আজকে যে বই টি নিয়ে আলোচনা করব তা হলো বাংলা ভাষায় লিখিত ঈমান ও আক্বীদার উপর লিখিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ও বৃহত বইয়ের মধ্যে অন্যতম। এই বিষয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা সমৃদ্ধ অন্য কোনো বাংলা বই আছে কিনা আমার জানা নাই। বইটি লিখেছেন বাংলাদেশের একজন অন্যতম বড় আলিম মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন। লেখক আক্বিদাগত ভাবে আশআরি ও মাতুরিদী ঘরানার। এবং তিনি এই বইটা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই রচনা করেছেন। বইটি প্রকাশ করেছে মাকতাবাতুল আবরার।
বই টি দুই বৃহত ভাগে বিভক্ত।
প্রথম ভাগেসূচনায় আছে ইলমে কালাম ও আশআরি/মাতুরিদী আক্বীদার পরিচয়।
তারপর শুরু হয়েছে প্রধান অংশ : সঠিক আক্বীদার বিবরণ অর্থাত আমাদের কি কি বিষয়ে ইমান রাখতে হবে তার বিস্তারিত আলোচনা। এখানে উনি একে একে মহান আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতা, নবী-রাসুল, আসমানী কিতাব, আখিরাত ও তাকদীর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
এই ভাগে উনি ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ তথা শিরক নিয়েও আলোচনা করেছেন। যেমন রাশিফল, পাথর, তাবিজ, মাজার পূজা ইত্যাদি।
দ্বিতীয় অংশে উনি বিভিন্ন পথভ্রষ্ট ফেরকা ও ধর্ম নিয়ে আলোচনা করেন। প্রথমে প্রাচীন ফেরকা যেমন খারেজি, শিয়া, মুতাজিলা, মুরজিয়া দের ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর বর্তমান কালে প্রচলিত বিভিন্ন ফিরকা যেমন কাদিয়ানী, বাহাই ইত্যাদি ফিরকা নিয়ে আলোচনা করেন।
উল্লেখযোগ্য এই যে এই অংশে উনি গায়রে-মুকাল্লিদ / আহলে হাদিসদের সমালোচনাও করেন। কিন্তু প্রথমেই উনি উল্লেখ করে নেন যে গায়রে-মুকাল্লিদ / আহলে হাদিসদের আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাহরই অন্তর্ভুক্ত, শুধু কিছু বিষয়ে তিনি তাদের বিভ্রান্ত মনে করেন – যেমন মাজহাব বিরোধিতা ।
এরপর উনি এদেশের কিছু প্রখ্যাত ভন্ডপীর দের সরূপ তুলে ধরেন -যেমন দেওয়ানবাগী, সুরেশ্বরী, চন্দ্রপুরী ইত্যাদি। এরপর উনি আলোচনা করেন প্রচলিত বিদয়াত নিয়ে।
এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কুফরী মতবাদ যেমন সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরেপেক্ষতাবাদ ইত্যাদির অসারতা ও ইসলামের সাথে তাদের বিরোধ তুলে ধরেন।
সবশেষে উনি বর্তমান বিশ্বের বড় বড় ধর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও তাদের পথ্ভ্রষ্টতা আলোচনা করে বইটি শেষ করেন।
৭০০ + পৃষ্ঠার এই বইটিতে আমরা আমাদের সঠিক আক্বীদার দিশা পাই ও ও পাই ভ্রান্ত আক্বিদা ও বিশ্বাস থেকে বেঁচে থাকার পথনির্দেশনা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই যা সকলের একবার হলেও বইটি পড়া উচিত।
Mahbubul Islam Borshon –
বইটি মূলত দুটি খন্ডে বিভক্ত। বইটির নাম দেখেই হয়তো বিষয়টা বুঝতে পারছেন। প্রথম খন্ডে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও দ্বিতীয় খন্ডে বাতিল ফিরকা ও ভ্রান্ত মতবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর এই দ্বিতীয় খন্ডই এই বইয়ের মূল আকর্ষণ বলে আমি মনে করি।আকীদা বিষয়ে বাংলায় অনেক বই থাকলেও বাতিল ও ভ্রান্ত মতবাদ নিয়ে এরকম বিস্তারিত কোন বই আমার চোখে পড়ে নি। ৭১৩ পৃষ্ঠার এই বিশাল বইয়ের ৫০০পৃষ্ঠাই দ্বিতীয় খন্ড! আর এ দিকটা নিয়ে এরকম একটা বিস্তারিত বইয়ের খুব দরকার ছিলো। কেননা সত্যের পথ জেনে নেয়া আল্লাহ পছন্দ করেন, যেন সে পথকে ভালবেসে সে পথে চলা যায়। আর বাতিলের পথসমূহ জেনে নেয়াও আল্লাহ পছন্দ করেন, যেন সে পথকে ঘৃণা করে সে পথ থেকে সরে থাকা যায়। কল্যাণকে বাস্তবায়নের জন্য কল্যাণের পথ জেনে নেয়া যেমন একজন মুসলমানের জন্য কাম্য, তেমনি অনিষ্টের পথসমূহ থেকে সতর্ক থাকার জন্য সেগুলো জেনে নেয়াও তার জন্য কাম্য। এজন্য সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সাব্যস্ত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ ‘মানুষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস করত। আর অনিষ্ট আমাকে পেয়ে বসবে এ ভয়ে তাকে আমি অনিষ্ট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম’।
উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ’যে ব্যক্তি জাহেলিয়াত সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, সে ইসলামের মধ্যে প্রতিপালিত হলে ইসলামের রশি একটি একটি করে ছিঁড়ে যাবে।’
আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
“এভাবে আমরা আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি; আর যেন এতে অপরাধীদের পথ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।”[সূরা আল-আন’আমঃ৫৫]
যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বাতিল সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবো; সে কিভাবে কাজ করে, কিভাবে সে মানুষকে ধোঁকা দেয়, কিভাবে আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে – এগুলো না বুঝবো; ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা না জেনে, না বুঝে প্রতিনিয়ত তারই পরিকল্পনাগুলো সফল করতে বিনা পারিশ্রমিকে তার হয়ে কাজ করতে থাকবো। তাই বাতিল ও ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে সচেতন থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কুরআন-হাদিসের আলোকে নিজের আকীদা-বিশ্বাসকে সহীহ করা। তাই লেখক প্রথমেই এই আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রথম খন্ডকে লেখক দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায় ঈমান ও আকাঈদ বিষয়ক আর প্রথম অধ্যায় অর্থাৎ বইয়ের শুরুটা করেছেন বহুল আলোচিত স্পর্শকাতর একটি বিষয় ইলমে কালাম বিষয়ক আলোচনা দিয়ে। ইলমুল কালাম কি? এর নামকরণের রহস্য, এর সূচনা, বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করেছেন সেই সাথে এর বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ রয়েছে তার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। অধ্যায়ের শেষের দিকে লেখক আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মধ্যকার ইলমে কালামের দুটি প্রসিদ্ধ দল অর্থাৎ আশআরিয়্যা ও মাতুরীদিয়্যা- দের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং কিছু বিষয়ে তাদের মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে প্রথম অধ্যায় শেষ করেছেন। আর দ্বিতীয় অধ্যায়েই মূলত লেখক ঈমান ও আকাঈদের মূল আলোচনা করেছেন।
প্রত্যেক ক্ষেত্রেই লেখক কুরআন-হাদিস এবং এদের ভিত্তি করে উলামায়ে কেরামের যে গবেষণা তা থেকে দলিল দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যেহেতু এটা আকীদার বই সেহেতু কুরআন হাদিসের বাইরে যে কিছু কিছু বিষয় লেখক এই বইয়ে উল্লেখ করেছেন সেগুলো লেখক এই বইয়ে না আনলেও পারতেন। তাহলে বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পেতো বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। যেমন বুযুর্গদের কাশফের মাধমে জানতে পারা গাউছ, কুতুব, আবদাল সহ ১২ ধরনের আউলিয়া এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নির্দিষ্ট সংখ্যায় এদের অবস্থান সম্পর্কিত যে ধারণা। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বর্তমানের আলোচিত বেশ কিছু বিষয়ের আলোচনায় লেখক গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিলের অনুবাদ করেন নি। শুধু আরবী ইবারত তুলে দিয়েছেন। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টা পুরোপুরি পরিষ্কার নাও হতে পারে। একটি উদাহরণ দেই। বর্তমানে আমরা ওছিলা বিষয়ে সালাফি উলামাদের সাথে একটা বিষয়ে মতোবিরোধ দেখতে পাচ্ছি। সালাফি উলামায়ে কেরাম মনে করেন মৃত ব্যক্তির ওছিলা দিয়ে দু’আ করা যাবে না তাই আল্লাহর রাসূলের সাঃ ওছিলা দিয়েও এখন দু’আ করা যাবে না। এর খন্ডন করতে গিয়ে লেখক হাদিস থেকে একটি মাত্র দলিল এনেছেন কিন্তু হাদিসটির অনুবাদ করেননি। এক্ষেত্রে অনুবাদ করে দিলে আমার মতে ভালো হতো। এছাড়া লেখক অনেক উর্দু শব্দ ব্যবহার করেছেন। এর পরিমাণটাও একটু কমালে ভালো হতো বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।
বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডে বাতিল ফিরকা ও ভ্রান্ত মতবাদ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই খন্ডকে লেখক ৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। বাতিল প্রাচীন আধুনিক এ’তেকাদী ফিরকাসমূহ, দেশিয় ভন্ড পীর, প্রাচীন ও আধুনিক সকল রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদ, বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম, বাতিল দার্শনিক মতবাদ
নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
দ্বিতীয় খন্ডের যে বিষয়টা সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হচ্ছে লেখক গতানুগতিক ভাবে বাতিল ফিরকাগুলোর শুধু আকীদা উল্লেখ করেই তার খন্ডন করেননি বরং প্রথমে এসকল ফিরকার ভ্রান্ত আকীদা তাদেরই বইয়ের উদ্ধতিসহ অর্থাৎ তাদের কোন আকীদা তাদের কোন বইয়ে আছে তা বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তাদের বক্তব্য, তাদের যুক্তি প্রথমে তুলে ধরে তারপরই তার খন্ডন করেছেন। এক কথায় ব্যাপারটা অসাধারণ লেগেছে। দ্বিতীয় খন্ড পড়তে গিয়ে আমি লেখকের জ্ঞানের পরিধির বিস্তৃতি দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি। মুলত দ্বিতীয় খন্ডের জন্যই আমি সবাইকে বইটি পড়ার অনুরোধ করবো। কিছু কিছু বিষয়ে লেখকের সব কথার সাথে আপনি একমত নাও হতে পারেন বাট লেখকের অগাঠ পান্ডিত্য থেকে যে ভীষণভাবে উপকৃত হবেন ইনশাআল্লাহ, এতটুকু বলতে পারি।