অন্যদের সাথে আমাদের পার্থক্য—আদর্শে। আমরা যে-আদর্শ ধারণ করি তা দুনিয়ার কাগজে-কলমে লেখা, মানুষের মস্তিষ্ক থেকে উদ্গিরিত, কোনো সভা-আলোচনা টেবিলে নির্ধারিত আর পুনঃপুন সংশোধিত হয় এমন কিছু নয়। আমাদের আদর্শের উৎস এমন এক সত্তা, যিনি সমস্ত সৃষ্টজগতের সৃষ্টিকর্তা। যিনি সমস্ত মাখলুকের লালন-পালনকর্তা। যিনি সমস্ত ভুল-ত্রুটি, সমস্ত বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু, যে সুমহান আদর্শ আমরা বুকে ধারণ করি, তা কি অতি প্রাকৃতিকভাবে আমাদের হৃদয়-মননে স্থাপিত হয়ে যায়? ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। দুনিয়ার কোনো আদর্শই এভাবে ধারণ করা যায় না। আদর্শকে ধারণ করার জন্য দরকার পড়ে চর্চার। যেখানে যে-আদর্শের চর্চা বেশি, সেখানে সেই আদর্শের বিস্তারও তত বেগবান।
আমরা বর্তমানে একটি কঠিন সময় অতিবাহিত করছি। আমাদের নাগপাশ সয়লাভ হয়ে আছে দুনিয়ার নানান তন্ত্র-মন্ত্র, বিশ্বাস-অবিশ্বাসে। এমন কঠিন বাস্তবতার যুগে, আমাদের সন্তানদের মাঝে দ্বিনের বুনিয়াদি আলো জ্বালানো অনেকটাই বরফে আগুন ধরানোর মতোই দিন দিন দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। ‘ঈমান’ হলো আমাদের ধর্মের একেবারে মৌলিক, একেবারে বুনিয়াদি বিষয়। ইসলামকে যদি আমরা একটি গাছের সাথে তুলনা করি, তাহলে ঈমান হলো সেই গাছের শিকড়ের মতো। শিকড় বিহীন গাছ যেমন অসম্ভব, ঈমান ব্যতীত ইসলামের ধারণাও তেমনি।
বিশ্বায়নের যুগে আমাদের সন্তানেরা কী শিখে বড় হচ্ছে, অন্তরে কোন জিনিস লালন করতে করতে বেড়ে উঠছে, তা কি আমরা জানি? আমাদের সন্তানেরা নিছক জৈবিক ক্রিয়ার ফসল নয়। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে পাঠানো আমানত। তাই শিশুকে আল্লাহর বিধান অনুসারে বড় করে তোলা কেবল দায়িত্ব নয়, অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে কীভাবে ঈমানের বীজ বুনে দিতে হবে, কীভাবে তাদেরকে পরিচয় করাতে হবে সুমহান আল্লাহর সাথে, তা কি আমরা জানি? কতজন বাবা-মা জানি? আমরা কি জানি কীভাবে শিশুর মনে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা তৈরি করতে হবে? কীভাবে তাকে জানাতে হবে পরকাল সম্পর্কে, ফেরেশতা সম্পর্কে? কীভাবে তাকে চেনাতে হবে নবী-রাসুলদের? শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য আমাদের ভাবনার অন্ত নেই। অথচ, শিশুর মনে ঈমানের বীজ বুনে দেওয়ার এই মোক্ষম মৌসুমে আমরা যেন খুবই উদাসীন।
শিশুকে ঈমানের বলে বলীয়ান করে গড়ে তুলতে প্রতিবন্ধকতার অন্ত নেই। আছে আমাদের অনীহা, উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতার দায়ও। তথাপি, পরবর্তী উম্মাহকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে আমাদের গা ঝেড়ে জেগে ওঠার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে ঈমানের সুরভি আনয়নের সঠিক কর্মপন্থা নিয়ে ড. আইশা হামদান রাহিমাহাল্লাহ লিখেছেন Nurturing Eeman in children বইটি। বইটিতে লেখিকা দেখিয়েছেন কীভাবে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের মনে ঈমানের বীজ বুনে দেবেন, কীভাবে ঈমানের সুরভিতে সুরভিত করে তুলবেন সন্তানদের হৃদয়-কানন। এই বইটির উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বইটি সন্তানের মনে ঈমানের কল্লোল জাগাতে যতখানি দরকার, বাবা-মার ঈমানের পারদের মাত্রা মাপতে এবং তা নতুন করে ঝালিয়ে নিতেও ততখানি আবশ্যক। বইটি প্রতিটি বাবা-মা তো অবশ্যই, প্রতিটি সচেতন মুসলিমের জন্যও একান্তভাবে জরুরি।
Ruponti Shahrin –
বইঃ শিশুর মননে ঈমান
ড. আইশা হামদান
প্রিয় অভিভাবক, আপনাকেই বলছি।
সন্তানকে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রত্যেক অভিভাবক চিন্তিত থাকেন। কিন্তু মুসলিম হয়েও ইসলামিক চেতনার আদর্শে অনেকেই বড় করতে চান না। পাছে ছেলে হুজুর বনে যায়। দাড়ি, টুপি এসব তো আনস্মার্ট। কিন্তু মৃত্যুর সময় যতই ঘনিয়ে আসে বাবা মায়েরা চান তাঁর সন্তান দুয়া করুক তাদের জন্য।
সন্তান মডারেট মুসলিম হবে নাকি প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হবে, নাকি হবে সদকায়ে জারিয়া তা নির্ভর করে গুড প্যারেন্টিং এর উপর।
এসব কথা বললাম, তাঁর কারণ, গতকাল থেকে গুড প্যারেন্টিং এর উপর একটা বই পড়ছি। শুধু ভালো বলবো না, ভালোর উর্ধ্বে।
শিশুর পরিচর্যায় ইসলামের অনুশাসন বা বিধানের বিকল্প নেই। পশ্চিমা বিশ্ব চাইল্ড কেয়ার বা চাইল্ড ডেভেলপমেন্টের নামে আমাদের যা কিছু দিয়েছে তা সবটাই ইহকালীন হলেও, বাস্তবিক অর্থে অকার্যকর।
বাবা-মা এবং সন্তানের ইহকালীন ও পরকালীন আখের গোছাতে চাইলে অভিভাবকদের জানতে হবে ইসলামিক বিধান।
এখানে একটি হাদিস না উল্লেখ করলেই নয়। সেটি হলোঃ
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
প্রত্যেক সন্তানই ইসলামী ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার মাতা-পিতা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে। যেরূপে চতুষ্পদ জন্তু পূর্ণাঙ্গ জন্তুই জন্ম দিয়ে থাকে, এতে তোমরা কোন বাচ্চার কানকাটা দেখতে পাও কি?
এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেনঃ (আরবী)
“আল্লাহ্র ফিতরাত, যার উপর তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টি রহস্যে কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল প্রতিষ্ঠিত দীন।”
(সূরা আর রূম: ৩০)।
(সহীহবুখারী ১৩৫৮, মুসলিম ২৬৫৮, আহমাদ ৭১৮১)
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তাই তিনিই ভালো জানেন কোন কর্মপন্থা আমাদের জন্য সঠিক। এখন তো বাবা-মায়েরা চাকরি-বাকরি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন, যার ফলশ্রুতিতে বাচ্চাকে গুণগত সময় দিতে পারেন না। কর্মচঞ্চলতা ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য অনেক সময় পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে উপার্জনের পেছনেই দৌড়াতে হয়। এতে সবসময় দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু সবসময় সমস্যাটাকেই আমরা দেখি, সমাধান বাৎলে দেয়ার সময় কি আমরাই পাশে থাকি?
এই বইটি সমস্যা নয়, বরং সমাধান নিয়ে আলোচনা করে।
বাবা-মা হিসেবে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব অপরিসীম। বাচ্চারা তাই-ই শিখে যা তাদের বাবা-মাকে তারা করতে দেখে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তাই হাতে ধরে শেখালে যেটুকু অনীহা দেখায়, তা নিজে দেখে রপ্ত করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে তারা।
ছোট থেকেই তাদের মুসলিম ও মুমিনের পার্থক্য শেখানোর গুরুত্ব আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। সেক্ষেত্রে ইসলামী আকীদা বা বিশ্বাস পরিশুদ্ধ অভিভাবকই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যেহেতু পরিবার, সন্তানাদি, সম্পদ এগুলো আল্লাহর অগণিত পরীক্ষাগুলোর মধ্যে মূল, তাই বাবা ও মায়ের সমান ও পৃথক কিছু দায়িত্ব আছে। যা জেনে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে। এমনকি বিবাহের সময় দ্বীনদারীকে এজন্যই ইসলাম প্রাধান্য দেয়।
এখন মায়েরা, মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে অসম্মানিত বোধ করেন। অথচ পূণ্যবান সন্তান পেতে হলে আগে পূণ্যবান মা হয়ে উঠতে হবে। ইসলামিক জ্ঞান ও শিক্ষা বলতে আমরা যা কিছু বুঝি, সেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথ সম্পর্কে খুঁটিনাটি চেকলিস্ট থেকে জেনে নেয়া জরুরি।
শিশুর মননে ঈমানের বীজ গেঁথে দিতে আল্লাহ, ফেরেশতা, নবী-রাসুল, দুনিয়া, মৃত্যু, কিয়ামাত, আখিরাতের জীবন সম্পর্কে একটু একটু করে শেখালে, বড় হয়ে এগুলো তার জন্য ভারী হয়ে যায়। অনেক ব্যাসিক জ্ঞান না থাকার কারণে তাকদিরের মত বিষয়গুলো নিয়ে সে হয়ে পড়ে সংশয়বাদী। তখন ঈমান ও আখলাক দুটোই বিপর্যস্ত হয়।
বড় ও ছোটদের সাথে সঠিক আচরণ সুগঠনের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিত্ববান মুসলিম হয়ে ওঠার পাশাপাশি ইসলামকে বিশ্ব পরিমন্ডলে পরিচয় করে দেয়া ও মুসলিম হিসেবে গর্ববোধ করার শিক্ষাও পরিবার থেকেই আসে। এই আত্মমর্যাদার জন্য চাই পরিবেশ। ঘরের পরিবেশ যখন জ্ঞান, সালাত, সালাম দিয়ে পরিপুর্ণ হবে তখনই তা সহজ হবে।
তাছাড়া সমাজের মানুষের সাথে বসবাস করতে হলে বন্ধুর প্রয়োজন তো আছেই। কেমন বন্ধু নির্বাচন করতে হবে, সেটাও তাকে শেখানোর জন্য অভিভাবকের নিজের আখলাকের ঘষামাজা করে নেয়া উচিত। এতে করে সাধারণ সমাজের চেয়ে মুসলিম সমাজের উন্নত অবকাঠামোই শিশুর মননে ঈমানী শক্তি সঞ্চারিত করতে পারে।
ফলাফল, আপনি গড়ে তুলবেন আপনার জন্যই সদকায়ে জারিয়া।