ইতিহাস বর্তমানের দর্পনে অতীত দেখা। একটি জাতির উত্থানের পেছনে ইতিহাসের
গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ইতিহাস অতীতের বহু জাতি ও গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার নির্যাস;
এর আলোকে বর্তমান-প্রজন্ম ভবিষ্যতের দিশা নির্ধারন করতে পারে। যে জাতি নিজেদের
অতীত-ইতিহাস বিস্মৃত হয়, পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে।
আল্লাহ তায়লা ইশরাদ করেন— “আমি রাসুলগনের সব বৃত্তান্তই তোমাকে
বলেছি, যদ্দ্বারা তোমার অন্তরকে করেছে সুসংহত।” সুরা হুদ : ১২০
আমরা অনেকেই ইতিহাসগ্রন্থ অধ্যয়ন করি; একবারও কি ইতিহাসের ইতিহাস সম্পর্কে ভেবেছি? ভেবেছি—এর উৎসই বা কী? ইসলাম ইতিহাসের উৎসগুলো কি প্রাচীন রাজা-বাদশাহদের গল্পের মতো ঠুনকো ভিত্তির উপর নির্ভরশীল?
মাওলানা ইসমাইল রেহান তারিখে উম্মতে মুসলিমার মুখবন্ধে এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিহাস অধ্যায়নকারিদের জন্য একটি প্রবন্ধ সাজিয়েছেন।
পুনরায় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘ইতিহাস পাঠের পুর্বকথা’ পুস্তিকাটি তারই অনুবাদ।
Ruponti Shahrin –
বই : ইতিহাস পাঠের পূর্বকথা
জনরা : ইতিহাস
লেখক : ইসমাইল রেহান
অনুবাদক : মহিউদ্দিন কাসেমী
সম্পাদক : নেসারুদ্দীন রুম্মান
“ইতিহাস পাঠের পূর্বকথাঃ ইতিহাসের পূর্বে ইতিহাসের কথা”
ইতিহাসের যেমন ইতিহাস থাকে, যে কোন জাতি কিংবা সময়ের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট বা পটভূমি জানার জন্য রয়েছে পূর্বকথা। কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না সে আরেক ইতিহাস।
কিন্তু এই ইতিহাস জিনিসটা কী? এর জনক কে?
বিষয়টি মূলত অতীত ঘটনাবলী ও বিভিন্ন ঘটে যাওয়া কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে কাহিনির টাইমলাইন বলা যেতে পারে। ইংরেজি History শব্দের বাংলা প্রতিশব্দকে আমরা ইতিহাস বলে থাকি। গ্রিক শব্দ Historia যার অর্থ অতীত ঘটনা প্রবাহের অধ্যয়ন। আর এখান থেকেই এসেছে ইংরেজি শব্দটি। আর এটি এমন একটি বিষয় যাকে উপেক্ষা করা গেলেও, অস্বীকার করা সম্ভব নয়। যেকোন জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও পরিচয় জানতে ইতিহাস একটি সুত্রের মত কাজ করে, যেখানে অতীতের একটি নির্দিষ্ট সময়ের সাথে কোন না কোনভাবে আমরা জড়িয়ে আছি অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো।
ইতিহাস মূলত কী- তা নিয়ে যেখানে তর্ক বিতর্কের শেষ সীমানা নেই, সেখানে এই বিষয়ের উপর আলোচনা করা দুরূহ ব্যাপার। যদিও এই কষ্টসাধ্য ও পরিশ্রমী উদ্যোগ গ্রহণে তৎপর হয়ে লেখক ইসমাইল রেহানের ‘ইতিহাস পাঠের পূর্বকথা’ বইটির চমৎকার অনুবাদ করেছেন মহিউদ্দিন কাসেমী। পুনরায় প্রকাশনের পরিশ্রমলব্ধ কাজটি দৃষ্টিনন্দন মলাটে পাঠকের জন্য হতে পারে সুন্দর উপহার।
ইতিহাসচেতনা বলে আমাদের মাঝে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এর ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন। পাঠক হিসেবে প্রচুর ইতিহাসকেন্দ্রিক বই পড়া হলেও এই বিষয়টি এড়িয়ে পাঠের পরিচর্যা করা কিন্তু সম্ভব নয়। তাই ইতিহাসচেতনার ভারসাম্য রক্ষার জন্য আপনার আমার করণীয় কী?
সে বিষয়ে আলোকপাত করতেই বইটি নিয়ে দু-চারটে কথা না বললেই নয়।
ইতিহাস শব্দের বহু আভিধানিক অর্থ রয়েছে। ইতিহাসের পরিচয় নানা মুনি নানাভাবে ব্যক্ত করলেও এর অর্থ সময়ের পরিচয় দান, সময় সংক্রান্ত তথ্য প্রদান, অতীত কথা, প্রাচীণ কাহিনির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
এদিকে ইতিহাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম সাখাবি রহ. বলেন, “ সময়ের ধারাবাহিকতা নিরুপণের পাশাপাশি ততকালিন ঘটনাবলি খুঁজে বের করার চেষ্টা হলো ইতিহাস।” (আল-ইলানু বিত-তাওবিখ লিমান জাম্মাত তারিখঃ ১৭)
বইটিতে আলোচনার প্রাক্কালেই বলা হয়েছে, ইতিহাসের শাস্ত্রে সময়ের ক্রমবিন্যাসের সাথে ঘটনাবলির দখলদারিত্ব থাকলেও ঘটনা সংঘটনের তারিখ উল্লেখ থাকে না। আবার বিবরনী থাকলেও থাকে না, বর্ণনাকারীদের বিবরণ। হাদিস শাস্ত্রের কথাও সেখানে উঠে এসেছে।
ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়সমুহের উপর বিশদ আলোচনা না করা হলেও মূল কথা লেখক ও অনুবাদক দুজনেই আলোকপাত করেছেন। যেখানে আমরা মিলিত হতে পারি সময়ের বিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ মানুষের সাথে। আর তাই এসকল শাস্ত্র প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অবস্থার বিবরণি সংবলিত জ্ঞানের আধার।
ইতিহাস শাস্ত্র পাঠের কচকচানি বহুত হলেও আমরা জানি না তা পাঠের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যবিহীন যেকোনো কাজ ধু ধু বিরান মরুভুমির মতো। তাই ইতিহাস পাঠের পূর্বেই দুটি মৌলিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনে নেয়া জরুরি।
পূর্বেই বলেছি ইতিহাসেরও থাকে ইতিহাস। গ্রীক, আরব, চাইনিজ, রোমান, সিরিয়ান, মিশরি সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে ফেলে আসা বর্ষপঞ্জিকায় ইতিহাসের ইতিহাসকে কীভাবে দেখানো হয়েছে অল্প পরিসরে গল্প হলেও জানতে পারবেন অনেক কিছু। পাঠ্যপুস্তকের কলেবরে আমরা হেরোডোটাসকে চিনেছি ইতিহাসের জনক হিসেবে। তবু শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত ইতিহাসের শিকড় রয়েছে আরো সুদুরে প্রথিত।
কিন্তু পাঠক মাত্রই কৌতুহলী মনের অধিকারী!
ইতিহাস শাস্ত্র পাঠের উদ্দেশ্য জানা হলেও যদি এর অপরিসীম গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে অজানা থেকে যায়, তো তা শাস্ত্র পাঠের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। এ পর্যায়ে এসে বইটিতে কুরআনের ভাষায় ইতিহাসের গুরুত্বকে আরো জোর দিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কুরআনের বহু সুরায় অতীতের বিভিন্ন জাতির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, যেন তাদের পরিণতি থেকে সবক নেওয়া যায়।
ইরশাদ হয়েছে, “ তাদের কাহিনিতে বুদ্ধিমানদের জন্য শিক্ষণীয় উপাদান।” (সূরা ইউসুফঃ আয়াত ১১১)
ইতিহাস সংকলনের চারটি ধাপ পর্যায়ক্রমে ব্যাখ্যা করার পর গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেখানে মিথ্যুক বর্ণনার স্বরূপ ও বর্ণনাকারীদের পর্দা ফাঁস করেছেন লেখক। নীতি বিবর্জিত ইতিহাস অধ্যয়নের কুফল সম্পর্কে যেমন বলা হয়েছে, তেমনি ইতিহাস সংকলনের মৌলিক উৎস কেমন, কী, পদ্ধতি ও নীতিমালা নিয়ে পয়েন্ট আকারে বোধগম্যতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে।
অনেকেই ইতিহাস ও হাদিস বর্ণনার যে সুক্ষ্ণ পার্থক্য রয়েছে তা নিয়ে মতবিভেদে জড়িয়ে পড়েন। লেখক এই পয়েন্টিও স্ববিস্তারে আলোচনা না করলেও জরুরি কিছু কথা বলেছেন। যেখানে ইতিহাসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ও ইতিহাসবিদগণের প্রতি সুদৃষ্টি অর্পণের মাধ্যমে বিস্তৃত লেখনী ধারণ করেছেন। এক পর্যায়ে আল বিদায়া ওয়া আন নিহায়া-র মত প্রসিদ্ধ ইসলামি ইতিহাসের গ্রন্থের কথাও বলা হয়েছে।
এভাবেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের জাল সরিয়েছেন লেখক ইসমাইল রেহান। প্রত্যেক গোষ্ঠীর মাঝে তাদের নিজ নিজ মন্তব্যই তাদের বিশ্বাসের হাতিয়ার। তবুও ভবিষ্যতে ইতিহাসের খেরোখাতা হাতে নেয়ার আগে ইতিহাস পাঠের পুর্বে এই বিষয় সংক্রান্ত পাঠের ক্ষেত্রে উত্তম গাইডলাইন হিসেবে বেছে নিতে পারেন বইটি।
আমাদের পুর্বসুরী আলেমদের চোখে ইতিহাস পাঠের গুরুত্বই পাঠক হিসেবে আপনার জ্ঞান অর্জনের পথকে আরো মসৃণ করতে এমন একটি বইয়ের ভূমিকা অপরিহার্য।