আমলের প্রাণ হলো ইখলাস। যে আমলে ইখলাস নেই, সে আমল প্রাণহীন শরীরের মতো। প্রাণহীন শরীর যেমন ওই ব্যক্তির কোনো কাজে আসে না; কেউ তাকে আক্রমণ করলে প্রতিহত করতে পারে না—ইখলাসবিহীন আমলও তেমন। পরকালে সে আমল কোনো কাজে আসবে না।
একজন মানুষ গভীর রাতে পুরো পৃথিবীতে পিনপতন নীরবতা নেমে আসার পর জায়নামাজে দাঁড়িয়েছে, অনেক রাকআত তাহাজ্জুদ নামায পড়ছে; কিন্তু তার অন্তরে যদি এ কথা উদয় হয় যে, আমি আসলেই কত বড় আল্লাহওয়ালা—গভীর রাতে সবাই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার পর আমি নামায পড়ছি! সে নামাযের কোনো মূল্য নেই আল্লাহর কাছে। আরেকজন জনসমক্ষে শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য নামাযে দাঁড়িয়ে গেল, দুনিয়ার সবাই তাকে দেখলেও তার নামায আল্লাহর কাছে কবুল হবে।
কুরআন-হাদিসের জায়গায় জায়গায় ইখলাসের কথা এসেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমার আমলকে ইখলাসপূর্ণ; তথা খাঁটি করো। অল্প আমলই পরকালে তোমার মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে।’
শায়খ সালিহ মুনাজ্জিদ বিভিন্ন কিতাবের পাতা চষে বেড়িয়ে আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন ইখলাস সম্পর্কে চমৎকার তথ্যবহুল এ বইটি। এ বইতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, কীভাবে রিয়া তথা লৌকিকতামুক্ত ইবাদত করতে হবে, কীভাবে ইবাদত করলে আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে।
Muhammad Rafsan Nasir –
ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন _ “ইখলাসবিহীন আমলের নমুনা ঐ মুসাফিরের মতো, যে একটি ময়লা পানি ভর্তি পাত্র বহন করছে। অনেক কষ্ট করে সে পানির পাত্রটি বহন করে, কিন্তু পানিতে ময়লা থাকায় এটা তার কোন উপকারে আসে না।” মায়াযাল্লাহ! (আল্লাহর আশ্রয় চাই)।
ইখলাস শব্দটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যাপক অর্থবোধক। ইহা এমন এক সেনসিটিভ বিষয় যেটা প্রত্যেক আমলের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইখলাস মূলত অন্তরের বিষয়, যে সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা ছাড়া অন্য কেউ অবগত নন। ইখলাসের মর্মই হলো, মানুষ যে আমলেই করবে তার উদ্দেশ্য থাকবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং এ-উদ্দেশ্যের সঙ্গে অন্য কোন প্রবৃত্তিজাত উদ্দেশ্য না থাকা। এক কথায় বলতে গেলে _ কলুষমুক্ত কাজকে ইখলাস বলা হয়।
বইটির নাম থেকেই বিষয়বস্তু সহজেই অনুমেয়। চলুন, বইটি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। বইটি মূলত ৫৫ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট সংক্ষিপ্ত কলেবরের একটি বই। বইটিতে মোট ১০ টি মূল শিরোনামের আলোকে ইখলাসের বেসিক ধারণা থেকে শুরু করে ইখলাস সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় নিয়ে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় সারগর্ভ আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। যেমন _” ইখলাসের সংজ্ঞা, কুরআন ও হাদিসের আলোকে ইখলাস, ইখলাস প্রসঙ্গে সালাফদের বক্তব্য, রিয়া, ইখলাসের পুরস্কার, ইখলাস না থাকার পরিণতি, ইখলাস ও সালাফদের অবস্থান, ইখলাসের আলামত, ইখলাস সম্পর্কিত কতিপয় বিষয়সমূহ এবং রিয়ার আশঙ্কায় আমল ছেড়ে দেওয়া”। অতঃপর পরিশিষ্ট এবং সবশেষে অনুশীলনী আকারে কিছু প্রশ্ন যোগ করে বইটির মান আরও সমৃদ্ধ করা হয়েছে, মাশা~আল্লাহ।
ইখলাসের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবল উৎসাহ দিয়েছেন। সর্তক করেছেন ইখলাস যেনো হারিয়ে না যায়। ইখলাসের গুরুত্ব প্রত্যেক জামানায় সর্বাধিক ছিল। বর্তমান ফিতনার সময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক প্রতিটি কাজেই মুমিনের জন্য ইখলাসের গুরুত্ব তেমন, ঠিক যেমন মাছের জন্য পানির গুরুত্ব। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন _ “তোমরা আমলকে ইখলাসপূর্ণ তথা খাঁটি (রিয়া বা লোক দেখানো মুক্ত) করো ; অল্প আমলই পরকালে তোমার মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে।” ইখলাস ব্যতীত কোন আমলই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। সুতরাং ইখলাসের সঠিক মর্ম অনুধাবন করে লৌকিকতামুক্ত ইবাদতের মাধ্যমে জীবনকে আখিরাতমুখী করে সাজাতে বইটির গুরুত্ব বলাই বাহুল্য।
বইটি পড়ে বিস্মিত হয়েছি! স্বল্প কথা কিন্তু ; অত্যন্ত প্রভাবক। পুরো বইটি অমূল্য সব রত্নকথনে ভুরপুর। সাইজে ছোট হলেও নিঃসন্দেহে, মাস্টারপিস একটি বই। প্রিয়জনকে হাদিয়া দিতে চাইলে ছোট এই বইটির মূল্যবান নামটি আপনার লিস্টের প্রথম সারিতে লিখে নিতে পারেন নির্দ্বিধায়।
নেতিবাচক দিক _
বইটির প্রচ্ছদ আমার ভালো লাগে-নি। নাম অনুযায়ী প্রচ্ছদে গাম্ভীর্যপূর্ণ একটা ভাব থাকলে বেশি আকর্ষণীয় হতো, যেটা যৎসামান্যই ছিল। এছাড়া বাকি আর কোনদিক খারাপ লাগার মতো মনে হয়নি। পৃষ্ঠার মান, রেফারেন্স, সব ঠিকঠাক লেগেছে। অনুবাদ সাবলীল। পড়তে কোন বেগ পেতে হয়নি, আলহামদুলিল্লাহ।
বই থেকে ভালো লাগার একটি উক্তি _
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহিমাহুল্লাহ বলেন _ ” অনেক ছোট আমল আছে যা খালেস নিয়তের কারণে বড় হয়ে যায়, আবার অনেক বড় আমল আছে যা খালেস নিয়তের অভাবে ছোট হয়ে যায়।” [পৃ,২২]।
শেষ কথা এবং বিশেষ রিমাইন্ডার _
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন _ ” জেনে রেখো, খালেস আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। ” [সূরা যুমার,৩৯/৩]।