অমুসলিমদের সাথে যেমন ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (হার্ডকভার)

পৃথিবী তখন ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন। অন্যায়-উৎপীড়ন, অনিয়ম-অবিচার, জুলুম-অত্যাচারের জাঁতাকলে পিষ্ট সমাজ জীবন। পাপ দখল করেছিল পুণ্যের জায়গা, শান্তিকে হত্যা করেছিল অশান্তি, সত্যের গদি ছিনিয়েছিল মিথ্যা। বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণির অস্ফুট স্বর শোষকের গর্জনের কাছে ক্ষীণ হয়ে আসে। ঠিক তখন আবির্ভাব হয় এক মহামানবের, রাহমাতাল্লিল আলামিনের ﷺ। ঘন অন্ধকারে তিমির বিদীর্ণ করে সুবহে সাদিকের আলো হয়ে ফুটে উঠলেন তিনি। মরুভূমিতে যেন ফুলফোটা-পাখিডাকা বসন্তের আগমন!
.
তো কেমন ছিল তাঁর আদর্শের মশাল; যা দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আলোর দিশা দেখিয়েছিলেন? কেন তাঁর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ডাকা হতো ‘আল-আমিন’ নামে? কেন তাঁর চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হয়েছিল অসংখ্য বিধর্মী? কেন এত বছর পরেও তাঁর আদর্শই সর্বোৎকৃষ্ট? কী করে হয়ে উঠেছিলেন অমুসলিমদেরও আস্থাবাজন, প্রিয়জন?
.
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ‘পথিক প্রকাশন’ এনেছে ‘ড. রাগেব সারজানি’র গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ “অমুসলিমদের সাথে যেমন ছিলেন রাসূল (সাঃ)” বইটি।
.
ড. রাগেব সারজানি বর্তমান সময়ের একজন আলোচিত লেখক; নন্দিত ইতিহাসবিদ। ইতিহাসের পাশাপাশি সীরাতের নানা অধ্যায় নিয়েও বেশ কিছু লিখালিখি করেছেন। ইসলামের ইতিহাসকে মিথ্যা অপবাদ থেকে পরিশোধন করতে তিনি কঠোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তার রচিত “আমরা আবরাহার যুগে নই, আন্দালুসের ইতিহাস, তাতারীদের ইতিহাস, ক্রুসেড যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের পাশে থাকুন এবং মুসলিমজাতি বিশ্বকে কী দিয়েছে”— নামক বইগুলো পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
.
.
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি মূলত রচিত হয়েছে অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ’র ﷺ আচরণ বিষয়ে। রাসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক বিভিন্ন শ্রেণির অমুসলিমদেরকে সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সদাচরণ, ন্যায়পরায়ণতা এবং বিশেষ করে শত্রু নেতাদের প্রতি তাঁর মহানুভবতার চমৎকার বিবরণ লেখক গ্রন্থটিকে ৬টি অধ্যায়ে ভাগ করে বিস্তারিতভাবে পেশ করেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের আদলে রয়েছে আবার বেশ কিছু পরিচ্ছেদ।
.
নবির দাওয়াতি-জীবনের অনেক ঘটনা এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। অমুসলিম জালেমদের কটুক্তি-অত্যাচারের প্রতিত্তুরে নবীজির মহানুভবতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। কী করে তিনি অত্যাচার সহ্য করে পরাজিত করলেন অত্যাচারীকে, ভালোবেসে বশ করলেন শত্রুকে! কী করে রক্তস্নাত মরুর ধূলায় আবার প্রতিষ্ঠা করলেন মানবতার, অসত্যের রাজ্যে সত্যকে ফিরিয়ে দিলেন নিজের গদি! তাঁর আদর্শের সুবাসে সিক্ত হলো নিপীড়িতদের তৃষিত মন, বিধর্মীদের হৃদয়ে নিয়ে এলো সখ্য-মিতালি ও ন্যায়বোধ।
.
অমুসলিমদের সাথে কেমন হওয়া উচিত আমাদের আলাপচারিতা, লেনদেন, আত্মীয়-প্রতিবেশী হিসেবে তারা কি মুসলিমদের মতোই হকদার— এসব বিষয়ক বর্ণনা তুলে ধরে নববী আদর্শে আদর্শিত হওয়া উপায় বলে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এ গ্রন্থে কেবল ঐসব অমুসলিমদের সাথে রাসূলের আচরণ প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে যারা ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত যিম্মি বা যুদ্ধরত নয় এমন অমুসলিম। যারা দারুল-হারবে ইসলামের বিরুদ্ধে সদা-তৎপর কট্টরপন্থী অমুসলিম, কুরআনে যাদেরকে আমাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের আলোচনার জন্য এই গ্রন্থ নয়।
.
.
‖পাঠ্য অভিমত‖
বইটা বেশ তথ্যবহুল। সবকটি উদ্ধৃতি, ঘটনা রেফারেন্সসহ আছে, হাদিসের মানও দেওয়া হয়েছে। সাধারণ পাঠকের কথা মাথায় রেখে অসংখ্য জায়গায় প্রয়োজনীয় টীকা সংযোজন করা হয়েছে। নানান বিষয়ে পর্যালোচনার সময় তালিবুল ইলম ও ইতিহাসে আগ্রহী পাঠকদের অধিক জানার স্বার্থে লেখক টীকায় সে বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য-উৎসের জানান দিয়ে দিয়েছেন। বইটির পঠনে আমরা দাওয়াতের নববীপন্থা সম্পর্কে অবগত হতে পারবো। বইটির প্রচ্ছদ নজরকাড়া আর ভিতরের পৃষ্ঠাসজ্জাও সুন্দর লেগেছে। তবে কিছু জায়গায় ব্যক্তিগতভাবে অনুবাদের প্রাঞ্জলতার কমতি লক্ষ করেছি।
.
মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রোপাগান্ডা চালানো হলেও এর মূল হোতা কিন্তু খুবই কমসংখ্যক মানুষ। তবে অধিকাংশ অমুসলিমই তথ্য-সন্ত্রাসীদের চক্রান্তের শিকার। হলদে-মিডিয়া ইসলামকে যেভাবে বিকৃত করে উপস্থাপন করছে, মানুষ তাই গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে। তাই আমাদেরকেই নিজেদের ধর্মকে উপস্থাপন করতে হবে। নবীজির বাতলানো পথে অমুসলিমদের সাথে মিশে ইসলামের সৌন্দর্য মেলে ধরতে হবে, তবেই আমাদের দাওয়াতের কার্যক্রম সফল হবে। রাসূল ﷺ প্রেরিত হয়েছেন ‘রহমত’স্বরূপ, তবে তা কেবল মুসলমানদের জন্যই নয় বরং সর্বস্তরের মানুষের জন্যও; বিরোধিতাকারী অমুসলিমদের সাথে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণই এবিষয়ের খোলাসা করে দেয়। নববী শিষ্টাচারের মাধ্যমে ইসলামের আলোয় উজালা করতে হবে তাদের হৃদয়-বন্দর; যা তরঙ্গের মতো হৃদয়-তন্ত্রীতে বেজে ওঠবে, ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে একান্ত অন্তরঙ্গ মূর্ছনায়। নবি জীবনের এক ভিন্ন অধ্যায়কে জানতে বইটি পড়ে দেখা উচিত।