৬০৳
    ▪প্রকাশনী- ইলমহাউজ পাবলিকেশন

  5. মুহাম্মদ রুবেল মিয়া

    বইয়ের নাম : The modernist menace to islam
    অনূদিত নাম : সংশয়বাদী
    লেখক : ড্যানিয়েল হাকিকাতজু
    অনুবাদক : আসিফ আদনান
    প্রকাশনায় : ইলমহাউজ পাবলিকেশন
    পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৬৬
    নির্ধারিত মূল্য: ২৬০ টাকা
    বাইন্ডিং: পেপারব্যাক

    সংশয়বাদী, শুনেই অনেকে হয়তো ভাবছেন স্রষ্টায় অবিশ্বাসী কাউকে বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু না, এখানে স্রষ্টায় অবিশ্বাস করে এমন কাউকে বুঝানো হয়নি! বরং ওই সকল মুসলমানকে বুঝানো হয়েছে, যারা পাশ্চাত্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এবং সেই সংশয়ের পক্ষে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেন। বর্তমানে নাস্তিক্যবাদ, পাশ্চাত্যবাদ মোকাবেলার কৈফিয়তমূলক যে ট্রেন্ড চালু হয়েছে “সংশয়বাদী” বইয়ের লেখক সে দিকে চালিত হননি। বরং তিনি পাশ্চাত্যের বিশ্বাস, জীবনবোধ, কালচার নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। শুধু কি প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত দিয়েছেন? না, সেই সাথে সংশয়ের পক্ষে দলিল-প্রমাণও উপস্থাপন করেছেন। এজন্যই বইয়ের নাম রাখা হয়েছে “সংশয়বাদী”।

    বইয়ের আলোচ্যবিষয় :
    বইটি মূলত ড্যানিয়েল হাকিকাতজুর বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে রচিত কিছু আর্টিকেলের সমষ্টি। যা অনুবাদ করেছেন সময়ের আলোচিত ও আলোকিত মুখ আসিফ আদনান। ইসলাম ও বাস্তবতার আতশি কাঁচের নিচে ফেলে উনারা পাশ্চাত্যকে বিচার করেছেন। পাশ্চাত্যের মতবাদগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। বর্তমান বিশ্বের মুসলিম যুবক-যুবতিদের দেখাতে চেয়েছেন যেই পাশ্চাত্যকে তোমরা অনুসরণ করছো, পাশ্চাত্যের যেসকল মতবাদ নিয়ে লম্ফঝম্প করছো এগুলোর আসল রূপ এবং বাস্তবতা দেখে নাও। বইটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের এ যুগে মুসলিম যুবক-যুবতিদের পাশ্চাত্যের ছোবল থেকে রক্ষা করতে বদ্ধ পরিকর।

    বিশ্লেষণ :
    ইদানীং পাশ্চাত্য এবং পাশ্চাত্যের তৈরি করা মতবাদগুলোর বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। এই বিপ্লবের পিছনে সবচেয়ে বড়ো অবদান দায়ী এবং লেখকদের। যদিও তাদের আলোচনাটা কৈফিয়তমূলকই হয়ে থাকে। কিন্তু আত্মসম্ভ্রমবোধসম্পন্ন মুসলিমরা এতেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ড্যানিয়েল হাকিকাতজু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি কৈফিয়তমূলক নয়, বরং আক্রমণামক ভঙ্গিতে পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্যের তৈরি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুধীতা করেছেন। শুধু তা-ই নয়। অন্যান্য লেখক এবং দায়ীরা আলোচনা করতে গিয়ে আলোচনার এতোটাই গভীরে প্রবেশ করেন যে, সাধারণ পাঠকরা আলোচনা ধরতে না পেরে খেই হারিয়ে ফেলেন। হাকিকাতজু এখানে ব্যতিক্রম। তিনি আলোচনাকে যথাসম্ভব বোধগম্যতার মধ্যে রেখেই পাশ্চাত্যকে বিশ্লেষণ করেছেন। পাশাপাশি তাঁর আলোচনা ছিলো সরল এবং শ্রুতিমধুর। ফলে সাধারণ পাঠকদের জন্য বইয়ের আলোচনা বুঝা সহজবোধ্য হয়েছে।
    সেই সাথে অনুবাদক বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত ফুটনোট উপস্থাপন করেছেন, কিছু অপ্রয়োজনীয় আলোচনা বাদ দিয়েছেন এবং বিষয়বস্তুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু আলোচনা যুক্ত করেছেন, যেনো পাঠকের জন্য আলোচনা বুঝা সহজ হয়।
    আরো একটি বিষয় যা না বললেই নয়। বইটি যেহেতু লেখকের বিভিন্ন সময়ে লিখিত প্রবন্ধ সংকলন, তাই এক আলোচনার সাথে অন্য আলোচনার কোনো যোগসূত্র নেই। ফলে কোনো পাঠক বইয়ের যেকোনো একটি পাঠ নিয়ে পড়তে বসে যেতে পারেন। এতে আলোচনা বুঝতে আপনার কোনো সমস্যা হবে না।

    প্রয়োজনীয়তা :
    বর্তমান মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকিয়ে বইটিকে খুবই সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ বলাই যায়। একসময় বলা হতো বৃটিশদের ভূমিতে সূর্য কখনো ডুবে না। এর দ্বারা তাদের আগ্রাসনের ব্যপকতা তুলে ধরা হতো। সময়ের পরিবর্তন ঘটে। একসময় আগ্রাসনকারী উপনিবেশবাদীরা ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু রেখে যায় তাদের ধ্যান-ধারণা আর মতবাদ। বর্তমান পৃথিবী সরাসরি তাদের আগ্রাসনের শিকার না হলেও তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন কিন্তু চলমান আছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত মতবাদ ও তাদের সংস্কৃতির দখলদারিত্বের মাধ্যমে। আরো একটি কারণ অবশ্য আছে, তা হলো ইসলাম সম্পর্কে মুসলিমদের অজ্ঞানতা আর উদাসীনতা।
    পশ্চিমারা তাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি কার্যকর রেখেছে তাদের বিভাজন নীতি আর মতবাদগুলোর মাধ্যমে। তাঁরা মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের নামে মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন দল-উপদলের সৃষ্টি করে দিয়েছে, যারা নিজেদের মধ্যেই মারামারি, দলাদলি,কথা-কাটাকাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফলে তাঁরা তাদের মূল দুশমনকে চিনতে পারে না। তেমনি আরো একটা বড়ো অংশ তাদের প্রতিষ্ঠিত মতবাদগুলো প্রচার ও প্রসারে কাজ করে। কিন্তু এগুলো কতোটা ইসলাম সম্মত সে সম্পর্কে তাদের কারো জানা নেই।

    লেখক হাকিকাতজু “সংশয়বাদী” বইয়ে সেগুলোরই আলোচনা করেছেন। ইসলাম এবং বাস্তবতার আলোকে পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত এসব মতবাদের অসারতা তুলে ধরেছেন। যেনো মুসলিমরা এগুলো থেকে বেঁচে থাকে। এগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক এবং সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকে ব্যবস্থা নেয়। সর্বোপরি আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনুপ্রাণিত হয়।

  6. Ruponti Shahrin

    এক নজরে বই :
    বই : সংশয়বাদী
    মূল : ড্যানিয়েল হাকিকাতযু
    অনুবাদ : আসিফ আদনান

    আস সালামু আলাইকুম।
    প্রিয় সংশয়বাদী।
    একটু অবাক হলেন, তাই না? মুসলিম হয়েও আপনার কি সংশয়বাদী হতে ইচ্ছে করে না? চারিদিকে নাস্তিক, সেক্যুলার, লিবারেল সংশয়বাদীদের দখলে যখন এত এত প্রশ্ন তখন তাদের দিকে বিজ্ঞের মত কিছু প্রশ্ন তো আপনারও ছুড়ে দিতে ইচ্ছে হওয়ারই কথা। হয় না। কারণ, ভয় হয়। যদি তেড়ে আসে। আসেই তো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয় হয়, আমরা আসল ইতিহাসটাই জানি না। জানি না কোন পর্যায়ের সংশয়বাদী হওয়া আমাদের কর্ম।
    ১৯২৪ সাল। ঔপনিবেশিকদের আক্রমণ শুরু ইসলামী জ্ঞানের ভাষা আরবী, ইসলামী পোশাক, পারিবারিক কাঠামোর উপর। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও আলিমদের নিশানা বানিয়ে অর্থের উৎসগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু এর পেছনের কারণ কী? এত আক্রোস কিসে? আরেকটু পেছনের দিকে যাই। সেক্যুলারিসমের উদ্ভব। ইতিহাসটাও অন্যরকম। এবার আর ইসলাম নয়। খোদ খ্রিস্টানদের ভেতরেই দ্বন্দ্ব। সময়টা ১৭৯৪। ইস্টার আসতে আসতেই ফ্রান্সের ৪০,০০০ এর বেশি গীর্জা বন্ধ করে দেয়া হয়। উদযাপিত হয় ঢালাও হত্যা। ক্রুশ আর পানপাত্র ভেঙ্গে নান ও পাদরিদের রক্তের বন্যায় নতুন এক যাত্রার সূচনা হয়। সেটাই সেক্যুলারিসম।
    এই ঔপনিবেশিকদের উদ্দেশ্য ছিল দুটিঃ
    ১) মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ অর্জন।
    ২) সপ্তম শতাব্দীতে আটকে থাকা বর্বর
    মুসলিমদের আধুনিকতা ও প্রগতির আলোতে নিয়ে আসা।
    পুরো বইটি জুড়ে সে কথাই বলছিলেন ড্যানিয়েল হাকিকাতযু। আর তার কঠিন, গুরুগম্ভীর ও অন্তরে ঝংকার তোলা শব্দচয়নে, মন-মস্তিস্কে আলোড়ন সৃষ্টি করার মতো সেরা কাজটি দেখিয়েছেন অনুবাদক আসিফ আদনান। এত কঠিন শব্দবহুল ও বিষয়বস্তুর আলোচনা তিনি ও সম্পাদনা টীমের অক্লাস্ত পরিশ্রমের ফসল পুরো বইটি পড়লেই বোঝা যায়। তাহলে মূল কথায় আসা যাক। আমি খুব সংক্ষেপে বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো। কারণ, ইতিমধ্যে যারা বইটি পড়েছেন, তারা জানেন। আর যারা পড়েননি আশা করি রিভিউয়ের পর না পড়ে থাকতেই পারবেন না। একনিষ্ঠ মুসলিম হলে ভবিষ্যতে পালটা জবাবের বেলায় বেকার বসে থাকতে না চাইলে, বইটি আপনাকে পড়তেই হবে। এরপরেই বিশ্লেষণে একটু বেশি সময় আলোচনা করবো।
    সংশয়বাদীরা মূলত তিন প্রকার।
    ১) নাস্তিক, লিবারেল, সেক্যুলার বা অন্য ধর্মের যাদের প্রশ্নই মূলত ইসলামের বিরোধিতা করা।
    ২) আর এমন কিছু মুসলিম যারা আধুনিকতার লেবাস পড়া মানুষের কথার মারপ্যাঁচে পড়ে ভুলতে বসেছেন ইসলাম আসলে কোন কোন বিষয় সাপোর্ট করে।
    ৩) যোগ্য মুসলিম, যারা সংশয়বাদীদের সংশয় নিরসনে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারেন। সাচ্চা মুসলিমরা কেন সংশয়বাদী হতে যাবেন? এখানেই তো টুইস্ট!
    বইয়ের বিষয়বস্তুঃ
    আধুনিকতা ও ইসলামের মধ্যে মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। যাকে বলা হয় Worldview বা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী। এটি আমাদের চিন্তার ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এমন মাধ্যম যা ঠিক করে দেয় বাস্তবতাকে আমরা কীভাবে দেখবো। সহজ করে বলছি। উপস্থাপনার পার্থক্যের জন্য প্রত্যেক শব্দের ভিন্ন অর্থ আছে। সেগুলো নিরুপণের জন্য সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও দর্শনের কিছু নির্দিষ্ট উত্তর এবং মাপকাঠি থাকে। এগুলো নিয়েই তার Worldview গঠন করা হয়।
    অপরদিকে ইসলামের Worldview স্বতন্ত্র, সত্য, সর্বজনীন এবং অপরিবর্তনীয়। আল্লাহর একত্ববাদ, রাসুলের(সা) রিসালাহ এবং ওয়াহির (কুরআন, সুন্নাহ) আলোকে ইসলাম তার Worldview প্রণয়ণ করে, যা আধুনিকবিশ্ব অস্বীকার করে। সংঘাত এখানেই। কিন্তু এখানেই কি শেষ? মোটেও না। পর্যালোচনা করলেই মূল প্রেক্ষাপট বুঝতে পারবেন কেন আপনাকে সংশয়বাদী হতে আহবান করা হচ্ছে।
    পাঠ পর্যালোচনা ও মতামতঃ
    দাবার চালের মত বারবার উলটে পালটে যায় তাদের মতামত। যেন সব প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই প্রস্তুত করা। মহা সংশয় তো সেখানেই। তাদের মত করে ইসলাম পরিচালিত হলে বেশ। নয়তো আউট। কারণ, ইসলাম ন্যায়নীতির কথা বলে। অপরিবর্তনশীল একটি ধর্মের আগাগোড়াই এমন এক ছাঁচে গড়া যা মুসলিম তথা এর আন্ডারে থাকা মানুষগুলো মানতে বাধ্য। যখন প্রশ্ন উঠে ইসলাম কি বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, যৌন স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়?-সেক্যুলাররা এমন প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু মুসলিম হয়েও একদল লোক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। হয় ইসলামকে আধুনিকতায় মোড়াতে চান, নতুবা আধুনিকতাকে ইসলামের মত করে দেখাতে চান। নিজে বনে যান মডারেট। এভাবে চলতে থাকলে নামকা ওয়াস্তে মুসলিম ছাড়া রাসুল (সা) এর দেখানো পথের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
    বইটিতে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে। লেখক হাকিকাতযু মূলত যুক্তিখন্ডন করেছেন সে সকল উত্থাপিত প্রশ্নের যা ধর্মের ভিতকে আঘাত করে। সৃষ্টিজগতে এমন প্রশ্নের সম্মুখিন করে যা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে তার দেয়া বিধিবিধানকে পাশ কাটিয়ে যায়। বলতে গেলে একপ্রকার কেয়ার করেই না। হঠাৎ করে শুরু হওয়া নিখিল বিশ্বের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীও অবজ্ঞা করে বসেন গন্তব্যকে। কোথা থেকে এলাম আমরা, আর কোথায় বা যাচ্ছি? এর শেষ কোথায়? এমন সব প্রশ্ন উঠে এলেই কিছু আপ্ত বাক্য বিনিময়। ব্যাস! জোর চাপিয়ে দেন তাদের শাসন।
    আস্তিকতার অভাব ঘটলেই বা সৃষ্টিকর্তাতে বিশ্বাস না থাকলেই যে তিনি নাস্তিক এমনটি নয়। লেখক লিবারেল+ সেক্যুলারিস্টকে পরিষ্কারভাবে দাড় করিয়েছেন যে নাস্তিকতারও একটি ধর্ম রয়েছে। স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ বহণ করে এসব চিন্তার খোরাক আমাদের চারপাশেই রয়েছে। আমরাই গো ধরে রয়েছি। যেন দেখেও না দেখার ভান করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
    সেক্যুলারিসম আসলে ধর্ম নিরপেক্ষতা নয়, বরং ভিন্নমতের দমন। নিছক এক কথার খেলা। জার্মানিতে হিজাব বয়কট করার প্রেক্ষিতে যারা জাজ ছিলেন, তাদের পোশাকের ইতিহাস জানলে যেকোনো পাঠক হেসে ফেলবেন। ঠিক সব কথারই তো শেষ কথা থাকে। ধর্মীয় স্বাধীনতা আসলে কী, কারা দিচ্ছেন বা কোথায় পাওয়া যায়, এগুলো নিয়ে আলোচনা করলে পুঁতির দানা গাঁথতে গাঁথতে একটি মালা হয়ে যাবে। যেখানে গণতন্ত্র নাকি ইসলামের শরীয়াহ আইন উত্তম তার দীঘল ব্যাখ্যার পর ইসলামবিরোধীরা লেজ গুটিয়ে পালাবেন।
    কোথায় সাম্য, কোথায় মুক্তি, কোথায় তবে স্বাধীনতা?
    একপক্ষ মনে করেন একদম লোক কী পুরানো যমানার কল্পকাহিনী নিয়ে ব্যস্ত। কোথায় আধুনিকতার মোড়কে নিজেকে জড়িয়ে সাম্য, মুক্তি স্বাধীনতা খুঁজে নেবে। তা না। এটা না হয় ওরা ভাবে। কিন্তু একজন মুসলিম কি জানে ইসলাম স্বাধীনতার ধর্ম কি না? সমতা বা বাকস্বাধীনতার গন্ডী কতখানি? না জানলে লিবারেলিসম, জাতি রাষ্ট্রের প্যারাডাইম, বিজ্ঞানের মতবাদ,
    মানবতাবাদ, নারীবাদ, প্রগতিবাদ্দের মতো মডার্নিশট বিশ্বাস আর মতামতের সাথে পেরে উঠে না। পারে না পালটা প্রশ্ন তুলতে। এগুলোর বিপরীতে হতে পারে না সংশয়বাদী। এভাবে ধর্মের মূল শিকড় হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
    একজন মুসলিম সংশয়বাদী এসব প্রশ্ন তাদের দিকেও ছুড়ে দেবেন। কুরআন ও সুন্নাহ হতে ব্যাখ্যা করবেন। এনলাইটেনমেন্টের নামে যে অন্ধকারে মানুষ পতিত সে বদ্ধকূপ থেকে আলোর পথে বের করে আনবেন। এভাবেই সংশয়বাদীতার অবস্থান গ্রহণ করা হলো সন্দেহ ও সংশয় সমাধানের প্রথম ধাপ। তারাও আমাদের মতো মানুষ। যুক্তি, বুদ্ধির কাছে পরাজিত হওয়া মানে হেরে যাওয়া নয়। বরং অনন্ত যাত্রার পথে জিতে যাওয়া। এটা বোঝানোর জন্য জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
    একদল লোক প্রগতিবাদকে সাথে নিয়ে জ্ঞানকে পুঁজি করে এগিয়ে চলেছেন। লক্ষ্য ক্ষমতা জুড়ে দিলেই সমীকরণটা মাটির মানুষ একদিন দেবতায় পরিণত হবে। এখানে অসংগতি ও পারস্পরিক সাংঘর্ষিকতার মোটিভ রয়েছে। ইসলামকে বাদ দিলে বাকি সব তাদের মতে কমনসেন্সের ব্যাপার। বহুত চাটুল বাক্য। লিবারেলিসমের আত্মপ্রতারণার অংশ যে তারা নাকি কোনো কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেন না। ব্যক্তিস্বাধীনতাই সবকিছুর উর্ধ্বে। আর এভাবেই প্রগতির উপর অন্ধবিশ্বাস আধুনিকতার মূল ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে।
    বইটিতে লেখক আপনাকে প্রাণান্ত বোঝাতে চেয়েছেন মডার্নিটির সংজ্ঞা ও বিপদ কী, সেক্যুলার বলে যারা দাবী করছেন তাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, নৈতিকতা যে নির্ধারিত হবে; সে নৈতিকতার বিশদ ব্যাখ্যা ও উৎস, অস্তিত্বের প্রকৃতি ও মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য, প্রগতিবাদ, মডার্নিটির সাথে ট্র্যাডিশনের বিরোধ কোথায়, মেটাফিযিক্স/ অধিবিদ্যা, ডিলিউশান বা ভ্রান্তিবিশ্বাস, এম্পিরিসিজম বা অভিজ্ঞতাবাদ না থাকলেই কি সৃষ্টিজগতের রহস্য সম্পর্কে বিশ্বাস পালটে যাবে- এইসকল খুঁটিনাটি আলোচনা বৃহৎ পরিসরে করেছেন। মূল লক্ষ্য সেসকল গোঁয়ার্তুমিদের দিকে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করা যারা নিজেদের কথাকেই শেষ কথা বিবেচনা করে কুয়োর ব্যাঙ হয়েছেন।
    নারীবাদ ও হিজাব নিয়ে নারীদের একটি বিশাল অংশের সংশয়ের সীমা নেই। হিজাব তো নারীর চয়েস নয়। নারী পুরুষের চলাচল, কর্ম ও জীবন নির্বাহ, রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজ সংস্কার সবকিছু আল্লাহর বেঁধে দেয়া নীতি। কে নীতি নির্ধারক হবেন সেটা কিসের উপর নির্ভর করবে? কাকেই বা বোঝাতে যাচ্ছি? তার মাথায় কি সে পরিমাণ ব্যাসিক জ্ঞান আছে নাকি সেটাও জানা আবশ্যক।
    যে মানুষটি গ্রহ-উপগ্রহের চলাচলে মুগ্ধ হয়ে যান, বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিস্কারে অবাক হয়ে যান, তার মাথাতেও আসে না এই গ্রহ-উপগ্রহ সৃষ্টির পেছনের রহস্য কী! সংস্কারপন্থী ও মডার্নিস্ট মুসলিম নিয়েও তাই আলোচনা করতে ছাড়েননি লেখক। সংস্কারের নামে ভন্ডামীর শিকার হয়েই মুসলিম বিশ্বের পশ্চাৎপদতার কারণ হচ্ছে, যেখানে সীমাহীন সমস্যা, কিন্তু সমাধানের রাস্তা নেই।
    যৌনতা ও যিনা-ব্যাভিচার নিয়ে লেখক যে দুটি কথা বলেছেন তার ওজন খুব ভারী। কারণ, সমীক্ষার রিপোর্ট অনুয়ায়ী এসব বিষয়ের যুক্তিখন্ডন করলে ইসলামের কথা বারবার উঠে আসবে। যেমনটি ন্যায়নীতি, প্রগতি, লিবারেলিসম নিয়ে বলতে গেলে ধর্মের বাণীই উঠে আসে।
    এতকিছুর পরেও মুসলিম সংশয়বাদী হওয়ার অর্থ কী যদি আপনার বুঝে না আসে, তবে একজন মুসলিম সংশয়বাদীর জবানবন্দীও লেখক পেশ করে এ যাত্রায় ইতি টেনেছেন।
    পর্যাপ্ত জ্ঞান ও জ্ঞানের ভান করা এক বিষয় নয়। তাই কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার পূর্বে সে বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা জরুরি যে তা সত্যিকার অর্থেই সুফল বয়ে আনবে কি না। ইসলাম হলো সেই শাশ্বত জীবন বিধান যা সেইসকল নীতি অত্যাবশ্যক করেছে।
    পরিশুদ্ধির জন্য আগাগোড়া জানতে হবে। নাহলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। লিবারেলদের ফ্যান্টাসি ভাঙতে হবে। নাস্তিক যখন তার মতাদর্শ নিয়ে বুঝতে শিখবে, তখন যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনার সুত্রেপাত ঘটবে।
    কালচারাল বায়াস, সংকীর্ণমনা, প্রগতিশীল এসব যাদের আগে টাইটেল বসিয়ে দিচ্ছি তারা মুসলিমদের নামের আগেও বেশ কিছু টাইটেল জুড়ে দিয়েছেন। তারা তাদের জায়গায় সন্তুষ্ট। কিন্তু মুসলিমরা কেন উত্তর দেয় না? সেটাই লেখকের প্রশ্ন। উত্তর পাঠকের কাছে।
    অনুবাদক আসিফ আদনান যথাসাধ্য সাবলীল ও সুখপাঠ্য করে অনুবাদ করেছেন। প্রতি পাতায় থিওরি, টার্ম, বিশের টীকা আকারে জুড়ে দিয়েছেন, সাথে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এই কঠিন বইটিকে করেছে সহজতর। তবুও সাধারণ পাঠকের কিছু বিষয়ে ব্যাসিক পড়াশোনা না থাকলে কঠিন মনে হতেই পারে। আমাকেও প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। টার্মগুলো সম্পর্কে ধারণা দিয়ে অনুবাদক পাঠকের সময় অপচয় রোধ করেছেন। এই জন্যে তার ধন্যবাদ প্রাপ্য। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের সাথে বেমানান বিষয়গুলো তিনি বাদ দিয়েছেন, তবে আমার মনে হয়েছে সেগুলো জুড়ে দিলেও আরও কিছু শক্তপোক্ত প্রশ্নের উত্থানে নিজেকে তৈরি করতে পারতাম।
    লেখক হাকিকাতযু ইসলামের বিপক্ষে যারা প্রশ্ন তোলেন তাদের কথার ব্যবচ্ছেদ করে দীর্ঘদিন ধরে বক্তব্য ও লেখালেখি করে আসছেন। ‘সংশয়বাদী’ বইটি তার এ ধরনের প্রবন্ধগুলোর একটি সংকলন, যা ইংরেজিতে ‘The Modernist Menace To Islam’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল; তারই বঙ্গানুবাদ। আর লেখককে নিয়ে জানতে চাইলে বইটি আপনাকে পড়তে হবে।
    সাবলীল অনুবাদের সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ব্যাপার হলো লেখকের (ড্যানিয়েল হাকিকাতযু) নামের বানান একেক জায়গায় একেক রকম। বইয়ের কভারে, অনুবাদকের কথা, লেখকের পরিচিতির (এক পৃষ্ঠাতেই তিন রকম) ও ফ্ল্যাপে ভিন্ন ভিন্ন বানান চেক করে নিলে ভালো হতো।
    আর প্রচ্ছদ নিয়ে দুটি কথা যে না বললেই নয়। প্রথমেই যেখানে চোখ আটকে যাবে যা হলো, একজন স্যুট পরিধান করা সাহেব বলে মনে হয়, এমন মানুষের না আছে মাথা, আর না আছে মগজ। মাথার জায়গায় রয়েছে শূন্য খাঁচা। সে খাঁচাটিও ফাঁকা। আর এমন রহস্য ও কৌতুহল সৃষ্টির পর বইটি না পড়ে আপনি থাকতেই পারবেন না।
    ইসলামকে নিয়ে বিতর্কিত ও কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে নিজেকেও প্রস্তুত করতে হবে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বল্পতা আমাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমরা কি তা জানি? দ্বীন ইসলামকে আল্লাহ যেভাবে প্রেরণ করেছেন সেভাবে বোঝার তৌফিক দিন। আমীন।

  7. Din Muhammad Sheikh

    ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর থেকেই মূলত আধুনিককালের ধর্মহীনতার প্রভাবশালী বিস্তার শুরু।রেনেসাঁ আন্দোলন যদিও হয়েছিল খ্রিস্টধর্মগুরুদের অজাচার ও অনাচারের বিরুদ্ধে, তবে সে আন্দোলনের প্রাক্কালে জন্ম নেওয়া বিজ্ঞানবাদীরা মূলত খোদ ধর্মের বিরুদ্ধেই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিল। যেহেতু ইসলাম সব ধরনের সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত একমাত্র সত্যধর্ম, তাই সেসব বিজ্ঞানবাদীরা পরবর্তীতে তাদের মতবাদের পথে সবচেয়ে বড়ো বাধা হিসেবে ইসলামকেই পেয়েছে। আর তাই নিজেদের পথ মসৃণ করতে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রশ্ন তুলেছে, ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ আকিদার মধ্যে সৃষ্টি করেছে নানান সন্দেহ-সংশয়।

    চাকচিক্যময় কিছু শব্দের মুখোশ পরানো পাশ্চাত্য-প্রণীত মতবাদগুলোর খপ্পরে পড়ে অনেক মুসলিমই নিজ ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংশয়ের জালে আটকে যায়, হয়ে যায় সংশয়বাদী। অথচ শ্রেষ্ঠ ধর্মের অনুসারী হওয়ায় আমাদেরই বরং উচিত ছিল ওদের মতবাদগুলোর ওপর প্রশ্ন তোলা, সেগুলোর অসারতা স্পষ্ট করা। আমাদেরও সংশয়বাদী হওয়া উচিত, তবে নিজ ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, বরং নিজ ধর্মের বিপরীতে যা-কিছু আছে, সেসবের ক্ষেত্রে। আমরাও সেগুলোকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করব, খুলে দেব সেসবের কৃত্রিম মুখোশ।

    জনপ্রিয় প্রকাশনী ইলমহাউজ থেকে প্রকাশিত ড্যানিয়েল হাকিকাতযুর ‘সংশয়বাদী’ বইটি মূলত আমাদেরকে সংশয়বাদী হতে সাহায্য করবে — তবে এ সংশয় দ্বীনের ক্ষেত্রে নয়, বরং এ সংশয় দ্বীন-বিরোধী প্রতিটি মতবাদের ক্ষেত্রে।

    ▪️ লেখকপরিচিতি :

    ড্যানিয়েল হাকিকাতযু। জন্ম আমেরিকায়। পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ডে। গ্রাজুয়েশন ও পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছেন দর্শনে। এছাড়াও আলিমদের তত্ত্বাবধানে শিখছেন দ্বীনি ইলম। পাশ্চাত্যের দা’ঈদের মধ্যে আপসকামিতা এবং ইসলামকে পাশ্চাত্যের ছাঁচে মেলাবার যেই তদবির লক্ষ্য করা যায়, তার ঠিক বিপরীতে ড্যানিয়েল হাকিকাতযু। তিনি বরং পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করেন, ওদের মতবাদের অসারতা প্রমাণ করেন দৃপ্তভাবে। ইউটিউবে The Muslim Skeptic চ্যানেলে তাঁর লেকচার পাওয়া যায়। এছাড়াও muslimskeptic.com ও alasna.org-তে তাঁর লেকচার-লেখনি পাওয়া যায়।

    ▪️ অনুবাদক পরিচিতি :

    বইটি অনুবাদ করেছেন অনলাইন জগতের সুপরিচিত মুখ আসিফ আদনান ভাই। ইসলাম বিরোধী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর লেখালেখির সুবাধে অনলাইন এক্টিভিস্টদের মাঝে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ইতোমধ্যেই। ‘চিন্তাপরাধ’-এর মতো যুগান্তকারী বইটির লেখকও তিনিই। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু বই।

    ▪️ বইপরিচিতি :

    ‘সংশয়বাদী’ মূলত ড্যানিয়েল হাকিকাতযুর কিছু প্রবন্ধের সংকলন। ইংরেজি ভাষায় এটি প্রকাশিত হয়েছে ‘The Modernist Menace to Islam’ নামে। তবে মূল বই থেকে কিছু প্রবন্ধ এ দেশের প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিক ব’লে বাদ দেওয়া হয়েছে। লেখকের মতো অনুবাদকও যেহেতু একই কাজ করেন (ইসলাম বিরোধী মতাদর্শের ব্যবচ্ছেদ), তাই বইটির অনূদিত রূপ অসাধারণ না হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

    ▪️ বইয়ের বিষয়বস্তু :

    পাশ্চাত্য-প্রণীত কিছু আগ্রাসী মতবাদের ব্যবচ্ছেদই এ বইয়ের আলোচ্যবিষয়। মতবাদগুলোর অসারতা প্রমাণ করে ইসলাম ও সেগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট করা হয়েছে, অতঃপর তুলে ধরা হয়েছে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব।

    ▪️ যা-যা আছে বইটিতে :

    বইয়ের শুরুর দিকেই আছে নাস্তিকতা সম্পর্কিত আলোচনা। হালের নাস্তিক-গুরু স্টিফেন হকিং কীভাবে ঈশ্বর-উপাসনা নাকচ করে উল্টো আত্নউপাসনায় লিপ্ত হয়েছে, নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নেই ব’লে প্রচার করা নাস্তিকরা কীভাবে লিবারেল-সেক্যুলারিজমকে নিজেদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে, বিজ্ঞানের নানাবিধ আবিষ্কারে আপ্লুত হতে পারলে, সেই আবিষ্কারের স্রষ্টাকে নিয়ে কেন আপ্লুত হওয়া যায় না, স্রষ্টাকে নাকচ করতে গিয়ে কীভাবে নাস্তিকরা নিজেদের মানবীয় বুদ্ধিমত্তাকেই নাকচ করে ফেলেছে, এ বিষয়ে চমৎকার আলোচনা এসেছে বইটির শুরুর দিকে। অনেক ‘অদৃশ্য’কে নির্দ্বিধায় মেনে নিলেও নাস্তিককুল ‘অদৃশ্য’ মহান রবকে মেনে নেয় না — এ দিকটা নিয়েও যৌক্তিক আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। আল্লাহর অস্তিত্ব কি প্রমাণ করতেই হবে, করতে হলে কীভাবে করা হবে, এ সম্পর্কেও রয়েছে দারুণ দিকনির্দেশনা।

    এরপর এসেছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা। লেখক এখানে তথ্যপ্রমাণসহ সেক্যুলারিজমের কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। যেমন : নিরপেক্ষতার আড়ালে সেক্যুলারিজমের ভিন্নমত দমন, কাজের কথা বলে কাজের ফলাফল গোপন, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথককরণ। লিবারেলিজমের মোড়কে ইসলামের প্রচার কতটুকু ক্ষতিকর, গণতন্ত্র কি আদৌ ইসলামি শাসনব্যবস্থা থেকে উত্তম কি না, এ সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে।

    এরপর লেখক পাশ্চাত্যের বহুলপ্রচারিত তিনটা মুখরোচক পরিভাষার ব্যবচ্ছেদ করেছেন — ‘সাম্য’, ‘মুক্তি’ ও ‘স্বাধীনতা’। সেক্যুলারদের প্রচারিত ‘ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী’ তত্ত্বটি কতটুকু সঠিক, তা-ও দেখানো হয়েছে বইটিতে। ইসলাম স্বাধীনতার ধর্ম কি না, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সমর্থন করা আমাদের উচিত কি না, ইসলামে বাকস্বাধীনতা ও সমতার ব্যাখ্যা কী, মদপানে বাধাদান কি স্বাধীনতার হরন, হুদুদ কি নির্মমতা, এ প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক উত্তর মিলবে বইটিতে।

    বর্তমান জামানায় মুসলিম পরিবার ভাঙনের অন্যতম কারণ তথাকথিত ‘নারীবাদ’। বইটিতে লেখক চমৎকারভাবে এ মতবাদের অসারতা প্রমাণ করেছেন। একজন মুসলিম পর্যায়ক্রমে কীভাবে চরম নারীবাদী হয়ে ইমান হারায়, এ সম্পর্কে অত্যন্ত চমৎকার বাস্তবসম্মত আলোচনা এসেছে। নারীবাদ কীভাবে ধর্মবিদ্বেষে রূপ নেয়, তা নিয়ে আলোচনা করার পর লেখক তুলে ধরেছেন অত্যাচারিত নারীদের জন্য নারীবাদ ব্যতীত বিকল্প পন্থা। নারীবাদীদের প্রচারিত ‘পুরুষতন্ত্র’ তত্ত্বেরও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। স্বামীদের জুলুম-অত্যাচারকে নারীবাদীরা ইসলামের সাথে জুড়ে দেয়। এটা কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা-ও লেখক পরিস্কার করেছেন দৃঢ়তার সাথে। আমরা কীভাবে নারীবাদের সমালোচনা করব, সংক্ষেপে সেদিকেও পরামর্শ দিয়েছেন লেখক ড্যানিয়েল হাকিকাতযু।

    এরপর লেখক বইটিতে হিজাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেছেন। হিজাব বাধ্যতামূলক করার আইন শোষণ কি না, ‘হিজাব আমার চয়েস’ তত্ত্ব কতটুকু যৌক্তিক, হিজাব পরার পরেও কীভাবে তা দ্বীনের অবাধ্যতায় রূপ নেয়, হিজাব পরার পরেও যৌননির্যাতন ঘটে থাকলে হিজাবের কার্যকারিতা হারায় কি না, এ সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনার পাশাপাশি ফ্রান্সের হিজাব বিদ্বেষের ব্যাপারেও বইটিতে লেখক কথা বলেছেন।

    বইটিতে বিজ্ঞানবাদ নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এসেছে। কুরআনকে বিজ্ঞানভিত্তিক কিতাব হিসেবে প্রচার করা আমাদের জন্য কতটুকু যৌক্তিক, বিজ্ঞানের বাস্তবতাই বা কী, ইসলাম ও বিজ্ঞানের সংঘাত কোথায়, এ সংশ্লিষ্ট জরুরি আলোচনা পাবেন বইটিতে।

    লিবারেলিজম নিয়েও আলোচনা এসেছে বইটিতে। লিবারেলিজম কীভাবে অনৈতিকতা ধারণ করে, সহিষ্ণুতার নামে কীভাবে ওরা অসহিষ্ণুতা ছড়ায় এবং ওদের দর্শনের ভণ্ডামি কী, তা তুলে ধরা হয়েছে।

    প্রগতির দোহাই দিয়ে নৈতিকতার পদস্খলনকে লিবারেল-সেক্যুলাররা যেভাবে বৈধতা দিয়ে চায়, তার যৌক্তিক সমালোচনা করা হয়েছে বইটিতে। বইটিতে আরও রয়েছে সত্যিকারের মুক্তচিন্তকের পরিচয়, সত্যিকারের নৈতিকতার স্থান, ইসলামি নৈতিকতার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা।

    মডার্নিটি কী, এর পেছনের ঐতিহাসিক সত্যতা কী, ইসলামের সাথে এর সংঘাত কোথায়, মডার্নিটির বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী, এ প্রশ্নগুলোর চমৎকার উত্তর পাবেন বইটিতে।

    বইটিতে আপনি আরও পাবেন ট্রাডিশনাল ও মডার্নিস্ট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য, মুসলিম বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পশ্চিমের গৃহীত পন্থা, বিজ্ঞানের সাথে হাদিসের দ্বন্দের ক্ষেত্রে সমাধান, তথাকথিত প্রগতিশীলদের সাথে বিতর্ক করা আমাদের আদৌ উচিত কি না, এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাহুল্যবর্জিত যৌক্তিক আলোচনা। তর্কে মডার্নিস্ট মুসলিমদের কীভাবে হারানো যায়, সে বিষয়েও দারুণ একটি নির্দেশিকা দিয়েছেন লেখক। এছাড়াও প্রকৃত জ্ঞানী কারা, মডার্নিস্টরা সংস্কারের নামে কীভাবে ভাঁওতাবাজি করে, বৈশ্বিক শক্তিতে মুসলিম-বিশ্বের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ কী, এ বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা হয়েছে।

    বইটির ‘যৌনতা ও যিনা’ শিরোনামের অধীনে উঠে এসেছে পশ্চিমা বিশ্বের যৌনতার সহজলভ্যতা এবং ‘যৌন শিক্ষা’-এর নামে যৌনতা প্রসারের চিত্র। এছাড়াও রয়েছে বিয়ের গুরুত্ব, নারীপুরুষকে অবাধে মিশতে না দেওয়ার হাকিকত, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার যৌনতা ফেরি করার কারণ সংক্রান্ত আলোচনা।

    নাস্তিকদের একটা কমন অভিযোগ — ইসলাম তলোয়ারের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তাদেরকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে আমরা বলি, ‘না, ইসলাম তলোয়ারের মাধ্যমে প্রচারিত হয়নি।’ লেখক ঐতিহাসিক সত্যতাকে সামনে রেখে এ ইস্যুর চমৎকার একটি সমাধান উল্লেখ করেছেন বইটিতে। এরপরই লেখক আমাদেরকে সমকামীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কূটকৌশল দিখিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছেন।

    পচনধরা এ সমাজব্যবস্থায় কীভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, আধুনিকতার মাঝে কীভাবে ইসলামকে সঠিকভাবে বোঝা যাবে, এ সংক্রান্ত আলোচনার পর পরিস্কার করা হয়েছে ‘মুসলিম সংশয়বাদী’ হওয়ার অর্থ, যা থেকে আপনি বইটির নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পাবেন।

    ▪️ বইটির বৈশিষ্ট্য :

    সংক্ষেপে দারুণ এ বইটির কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছি।

    • বইটির সবচেয়ে ইউনিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর আক্রমণাত্মক আলোচনা। কথায় আছে, ‘Attack is the best defence’। জ্বি, পাশ্চাত্য যখন আমাদের দ্বিনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, সংশয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তখন ওদেরকে মোকাবেলার সবচে’ কার্যকরী পন্থা হচ্ছে সেসব ধোঁকাপূর্ণ মতবাদের অসারতা স্পষ্ট করা, ওদের বিরুদ্ধেই বরং পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। এ বইটিতেও এমনটিই করা হয়েছে।

    • বইটির আলোচনাও অত্যন্ত সহজবোধ্য। জটিল তাত্ত্বিক আলোচনাগুলোকে বেশ সহজ ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে।

    • প্রয়োজনীয় স্থানে টীকা উল্লেখের মাধ্যমে বইটিকে আরও সহজবোধ্য করা হয়েছে।

    • আলোচনার যথার্থতা প্রমাণে বিভিন্ন স্থানে কুরআন-হাদিসের দলিলও আনা হয়েছে।

    • অনুবাদ একদম ঝরঝরে। আপনার মনেই হবে না যে, আপনি একটি অনূদিত বই পড়ছেন।

    • বইটির ম্যাটাফোরিকাল নাম এবং মিনিংফুল প্রচ্ছদ এর পাঠের প্রতি পাঠকের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়।

    • বাইন্ডিং একটু দূর্বল হলেও বইটির পৃষ্ঠামান বেশ ভালো।

    ▪️ বইটির প্রয়োজনীয়তা :

    বইটি কেন প্রয়োজন? পাশ্চাত্যের আগ্রাসনে জর্জরিত এ মুসলিম উম্মাহর চেতনা ফিরিয়ে আনবার জন্য বইটি অত্যন্ত জরুরি। পাশ্চাত্যের মতবাদগুলোর অসারতা ও দ্বিচারিতা বুঝতে বইটি বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখবে, ইনশাআল্লাহ। এছাড়াও ডিফেন্সিভ মুড থেকে ফিরে অফেন্সিভ মুডে গিয়ে সেসব মতাদর্শের সমালোচনা করতে আমাদেরকে সাহায্য করবে এ বইটি। বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করার চাবি হিসেবে কাজ করবে বইটি, ইনশাআল্লাহ।

    ▪️ মন্দলাগা :

    দারুণ এ বইটির দু’-এক জায়গায় কিছুটা কমতি ছিল ব’লে আমার মনে হয়েছে। ইংরেজি পরিভাষাগুলোর বাংলায়ন অনেক ক্ষেত্রেই বেশ সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়ায়। তাই অনুবাদক মহোদয় এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল শব্দই ব্যবহার করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংযুক্ত টীকায় সেসব পরিভাষার ব্যাখ্যা লিখলেও, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলোর ব্যাখ্যা লেখা হয়নি। সুতরাং যারা সেসব পরিভাষার সাথে পূর্ব থেকে পরিচিত নন, তাদের জন্য কিছুটা সমস্যাজনক হতে পারে। তাছাড়া প্রতিটি প্রবন্ধের আলোচনা একটু বেশিই সংক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছে। এ ইস্যুতে এটাই যদি কোনো পাঠকের প্রথম বই হয়, তাহলে তার জন্য বুঝতে পারা খানিকটা কষ্টসাধ্য হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ২০০ পৃষ্ঠার উপরের বইগুলোর জন্য হার্ডকাভার পছন্দ করি। বইটির গুরুত্বের বিবেচনায় হার্ডকাভার করে বাইন্ডিং আরেকটু পোক্ত করা হলে আমার কাছে বেশ লাগতো। তবে এগুলো তেমন বড়ো কোনো সমস্যা নয় যে, বইটির গুরুত্ব এক বিন্দু হ্রাস করবে।

    ▪️ একনজরে বইটি :

    • বই : সংশয়বাদী
    • লেখক : ড্যানিয়েল হাকিকাতযু
    • অনুবাদক : আসিফ আদনান
    • প্রকাশনী : ইলমহাউজ পাবলিকেশন
    • প্রকাশকাল : এপ্রিল, ২০২১
    • পৃষ্ঠাসংখ্যা : ২৬৬
    • নির্ধারিত মূল্য : ২৬০/-
    • কাভার : ফ্ল্যাপসহ পেপারব্যাক
    • ধরণ : সংশয় নিরসন

  8. Aliza anu

    পাশ্চাত্য সভ্যতা  বিশ্ব শাসনের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তারা  ইসলামকে হুমকি  হিসেবে দেখছে।

    “ইসলাম সন্ত্রাসবাদ,ইসলাম জোঙ্গিবাদ”
    এরকম আরো কত কথা বলে তারা তাদের গাল ফুলিয়ে ফেলে।

    ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহকে নিশ্চিহ্ন করার সবরকম  কৌশল তারা ব্যবহার করেছে। সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি তারা ইসলাম এবং মুসলিম উম্মার সাথে আদর্শিক লড়াইও লিপ্ত হয়েছে যাকে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও বলা যেতে পারে।

    এই মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের মাধ্যমে তারা মুসলিম উম্মাহকে স্থবির করে দিয়েছে।
    আজ আমরা তাদেরকে উন্নত বলে স্বীকার করি। তাদের প্রত্যেকটা আদর্শকে আমরা প্রশ্নাতীত মেনে নিয়েছি।তাদেরকে আমরা আধুনিক বলে মেনে নিয়েছি।
    তাদের এই প্রভাব প্রতিটা মুসলিমের অন্তরে গেঁথে গিয়েছে।

    ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব এ বিষয় নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।সেই ধারাবাহিকতার একটি চেষ্টা হলো এই সংশয়বাদী বইটা। বইটির লেখক ড্যানিয়েল হাকিকাতযু।তিনি হার্ভার্ডে পড়াশোনা করেছেন আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে ফিজিক্স আর গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে পড়েছেন দর্শন নিয়ে। আর অনুবাদক হলেন আসিফ আদনান।

    কেন পড়বো এই বইটা?

    স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে এই বইটার টপিক নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।  তাহলে এই বই পড়বো কেন?

    পাশ্চাত্য সভ্যতার বিভিন্ন মতবাদ নাস্তিকতা,গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য,মৈত্রী,স্বাধীনতা, নারীবাদ, সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে এই বইয়ের মধ্যে।

    এই বইটা পড়ার দ্বারা আমাদের চিন্তার জগতে বিপ্লব সৃষ্টি হবে। এই বই আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।

    ইসলাম কি সমঅধিকার দিতে সক্ষম,
    ইসলাম কি নারীবাদ এর কথা বলে,
    ইসলাম কি  গণতন্ত্রকে শিকার করে,

    এগুলো শুনতে তো ভালোই মনে হয়। প্রথম দৃষ্টিতে যৌক্তিকও মনে হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই?

    এরকম আরো কত কথা বলে আমরা ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করি। এই সবগুলোই পশ্চিমা নীতি।কিন্তু আমরা কখনও পশ্চিমা নীতিকে  প্রশ্নবিদ্ধ করি না। কখনো ভাবি নাই যে তারা যা কিছু বলে, সবকিছু তো তাদের অসম্পূর্ণ মেধার উপর ভিত্তি করে বলে। আর আমাদের ধর্ম তো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা একটি ধর্ম।যিনি সর্বোজ্ঞ।

    এই বই আমাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখাবে,

    আচ্ছা তারা যে বুদ্ধি বিবেক কে খোদার আসনে
    বসিয়েছে, বুদ্ধি-বিবেক এর কি কোন সীমানা নেই?

    মানুষের বুদ্ধি কি সব কিছুর সমাধান করতে পারবে?
    তার কি কোন সীমারেখা নেই?

    সেকুলারিজম যে পৃথিবীর মধ্যে সবার কাছে গৃহীত এবং পছন্দনীয় মতবাদ এর ভিত্তি কী?
    নারীবাদীরা যে feminism নিয়ে কথা বলে তার ভিত্তি কী?

    তারা যে  সাম্য ও স্বাধীনতার কথা বলে এটা কি আসলেই মানুষের কোন উপকার করতে পারবে নাকি শুধু তার ক্ষতিই বয়ে আনবে?

    এইসব প্রশ্নের উত্তর আমরা এই বই থেকে পাবো

    সুতরাং আর দেরি না করে ঝটপট এক কাপ কফি আর এই বই নিয়ে আমাদের সকলের বসে পড়া উচিত।

  9. Meherunnesha Khatun

    #সংশয়বাদী_রিভিউ_২০২১

    প্রারম্ভিক কথন
    ➖➖➖➖➖
    আদম সন্তানের মন দ্রুত পরিবর্তনশীল। এই মুহূর্তে মনে এক ভাবনা, তো পরমুহূর্তেই সেই ভাবনার রদবদল হয়ে যায়। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল তা যাচাই করতেও অপারগ। তার উপর পশ্চিমা অপসংস্কৃতি এবং বিধর্মীদের কালচার মুসলিম উম্মাহর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়েছে যে আমরা তা পুরোপুরি মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির কারণে যখন একদল মুসলিম প্রথমেই বিজ্ঞান জেনে পরে কুরআন-হাদীস-সীরাত চর্চা করে, তখন বিজ্ঞানের সাথে শরিয়তের কোনো বিষয়ে মিল খুঁজে পেলে আনন্দিত হয়। আবার কখনও বিজ্ঞান পরিবর্তন হলে তাদের ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। সেই মুহূর্তে একদল ইসলামকে ছুঁড়ে ফেলে, আর একদল উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে। আবার একদল মুসলিম আছে যারা নাস্তিক বা পশ্চিমা কিংবা ইসলামবিদ্বেষীদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতেও অক্ষম, এমনকি তারা পাল্টা প্রশ্ন করতেও জানে না।

    এমতাবস্থায় আধুনিকতার যাঁতাকলে নিজের অজান্তেই পিষ্ট হচ্ছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। সুতরাং মস্তিষ্ক থেকে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি, শিক্ষা, কালচার, দর্শন, মতাদর্শকে উপড়ে ফেলে সেখানে ইসলাম ঢোকাতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতেই হবে। তাই বিশ্বব্যাপী উম্মাহর কতিপয় মহান ব্যক্তি দাওয়াহ’র মাধ্যমে ঈমান হারা, সংশয়বাদী, আত্মভোলা এবং আল্লাহর দ্বীন থেকে বিচ্যুত মানুষদের হৃদয়ে তাওহীদের নূর জাগ্রত করতে সদা প্রস্তুত। এমনই এক সুতনু ব্যক্তিত্বের দাঈ তথা বর্তমান সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন স্কলার হলেন ড্যানিয়েল হাকিকাতযু। তাঁর বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রাবন্ধিক সংহিতা ‘The Modernist Menace To Islam’ -এর বঙ্গানুবাদই হলো আলোচ্য ‘সংশয়বাদী’ বইটি। বর্তমান প্রজন্মের শুভার্থী লেখক ও অনুবাদক আসিফ আদনানের হাত ধরে ‘সংশয়বাদী’ বইটি এক অনন্য ছোঁয়া পেয়েছে ইলমহাউস পাবলিকেশনের সৌজন্যে – যা পাঠককে অনেক কিছু জানিয়েছে, চিন্তার সাগরে ডুবিয়েছে, ইলমের বর্ষনে ভিজিয়েছে, আরও জানার অভীপ্সা সৃষ্টি করেছে হৃদ মাঝারে। কীভাবে প্রশ্ন করতে হয় – তা শিখিয়েছে, উত্তর দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করিয়েছে।

    বইটির বিষয়বস্তু
    ➖➖➖➖➖
    বক্ষ্যমাণ বইটির আলোচ্য বিষয় ১৩টি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায় আবার একাধিক শিরোনামে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে নাস্তিকতা দিয়ে। এখানে লেখক দেখিয়েছেন নাস্তিকদের চিন্তাভাবনা, তাদের নানান যুক্তি এবং স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে, ইসলামের বিধানের উপর তাদের আরোপিত প্রশ্ন ইত্যাদি। আর সেই প্রশ্নের জবাবও খুব সুন্দরভাবে বইটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে বইটি মূলত নাস্তিকতার প্রতিঘাতমূলক কোনো বই নয়, বরং এটি পশ্চিমাদের অনুশাসন ও অভিমতগুলো এবং তাদের প্রচলিত, নিকৃষ্ট মানের মন্তব্যগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। এগুলোর পিছনের পূর্বজ্ঞান করা অসার কল্পনাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার দূর্লভ এক কিতাবই হলো বক্ষ্যমাণ বইটি। অন্যান্য অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, নারীবাদ, হিজাব, বিজ্ঞানবাদ, লিবারেলিসম, নৈতিকতা ও প্রগতিবাদ, মডার্নিটি, সংস্কারপন্থী ও মডার্নিস্ট মুসলিম, যৌনতা ও যিনা, সংশয়বাদী ইত্যাদি সম্পর্কে। ‘পশ্চিমা সংশয়বাদী’ এবং ‘মুসলিম সংশয়বাদী’ -কে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে কেবলমাত্র বিরাগজনক অবস্থানকেই সংশয়বাদীর কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছে বক্ষ্যমাণ বইটিতে।

    প্রায় পনেরোশো বছর আগে ভালো কিংবা নৈতিক হওয়ার পদ্ধতি যেখানে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, সেখানে মডার্নিটি প্রতিস্থাপন করেছে লিবারেলিসমকে; যেখানে আল্লাহ বলেছেন মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে কাদামাটি থেকে, প্রথম মানুষ আদম (আঃ); সেখানে মডার্নিটির জবাব ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বই হলো মানব সৃষ্টির ইতিহাস। যদি জিজ্ঞেস করা হয় ‘তবে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি?’, তাহলে মডার্নিটি এ প্রশ্নের যথাযথ যৌক্তিক উত্তর দিতে অক্ষম। ট্রাডিশান আর মডার্নিটিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে আলোচ্য বইটিতে খুব সুন্দরভাবে লেখক উপস্থাপন করেছেন পরিপাটি, গোছানো অবয়বে। মডার্নিটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে হলে তো অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।

    বইটির বিশেষত্ব
    ➖➖➖➖➖
    ♦ বইটির প্রতি পৃষ্ঠায় অনুবাদক কিছু বিশেষ টার্ম তথা দার্শনিক পরিভাষা, থিওরি যুক্ত করে পাঠকদেরকে সেই টার্মগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দ্বারা পরিচয় করে দিয়েছেন টীকা সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে। এতে প্রতিটি পাঠক আরও ভালো ভাবে বিষয়গুলো রপ্ত করতে পারবে।

    ♦ যথেষ্ট সাবলীল, প্রাঞ্জল ভাষায় অনুবাদক বইটি উপস্থাপন করেছেন।

    ♦ আপাতদৃষ্টিতে বইটিতে একটু কাঠিন্য পরিলক্ষিত হলেও ভীষণ মনোযোগ সহকারে পড়লে সকল শ্রেণীর পাঠকই তৃপ্তি ভরে আস্বাদন করবেন বইটির সারনির্যাস এবং এর কন্টেন্টের গুণগত মান।

    ♦ বইটির অন্যতম বিশেষত্ব হলো বইটি পাঠককে ভীষণ ভীষণ রকম ভাবাবে। সামনের ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দেওয়া প্রায় প্রতিটা প্রশ্ন সহ উত্তরে পাঠক বিস্মিত হবে- এ যেন তারই মনের কথা।

    ♦ বক্ষ্যমাণ বইটি কেবল ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রশ্নের জবাব দিতে নয়, বরং তাদেরকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে শেখাবে। পাশাপাশি পশ্চিমাদের রীতিনীতি, কালচার সম্পর্কে পাঠককেও একজন ‘মুসলিম সংশয়বাদী’ হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করবে।

    সমালোচনা
    ➖➖➖➖
    যদিও সমালোচনা করার মতো তেমন কিছু পাইনি আর সেই যোগ্যতাও আমার নেই। আসিফ আদনান যথেষ্ট ভালো অনুবাদক। ওনার লেখার মান, পর্যায় একটু ভিন্ন- এ সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই অবগত। এর আগেও ওনার অন্যান্য বহু লেখাই পড়েছি। যদিও তিনি এই বইটি ভীষণ সাবলীল-সুখপাঠ্য করেছেন, তথাপি আরও একটু সুখপাঠ্য হয়তো করা যেত। পাঠকের কথা ভেবে মূল বইয়ের যে অংশ গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে, আমার মনে হয় সেগুলো জুড়ে দিলে আরও ভালো হতো। যারা পড়ার তারা সেই অংশটাও পড়তো, আর যারা না পড়ার তারা থাকলেও তা স্কিপ করে যেত। সুতরাং জ্ঞানপিপাসু পাঠকরা হয়তো আরও একটু বেশি উপকৃত হতো। আর কিছু জায়গায় বানান ভুল আছে, সম্ভবত সেটা টাইপিং মিসটেক। তবে একটা অনুরোধ, এমন একটি দারুণ বই হার্ডকভার হলে ভীষণ ভালো হতো।

    বইটির প্রয়োজনীয়তা
    ➖➖➖➖➖➖➖
    ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাসের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে খুব সহজেই প্রতীয়মাণ হয় দুই সময়ের বৈপরীত্য। তখনকার মুসলিম তথা সালাফগণ ওয়াহীর ব্যাপারে ‘আমরা শুনলাম এবং মানলাম’-কে অনুসরণ করতেন, আর এখনকার মুসলিমদের ৯০% – ই সংশয়বাদীর অন্তর্ভুক্ত। জাহান্নাম থেকে বাঁচার দু’য়া, জান্নাত লাভের মাসনুন জিকির-দু’য়া ইত্যাদি আমলের পর আমল দিয়ে জীবন সাজানোর পরও যদি একজন মুসলিমের মনে ইসলামের বিধিনিষেধের ব্যাপারে সংশয় গ্রাস করে, ঈমানের ভীত নড়বড়ে করে, তাহলে কি আদৌও কোনো লাভ আছে? নাকি এই সংশয়ের কারণে কিয়ামতের দিন সব আমল ধুলিকণায় পরিণত হবে? সুতরাং এমতাবস্থায়, এমন একটি চমৎকার মানের ব্যতিক্রমী বই নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তাই বর্তমান সময়ে এমন একটি দুর্দান্ত বই উম্মাহর জন্য কতটা সুকৃতি ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন আধ্যাত্মিক পাঠক কিংবা সচেতন মুসলিম নিশ্চয় এই গুরুত্বপূর্ণ বইটির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারছেন।

    পাঠ্যানুভূতি
    ➖➖➖➖
    বইটি পড়ার পর সর্বপ্রথম আমার এক কেমিস্ট্রি স্যারের কথা মনে এসেছিল। তিনি আমাদের অর্গানিক পড়াতেন। একজন সংশয়বাদীর উদাহরণ হিসেবে কেন জানি না হঠাৎ স্যারকেই মনে পড়লো। একবার স্যার ক্লাসে বলেছিলেন, “ইসলামের সব ব্যাপারেই কিছু না কিছু বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজে পাই, কিন্তু কুরবানীর ব্যাপারটা আমার কাছে আজও ক্লিয়ার নয়। একদিনে এতোগুলো পশু হত্যা হচ্ছে, এতে কি পরিবেশে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে না? একদিনে তো এতো পশু জন্মগ্রহণও করেনা।” ব্যক্তিগতভাবে আমি বরাবর আল্লাহর বিধানের ক্ষেত্রে ‘শুনলাম এবং মানলাম’কে অনুসরণ করতাম, করি। তাই সেদিন ওই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি, যদিও তখন ইলমও তেমন ছিলনা। তারপরও একজন মেয়ে হওয়ার জন্যই হয়তো ‘পুরুষের বহুবিবাহের’ ব্যাপারটা ঠিক হজম হয়না, মনে একটা কষ্ট হয়েই যায় – এই বিষয়টা নিয়ে ভাবলে তখন হাজার প্রশ্ন, হতাশ, মেয়েদের প্রতি অবিচার, দুঃখ ইত্যাদিতে নিপতিত হয় মন, হৃদয় হয় ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই ব্যাপারটাকে আমলে নিই না। নিজেকে তখন এই বলে সান্ত্বনা দিই, “নিশ্চয় একজন মুমিনা নারী স্বামী, মাতা-পিতা, সন্তান, সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ এবং তারপর আল্লাহর রসুলকেই অধিক ভালোবাসে।” তো বইটা পড়ার সময় ভূমিকাতে স্যারকে সংশয়বাদী মনে হলেও, উপসংহারে এসে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম “আমিও কি তবে সংশয়বাদী? আমিও কি এবার সংশয়বাদী হতে পারবো?”

    বইটি প্রথমদিকে একটু কঠিন, রসকষহীন লাগছিল। এটা নিতান্তই আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের এবং স্বল্প জ্ঞানের ব্যর্থতার কারণ। তবে একটু মনোযোগ সহকারে পড়ার পর বোধগম্য হয়েছে। অবগত হয়েছি বইটির মূল বিষয়বস্তু এবং সারমর্ম সম্পর্কে। আস্বাদন করেছি এর সারনির্যাস। আমার অবচেতন মনে সৃষ্টি হওয়া বেশকিছু প্রশ্নের উত্তরও পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে সেকুলারিজম, নারীবাদ, মডার্নিটি, বিজ্ঞানাবাদ, সংশয়বাদী অধ্যায় গুলো। বইটি একজন পাঠককে চিন্তার খোরাক জোগাবে। বারবার ভাবাবে নিজের অবস্থান সম্পর্কে।
    বইয়ের নামকরণ এবং প্রচ্ছদ সত্যিই ভীষণ অর্থবোধক হয়েছে। অবশ্যই এটা একজন সফল অনুবাদকের পরিচয়। এমন একটি ব্যতিক্রমী, চমৎকার মানের বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনী সহ বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে যেন আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করেন – এই কামনায় রইলো। আমিন।

    সংক্ষেপে বই পরিচিতি
    ➖➖➖➖➖➖➖
    বইয়ের নাম :- সংশয়বাদী
    মূল বই :- The Modernist Menace To Islam
    লেখক :- ড্যানিয়েল হাকিকাতজু
    অনুবাদক :- আসিফ আদনান
    প্রকাশক :- ইলমহাউস পাবলিকেশন
    পৃষ্ঠা সংখ্যা :- ২৬৬
    প্রচ্ছদ মূল্য :- ২৬০৳
    বাইন্ডিং :- পেপারব্যাক

  10. Meherunnesha Khatun

    আদম সন্তানের মন দ্রুত পরিবর্তনশীল। এই মুহূর্তে মনে এক ভাবনা, তো পরমুহূর্তেই সেই ভাবনার রদবদল হয়ে যায়। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল তা যাচাই করতেও অপারগ। তার উপর পশ্চিমা অপসংস্কৃতি এবং বিধর্মীদের কালচার মুসলিম উম্মাহর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়েছে যে আমরা তা পুরোপুরি মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির কারণে যখন একদল মুসলিম প্রথমেই বিজ্ঞান জেনে পরে কুরআন-হাদীস-সীরাত চর্চা করে, তখন বিজ্ঞানের সাথে শরিয়তের কোনো বিষয়ে মিল খুঁজে পেলে আনন্দিত হয়। আবার কখনও বিজ্ঞান পরিবর্তন হলে তাদের ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। সেই মুহূর্তে একদল ইসলামকে ছুঁড়ে ফেলে, আর একদল উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে। আবার একদল মুসলিম আছে যারা নাস্তিক বা পশ্চিমা কিংবা ইসলামবিদ্বেষীদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতেও অক্ষম, এমনকি তারা পাল্টা প্রশ্ন করতেও জানে না।

    এমতাবস্থায় আধুনিকতার যাঁতাকলে নিজের অজান্তেই পিষ্ট হচ্ছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। সুতরাং মস্তিষ্ক থেকে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি, শিক্ষা, কালচার, দর্শন, মতাদর্শকে উপড়ে ফেলে সেখানে ইসলাম ঢোকাতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতেই হবে। তাই বিশ্বব্যাপী উম্মাহর কতিপয় মহান ব্যক্তি দাওয়াহ’র মাধ্যমে ঈমান হারা, সংশয়বাদী, আত্মভোলা এবং আল্লাহর দ্বীন থেকে বিচ্যুত মানুষদের হৃদয়ে তাওহীদের নূর জাগ্রত করতে সদা প্রস্তুত। এমনই এক সুতনু ব্যক্তিত্বের দাঈ তথা বর্তমান সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন স্কলার হলেন ড্যানিয়েল হাকিকাতযু। তাঁর বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রাবন্ধিক সংহিতা ‘The Modernist Menace To Islam’ -এর বঙ্গানুবাদই হলো আলোচ্য ‘সংশয়বাদী’ বইটি। বর্তমান প্রজন্মের শুভার্থী লেখক ও অনুবাদক আসিফ আদনানের হাত ধরে ‘সংশয়বাদী’ বইটি এক অনন্য ছোঁয়া পেয়েছে ইলমহাউস পাবলিকেশনের সৌজন্যে – যা পাঠককে অনেক কিছু জানিয়েছে, চিন্তার সাগরে ডুবিয়েছে, ইলমের বর্ষনে ভিজিয়েছে, আরও জানার অভীপ্সা সৃষ্টি করেছে হৃদ মাঝারে। কীভাবে প্রশ্ন করতে হয় – তা শিখিয়েছে, উত্তর দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করিয়েছে।

    বইটির বিষয়বস্তু
    ➖➖➖➖➖
    বক্ষ্যমাণ বইটির আলোচ্য বিষয় ১৩টি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায় আবার একাধিক শিরোনামে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে নাস্তিকতা দিয়ে। এখানে লেখক দেখিয়েছেন নাস্তিকদের চিন্তাভাবনা, তাদের নানান যুক্তি এবং স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে, ইসলামের বিধানের উপর তাদের আরোপিত প্রশ্ন ইত্যাদি। আর সেই প্রশ্নের জবাবও খুব সুন্দরভাবে বইটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে বইটি মূলত নাস্তিকতার প্রতিঘাতমূলক কোনো বই নয়, বরং এটি পশ্চিমাদের অনুশাসন ও অভিমতগুলো এবং তাদের প্রচলিত, নিকৃষ্ট মানের মন্তব্যগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। এগুলোর পিছনের পূর্বজ্ঞান করা অসার কল্পনাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার দূর্লভ এক কিতাবই হলো বক্ষ্যমাণ বইটি। অন্যান্য অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, নারীবাদ, হিজাব, বিজ্ঞানবাদ, লিবারেলিসম, নৈতিকতা ও প্রগতিবাদ, মডার্নিটি, সংস্কারপন্থী ও মডার্নিস্ট মুসলিম, যৌনতা ও যিনা, সংশয়বাদী ইত্যাদি সম্পর্কে। ‘পশ্চিমা সংশয়বাদী’ এবং ‘মুসলিম সংশয়বাদী’ -কে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে কেবলমাত্র বিরাগজনক অবস্থানকেই সংশয়বাদীর কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছে বক্ষ্যমাণ বইটিতে।

    প্রায় পনেরোশো বছর আগে ভালো কিংবা নৈতিক হওয়ার পদ্ধতি যেখানে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, সেখানে মডার্নিটি প্রতিস্থাপন করেছে লিবারেলিসমকে; যেখানে আল্লাহ বলেছেন মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে কাদামাটি থেকে, প্রথম মানুষ আদম (আঃ); সেখানে মডার্নিটির জবাব ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বই হলো মানব সৃষ্টির ইতিহাস। যদি জিজ্ঞেস করা হয় ‘তবে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি?’, তাহলে মডার্নিটি এ প্রশ্নের যথাযথ যৌক্তিক উত্তর দিতে অক্ষম। ট্রাডিশান আর মডার্নিটিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে আলোচ্য বইটিতে খুব সুন্দরভাবে লেখক উপস্থাপন করেছেন পরিপাটি, গোছানো অবয়বে। মডার্নিটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে হলে তো অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।

    বইটির বিশেষত্ব
    ➖➖➖➖➖
    ♦ বইটির প্রতি পৃষ্ঠায় অনুবাদক কিছু বিশেষ টার্ম তথা দার্শনিক পরিভাষা, থিওরি যুক্ত করে পাঠকদেরকে সেই টার্মগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দ্বারা পরিচয় করে দিয়েছেন টীকা সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে। এতে প্রতিটি পাঠক আরও ভালো ভাবে বিষয়গুলো রপ্ত করতে পারবে।

    ♦ যথেষ্ট সাবলীল, প্রাঞ্জল ভাষায় অনুবাদক বইটি উপস্থাপন করেছেন।

    ♦ আপাতদৃষ্টিতে বইটিতে একটু কাঠিন্য পরিলক্ষিত হলেও ভীষণ মনোযোগ সহকারে পড়লে সকল শ্রেণীর পাঠকই তৃপ্তি ভরে আস্বাদন করবেন বইটির সারনির্যাস এবং এর কন্টেন্টের গুণগত মান।

    ♦ বইটির অন্যতম বিশেষত্ব হলো বইটি পাঠককে ভীষণ ভীষণ রকম ভাবাবে। সামনের ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দেওয়া প্রায় প্রতিটা প্রশ্ন সহ উত্তরে পাঠক বিস্মিত হবে- এ যেন তারই মনের কথা।

    ♦ বক্ষ্যমাণ বইটি কেবল ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রশ্নের জবাব দিতে নয়, বরং তাদেরকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে শেখাবে। পাশাপাশি পশ্চিমাদের রীতিনীতি, কালচার সম্পর্কে পাঠককেও একজন ‘মুসলিম সংশয়বাদী’ হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করবে।

    সমালোচনা
    ➖➖➖➖
    যদিও সমালোচনা করার মতো তেমন কিছু পাইনি আর সেই যোগ্যতাও আমার নেই। আসিফ আদনান যথেষ্ট ভালো অনুবাদক। ওনার লেখার মান, পর্যায় একটু ভিন্ন- এ সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই অবগত। এর আগেও ওনার অন্যান্য বহু লেখাই পড়েছি। যদিও তিনি এই বইটি ভীষণ সাবলীল-সুখপাঠ্য করেছেন, তথাপি আরও একটু সুখপাঠ্য হয়তো করা যেত। পাঠকের কথা ভেবে মূল বইয়ের যে অংশ গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে, আমার মনে হয় সেগুলো জুড়ে দিলে আরও ভালো হতো। যারা পড়ার তারা সেই অংশটাও পড়তো, আর যারা না পড়ার তারা থাকলেও তা স্কিপ করে যেত। সুতরাং জ্ঞানপিপাসু পাঠকরা হয়তো আরও একটু বেশি উপকৃত হতো। আর কিছু জায়গায় বানান ভুল আছে, সম্ভবত সেটা টাইপিং মিসটেক। তবে একটা অনুরোধ, এমন একটি দারুণ বই হার্ডকভার হলে ভীষণ ভালো হতো।

    বইটির প্রয়োজনীয়তা
    ➖➖➖➖➖➖➖
    ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাসের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে খুব সহজেই প্রতীয়মাণ হয় দুই সময়ের বৈপরীত্য। তখনকার মুসলিম তথা সালাফগণ ওয়াহীর ব্যাপারে ‘আমরা শুনলাম এবং মানলাম’-কে অনুসরণ করতেন, আর এখনকার মুসলিমদের ৯০% – ই সংশয়বাদীর অন্তর্ভুক্ত। জাহান্নাম থেকে বাঁচার দু’য়া, জান্নাত লাভের মাসনুন জিকির-দু’য়া ইত্যাদি আমলের পর আমল দিয়ে জীবন সাজানোর পরও যদি একজন মুসলিমের মনে ইসলামের বিধিনিষেধের ব্যাপারে সংশয় গ্রাস করে, ঈমানের ভীত নড়বড়ে করে, তাহলে কি আদৌও কোনো লাভ আছে? নাকি এই সংশয়ের কারণে কিয়ামতের দিন সব আমল ধুলিকণায় পরিণত হবে? সুতরাং এমতাবস্থায়, এমন একটি চমৎকার মানের ব্যতিক্রমী বই নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তাই বর্তমান সময়ে এমন একটি দুর্দান্ত বই উম্মাহর জন্য কতটা সুকৃতি ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন আধ্যাত্মিক পাঠক কিংবা সচেতন মুসলিম নিশ্চয় এই গুরুত্বপূর্ণ বইটির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারছেন।

    পাঠ্যানুভূতি
    ➖➖➖➖
    বইটি পড়ার পর সর্বপ্রথম আমার এক কেমিস্ট্রি স্যারের কথা মনে এসেছিল। তিনি আমাদের অর্গানিক পড়াতেন। একজন সংশয়বাদীর উদাহরণ হিসেবে কেন জানি না হঠাৎ স্যারকেই মনে পড়লো। একবার স্যার ক্লাসে বলেছিলেন, “ইসলামের সব ব্যাপারেই কিছু না কিছু বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজে পাই, কিন্তু কুরবানীর ব্যাপারটা আমার কাছে আজও ক্লিয়ার নয়। একদিনে এতোগুলো পশু হত্যা হচ্ছে, এতে কি পরিবেশে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে না? একদিনে তো এতো পশু জন্মগ্রহণও করেনা।” ব্যক্তিগতভাবে আমি বরাবর আল্লাহর বিধানের ক্ষেত্রে ‘শুনলাম এবং মানলাম’কে অনুসরণ করতাম, করি। তাই সেদিন ওই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি, যদিও তখন ইলমও তেমন ছিলনা। তারপরও একজন মেয়ে হওয়ার জন্যই হয়তো ‘পুরুষের বহুবিবাহের’ ব্যাপারটা ঠিক হজম হয়না, মনে একটা কষ্ট হয়েই যায় – এই বিষয়টা নিয়ে ভাবলে তখন হাজার প্রশ্ন, হতাশ, মেয়েদের প্রতি অবিচার, দুঃখ ইত্যাদিতে নিপতিত হয় মন, হৃদয় হয় ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই ব্যাপারটাকে আমলে নিই না। নিজেকে তখন এই বলে সান্ত্বনা দিই, “নিশ্চয় একজন মুমিনা নারী স্বামী, মাতা-পিতা, সন্তান, সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ এবং তারপর আল্লাহর রসুলকেই অধিক ভালোবাসে।” তো বইটা পড়ার সময় ভূমিকাতে স্যারকে সংশয়বাদী মনে হলেও, উপসংহারে এসে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম “আমিও কি তবে সংশয়বাদী? আমিও কি এবার সংশয়বাদী হতে পারবো?”

    বইটি প্রথমদিকে একটু কঠিন, রসকষহীন লাগছিল। এটা নিতান্তই আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের এবং স্বল্প জ্ঞানের ব্যর্থতার কারণ। তবে একটু মনোযোগ সহকারে পড়ার পর বোধগম্য হয়েছে। অবগত হয়েছি বইটির মূল বিষয়বস্তু এবং সারমর্ম সম্পর্কে। আস্বাদন করেছি এর সারনির্যাস। আমার অবচেতন মনে সৃষ্টি হওয়া বেশকিছু প্রশ্নের উত্তরও পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে সেকুলারিজম, নারীবাদ, মডার্নিটি, বিজ্ঞানাবাদ, সংশয়বাদী অধ্যায় গুলো। বইটি একজন পাঠককে চিন্তার খোরাক জোগাবে। বারবার ভাবাবে নিজের অবস্থান সম্পর্কে।
    বইয়ের নামকরণ এবং প্রচ্ছদ সত্যিই ভীষণ অর্থবোধক হয়েছে। অবশ্যই এটা একজন সফল অনুবাদকের পরিচয়। এমন একটি ব্যতিক্রমী, চমৎকার মানের বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনী সহ বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে যেন আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করেন – এই কামনায় রইলো। আমিন।

    সংক্ষেপে বই পরিচিতি
    ➖➖➖➖➖➖➖
    বইয়ের নাম :- সংশয়বাদী
    মূল বই :- The Modernist Menace To Islam
    লেখক :- ড্যানিয়েল হাকিকাতজু
    অনুবাদক :- আসিফ আদনান
    প্রকাশক :- ইলমহাউস পাবলিকেশন
    পৃষ্ঠা সংখ্যা :- ২৬৬
    প্রচ্ছদ মূল্য :- ২৬০৳
    বাইন্ডিং :- পেপারব্যাক

  11. কামরুননাহার মীম

    প্রবৃত্তির অনুসরণে নিজেকে ব্যস্ত রাখা ব্যক্তির জীবনের একমাত্র সমস্যা ইসলাম। এই ইসলাম গণতন্ত্রের পথে বাঁধা, এই ইসলাম নারীবাদের বিপক্ষে, এই ইসলামের কারণে নফসের স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে, এই ইসলাম সেকুলারিজমকে তোয়াক্কা করেনা, ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, লিবারেলসম, গণতন্ত্রসহ নানা থিওরি ঠাঁই পাওয়ার পথের অন্তরায় এই ইসলাম। ইসলাম নামক সমস্যাকে(!) চিরদিনের জন্য ঝেড়ে ফেলতে তথাকথিত আধুনিক একদল দু-পেয়ে জীব মত্ত হয় সংশয় ছড়িয়ে দেওয়ার এক খেলায়। মুসলিমদের মাঝে নানা সংশয় প্রবেশ করানোর মাধ্যমে তারা বিভ্রান্তিতে ফেলতে চায় মুসলিমদের। আধুনিকতার নামে ইসলামকে ধ্বংস করার এই ষড়যন্ত্র চলছে ইউরোপীয় উপনিবেশের সূচনালগ্ন থেকেই। তারা জোর করে এমন এক সমাজব্যবস্থা আমাদের উপর ধীরে ধীরে চাপিয়ে দিয়েছে যেটা আজ সর্বজনীন আর চিরন্তন হিসেবে পরিচিত। পাশ্চাত্যের আধুনিক সেই রঙিন চশমা লাগিয়ে দুনিয়া দেখা ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে এই ফাঁদ না বুঝে সংশয়বাদী হয়ে উঠে। পশ্চিমাদের দেখানো মানদণ্ডে ইসলামকে দেখতে গিয়ে ধর্ম নিয়ে সংশয়ে ভোগে অনেক মুসলিম। আপনি কি সেই সংশয়বাদীদের তালিকার একজন? আপনার ইসলামকে বিচার করার মানদণ্ড কি আধুনিকতার সাথে বদলে গেছে?

    যখন সত্য আর মিথ্যের সংঘাত চলে, তখন সত্য কখনো পরাজিত হয়না মিথ্যের সম্মুখে। তেমনি দ্বীন ইসলামে থাকা ব্যক্তির জানা উচিত তার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সত্য, তার দ্বীন ইসলাম সত্য। আর এই অন্যসব বাতিল তত্ত্বের কাছে সে কখনো মাথা নত করবে না এবং সংশয় কুপোকাত করতে পারবেনা তাকে। কিছু গতানুগতিক প্রশ্নের মুখোমুখি মুসলিম প্রায়শই হয়; কিন্তু এর উত্তর যখন সে সঠিকভাবে খুঁজে পায়না, তখন সংশয়ের বীজ তার হৃদয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মগজ ধোলাইয়ের এই খেলায় এভাবেই আধুনিকতাবাদ জিতে যায় – আর পথভ্রষ্ট হয় মুসলিম। আধুনিকতার খোলসে তাদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসে, অবিকৃত ইসলামকে আদিম বলে আধুনিকীকরণের নামে তারা বিকৃত করে ইসলামকে। এভাবেই বাতিলের সাথে আপোষ করতে করতে দ্বীন থেকে একদিন ছিটকে পড়ে তারা। এই আধুনিকতাবাদের নানা তত্ত্বের অসারতা মুসলিম উম্মাহ’র সামনে প্রকাশ করার সময় আজ। এসব বস্তাভর্তি পঁচা, নোংরা মতবাদগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই ইসলাম ফিরে পাবে তার প্রকৃত মর্যাদা, লোকে বুঝবে প্রকৃত সত্য কোনটা। সংশয়ের সেই বীজ যেন আমাদের মাঝে গড়ে উঠতে না পারে, সংশয় প্রবেশের পূর্বেই যেন তাদের বিপরীতে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারি – সেই কাজকে সহজ করতে বিখ্যাত দাঈ লেখক ড্যানিয়েল হাক্বিকাতযু এর সংশয়বাদী বইটি। বইটি সকলের প্রিয় লেখক আসিফ আদনানের মাধ্যমে ইলমহাউজ পাবলিকেশন থেকে অনূদিত হয়েছে।

    বইটিতে তেরোটি মূল শিরোনামে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রথমে নাস্তিকতাবাদের মাধ্যমে সূচনা ঘটেছে বইয়ের আলোচনার। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের নাস্তিকতা ও আত্ন-উপাসনার মাধ্যমে জীবন ব্যয় করার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সুদীর্ঘকাল স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী এই লোক কল্পনাপ্রসূত এক থিওরি খুঁজতে খুঁজতে তিনি ব্যয় করেছেন নিজের জীবন। নাস্তিকদের লিবারেল-সেকুলারিসমের মাপকাঠি গ্রহণ, উদারতার আড়ালে জোরপূর্বক লিবারেল-সেক্যুলার ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়াই তাদের কথিত সমতা। বিজ্ঞানের নামে মানবের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করা ব্যক্তি মহাজগতের স্রষ্টার ব্যপারে সন্দিহান! নাস্তিকতার নামে কতই না নির্বুদ্ধিতার পরিচয় প্রতিনিয়ত তারা দিয়ে যাচ্ছে – যা তাদের বুদ্ধিমত্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমানের যুক্তিযুক্ত মানদন্ডের কথাও তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।

    গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নামক অধ্যায়ে সেকুলারিজম এর নামে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের নমুনার বাস্তব চিত্রসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার ধাপ্পাবাজি, সেকুলারিসমের আড়ালে সুইযারল্যান্ড ও জার্মানির চিত্র, ইসলামী শাসনের তুলনায় গনতন্ত্র উত্তম কিনা তার যুক্তিসঙ্গত আলোচনা বেশ ভালোভাবেই উঠে এসেছে।

    সাম্য, মুক্তি স্বাধীনতা নামক চমৎকার শিরোনামের অধীনে ইসলাম কেন ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সম্মান করেনা, ইসলামে মদ বৈধ নয় কেন, ইসলাম স্বাধীনতার ধর্ম কিনা, সমতা শেখায় কিনা, ইসলাম ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সমর্থন করে কিনা এবং এর পক্ষে বিপক্ষের আলোচনাগুলোকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

    এছাড়াও আধুনিক বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নারীবাদ, হিজাব সম্পর্কিত আলোচনাও বাদ যায়নি বইটিতে। আজকালকার নারীদের মধ্যে নারীবাদের বীজ রোপণ করার মাধ্যমে পরিবার ও ধীরে ধীরে সমাজকে ধ্বংস করার এক লড়াই চলছে। কেন নারীবাদীরা একসময় ইসলাম ত্যাগ করে, কীভাবে সে রিদ্দার দিকে অগ্রসর হয়, নারীবাদ মুসলিম নারীদের ইসলাম ত্যাগের কারণ কিনা, পুরুষকে নারীর উপর নির্যাতন করার সুযোগ ইসলাম করে দেয় কিনা সে সম্পর্কিত নানা বিভ্রান্তির খোলাসা করা হয়েছে এই অধ্যায়ে।

    মুসলিম নারীর পর্দার বিধান নিয়ে অন্যদের আপত্তির সীমা নেই আজ। তাদের মনে প্রবেশ করানো হচ্ছে যে বাধ্যতামূলক হিজাবের আইন তাদের উপর শোষণ। আসলেই কি তাই? হিজাব কি আমার চয়েস, হিজাব কি নারীর ক্ষমতায়ন, হিজাব কি ধর্ষণের বন্ধে কার্যকরী, হিজাবের কি কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই – এসকল নানা প্রশ্ন নারীর নিকট আসা খুবই পরিচিত। একজন নারী এসকল প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে না জানার কারণে প্রতুত্তরে না কোনো জবাব দিতে পারে, না সংশয় এড়াতে পারে। এই অধ্যায়ে অসাধারণভাবে নারীমনের এই দ্বিধার মোক্ষম জবাব দিয়েছেন লেখক।

    বিজ্ঞানবাদ নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে৷ কুরআন ও বিজ্ঞানকে এক সুতোয় বেঁধে মানুষের মধ্যে যেসকল বিভ্রান্তির সূচনা ঘটছে তা নিয়েও আলোকপাত করা হয়েছে এখানে। বিজ্ঞানের বাস্তবতা কতটুকু, ইসলাম ও বিজ্ঞানের সংঘর্ষের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে এখানে।

    লিবারেলিসম শিরোনামে লিবারেলিসম ও অজাচার, লিবারেলিসমের নৈতিক অগ্রগতি, লিবারেলিসমের মেকি সহিষ্ণুতার নামে অসহিষ্ণুতার বিস্তৃতি, এসকল মতাদর্শের ভন্ডামি ও প্রকৃত রুপকে তুলে ধরা হয়েছে।
    নৈতিকতা, প্রগতিবাদের আলোচনাও ঠাঁই পেয়েছে বইটিতে। নৈতিকতার যৌক্তিক গতিপথ কোনটা, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ধার্মিক হওয়া প্রয়োজন কিনা ইত্যাদি বিষয়ের সংশয় দূর করেছেন।

    এছাড়া মর্ডানিটি ও ইসলামের সংঘাত, আধুনিকতাবাদের ইতিহাস, এর বৈশিষ্ট্য, এর শাখা, নববী যুগের শ্রেষ্ঠত্বসহ আজকের মর্ডানিসমের পরিণতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন লেখক।

    সংস্কারপন্থী ও মর্ডানিস্ট মুসলিম এর মাঝের তফাত, মুসলিম বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের পশ্চিমা কৌশল, সংস্কারের নামে ভন্ডামির রূপরেখা, কমিউনিস্ট ইসলামের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা কী, প্রগতিশীল বা সংস্কারবাদীদের সাথে বিতর্ক করা জরুরি কিনা – এসকল নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। এছাড়াও বহুল প্রচলিত এক প্রশ্ন, “ইসলামই কি মুসলিম বিশ্বের পশ্চাৎপদতার কারণ কিনা” – এর উত্তর বেশ সুন্দর ও যৌক্তিকতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।

    যৌনতা ও যিনা নামক অধ্যায়ে পশ্চিমা বিশ্বের যৌন নির্যাতনের চিত্রায়ন, যৌন শিক্ষার প্রভাব, যিনা ও বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা, নারী পুরুষের মাঝের মেলামেশার পরিণতি ও ইসলাম, মিডিয়া জুড়ে যৌনতা প্রসারের কারণ, আজকের আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যৌনতা ফেরির রহস্যসহ কিছু বিষয় এই অধ্যায় জুড়ে আলোচিত হয়েছে।

    ইসলাম কি তলোয়ারের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে কিনা, সমকামী এজেন্ডা বাস্তবায়নের নীলনকশা – এই দুইটি বহুল আলোচিত বিষয়কেও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করে স্পষ্ট করে দিয়েছেন লেখক।
    সর্বশেষ অধ্যায় ” সংশয়বাদী” যার নামেই বইয়ের নামকরণ করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে লেখক তুলে ধরেছেন কীভাবে আমরা এসকল মতাদর্শের আবর্জনাকে মাথা থেকে বিদায় করে দিয়ে আত্নবিশ্বাসী হবো, অন্তরের মাঝের অসুখকে বিদায় করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সত্যের পথে ধাবিত হবো কীভাবে, কোন সে মূলনীতি যার মাধ্যমে আধুনিকতার মাঝে ইসলামকে বুঝব সঠিকভাবে – প্রভৃতি বিষয়ে। এছাড়াও মুসলিম সংশয়বাদী হওয়ার অর্থ কী, তার জবানবন্দি কেমন ইত্যাদি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে উপসংহার টেনেছেন বইয়ের।

    যেসকল মতাদর্শের আয়নায় সংশয়বাদী হয়ে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে অনেকে, তারা যেন বাতিল এইসব মতাদর্শের পেছনের আসল রূপটা খুঁজে পায়। সময় এসেছে আজ ধামাচাপা দেওয়া সত্যকে প্রকাশিত করার, সংশয়ের সৃষ্টিকে গুড়িয়ে দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের। এই ক্রান্তিলগ্নে মুসলিমদের উচিত সংশয় উদ্রেককারীর বিপক্ষে পালটা প্রশ্ন জুড়ে দেওয়া। আর সেই লক্ষ্যে নিজের মাঝের সংশয়কে দূর করা ও সত্যের আলোয় বলীয়ান হওয়ার জন্য বইটি সহায়ক হবে আশা রাখি।

    মুসলিমদের মাঝের চিন্তাভাবনা আজ বাতিলকে গ্রহণ করে নিয়েছে, পরাজয়কে বরণ করে নিয়েছে। আমি আমি করেই দিন কেটে যাচ্ছে আমাদের অথচ আশপাশটা জুড়ে শুধুই ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ। ষড়যন্ত্রের এই সূক্ষ্ণ চাল টা না বুঝেই ভয়াবহ এক দিনাতিপাত করছি আমরা। সংশয়ের বেড়াজালে ধুকে ধুকে “সিরাতুল মুস্তাকিম” হতে ছিটকে পড়ছি আমরা। হ্যাঁ, শেষ জয় টাও ইসলামের-ই হবে ইন শা আল্লাহ; কিন্তু দিগন্তের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এই আমি সংশয় ত্যাগ করে সত্যকে আঁকড়ে ধরতে পারব কি?

    সংক্ষেপে বই বৃত্তান্ত:
    বইয়ের নাম: সংশয়বাদী
    মূল বই: The Modernist Menace To Islam
    লেখক : ড্যানিয়েল হাকিকাতজু
    অনুবাদক : আসিফ আদনান
    প্রকাশক : ইলমহাউস পাবলিকেশন
    পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২৬৬
    প্রচ্ছদ মূল্য : ২৬০৳

Add a review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping cart
Sign in

No account yet?

ধন্যবাদ, আপনার প্রি-অর্ডারটি গ্রহণ করা হয়েছে।

আপনার যে কোন প্রশ্ন অথবা অর্ডারে কোন পরিবর্তনের জন্য ০১৮৪৪২১৮৯৪৪ নাম্বারে কল করুন ।