বোধ হবার পর থেকে মানুষ একটা ঘোরের টানে ছোটে৷ বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ—কেউ এর বাইরে নয়৷ যেন তারা স্বপ্ন দেখছে৷ স্বপ্নের মধ্যে ছুটে চলছে নিরন্তর৷ এই হাসছে, এই কাঁদছে, এই উড়ছে, এই পড়ে যাচ্ছে—এলোমেলো সেই স্বপ্নের নেই কোনো মাথা নেই কোনো মুণ্ডু৷ তারপর হঠাৎ যখন মৃত্যুঘণ্টা বাজে, যেন অ্যালার্মের কড়কড় শব্দে আচমকা ঘুম ভাঙে সবার৷ জেগে দেখে সময় শেষ—দুয়ারে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদূত৷
একটু সচেতন থাকলে সময় থাকতেই জেগে ওঠা সম্ভব৷ দুনিয়ার যে-মোহে আমরা এত বিভোর, তা কাটানোর উপায় বলা থাকছে এই বইতে৷
Rehmatullah Sojol –
দুনিয়ার প্রতি আমাদের একটা প্রবল মোহ কাজ করে। এই মোহের কারণেই আমরা ভুলে যাই মৃত্যুকে। ভুলে যাই আমাদের আসল গন্তব্যের কথা। অথচ হাদীসে নববীতে আমাদের বলা হয়েছে, দুনিয়াতে মুসাফিরের মতো থাকতে। বেশি বেশি স্মরণ করতে বলা হয়েছে মৃত্যুকে।
দুনিয়ার প্রতি আমাদের মোহের কারণ হলো, দুনিয়ার জীবন নিয়ে আমাদের অনেক বেশি আশা-আকাঙ্ক্ষা আর মৃত্যুর বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা।
আর আমাদের সামনে দুনিয়া নিয়ে এত বেশি আকাঙ্ক্ষার অসারতা এবং মৃত্যুর বাস্তবতা তুলে ধরতে হাম্বলী মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম ইবনু কুদামা মাকদিসি রাহিমাহুল্লাহ রচনা করেছেন তার ‘জিকরুল মাওত ওয়ামা বা’দুহু’ নামক গ্রন্থটি। যেটা বাংলায় ভাষান্তর করেছেন – শাহরিয়ান নাজিম শিহাব। অনূদিত বইটির নাম দেওয়া হয়েছে – মোহভঙ্গ (দুনিয়াসক্তি কাটাবেন যেভাবে)। বইটি প্রকাশ পেয়েছে ‘ইলহাম’ নামক প্রকাশনী থেকে।
• বইটির বিষয়বস্তু:
বইটিতে রয়েছে ছোট আকারের মোট উনিশটি অধ্যায়। মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে ‘আভাস’ নামক প্রারম্ভিক আলোচনায় মৃত্যুশয্যার এতো সুন্দর একটা দৃশ্যপট উঠে এসেছে যা পাঠকের মনে বইটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে ফেলার ক্ষুধা জাগিয়ে দিবে। এরপর প্রথম অধ্যায়ের শুরু থেকে তৃতীয় অধ্যায়ের শেষ পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে মৃত্যু-স্মরণ, মৃত্যুচিন্তার মাহাত্ম্য এবং দুনিয়াতে বেশি আকাঙ্ক্ষা করার অসারতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে, মৃত্যু নিয়ে দুনিয়াকামী মানুষের গাফিলতি ও মৃত্যুর সময়কার যন্ত্রণা বিষয়ক আলোচনা। এরপর নবিজির সা. মৃত্যু, চার খলিফার মৃত্যুসহ আরো কিছু সাহাবীর মৃত্যুর সময়কার কিছু ঘটনা আলোচিত হয়েছে ষষ্ঠ অধ্যায় থেকে একাদশ অধ্যায় পর্যন্ত। এরপরের অধ্যায়গুলোতে ধাপে ধাপে এসেছে, মৃত্যুর আসল রুপ, কবর, কবর জিয়ারত, কিয়ামত দিবসে পুনরুত্থান, জান্নাত-জাহান্নাম এবং আল্লাহর অপার দয়া নিয়ে হৃদয়স্পর্শী আলোচনা। সবশেষে, ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহি. এর দেওয়া জান্নাতের বর্ণনার অনুবাদে দেখানো হয়েছে ‘জান্নাতের এক টুকরো ছবি’।
• পাঠানুভূতি: বইটি আমাকে মৃত্যু নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। একেবারে ‘কানে ধরিয়ে’ দেখিয়ে দেখিয়েছে দুনিয়ার জীবনের আসল চিত্র। প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচনাই মন ছুয়ে গেছে একেবারে।
• বইটির ভালো দিক:
বইটির ভাষাশৈলী এক কথায় অসাধারণ লেগেছে। এতো ঝরঝরে আর সাবলীল অনুবাদ খুব কম বইয়েই পেয়েছি। ভাষাগত দিক থেকে অনুবাদক ও সম্পাদক সাহেবেরা যে চমৎকার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। প্রচ্ছদ আর পৃষ্ঠাসজ্জাও মাশাআল্লাহ দারুন লেগেছে।
• সমালোচনা:
বইটিতে সালাফদের নামের শেষে ‘রাহিমাহুল্লাহ’ বা এ জাতীয় কোনো শব্দ আনা হয়নি। তথ্যসূত্রগুলো দেওয়া হয়েছে একেবারে বইয়ের শেষে যার কারণে সূত্রগুলো দেখতে একটু বেগ পেতে হয়। সামগ্রিক দিক বিচারে বইটির দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রাখা হয়েছে। বইটিতে কিছু অগ্রহণযোগ্য হাদীস এসেছে, যেগুলো প্রান্তটীকায় উল্লেখ করে দেয়া আছে। আর সালাফদের কিছু বাণী এসেছে যেগুলোর কোনো সূত্র দেয়া হয়নি।
পরিশেষে বলবো, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার “খাও-দাও ফুর্তি করো, লাইফটা মস্ত বড়” টাইপের বাক্যের অসারতা অনুধাবন করতে এবং নিজের ভেতরে সবসময় ‘অন্তীম গন্তব্যে’র চিন্তা জাগরুক রাখতে বইটি অবশ্যপাঠ্য।
• সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
বই – মোহভঙ্গ (দুনিয়াসক্তি কাটাবেন যেভাবে)
লেখক – ইবনু কুদামা মাকদিসি রাহিমাহুল্লাহ
অনুবাদক – শাহরিয়ান নাজিম শিহাব
প্রকাশনী – ইলহাম
বইয়ের ধরণ – হার্ডকভার
পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৮০