আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নিদর্শন। একজন বিশ্বাসীর চোখ কীভাবে সেখানে খুঁজে পায় স্রষ্টার অস্তিত্ব? প্রকৃতির ফুল-পাখি-ফল, শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত-বর্ষার নানা ঘরোয়া আলোচনায় উঠে এসেছে কুরআন-সুন্নাহর ঝিনুক। কখনো বসন্তের কোকিলের বেশে, কখনো ঝরঝর বাদল দিনের আবহে, কখনো রক্তজবা ফুলের মৌতাতে।
কথায় কথায় এসেছে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-জসীম উদদীন, শেক্সপিয়র-ডিকিন্সন-ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যাইদ সাবিত-ইমরুল কাইস—বাংলা, ইংরেজি, আরবি কবিতা ও কবিতার কাব্যানুবাদ। তাদের আর আমাদের চিন্তার আর দর্শনের ফারাক।
সাহিত্য আর সুন্নাহ মিলেমিশে অদ্ভুত এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এ প্রবন্ধগল্প গ্রন্থে।
Meher Afroz –
📔বুক রিভিউ📗
বইঃ বৃষ্টিমূখর রৌদ্রমূখর
লেখকঃআব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব
মুষলধারে বৃষ্টি রুক্ষ শুষ্ক মৃত্তিকার বুকে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়, জেগে উঠে সজীব বনানী। লতাগুল্মের শাখায় শাখায় রঙ বে-রঙের ফুল ফুঁটে।আবার তাদের বুক চিরে উড়ে যায় লাল-নীল প্রজাপতি।নদীর কলকল শব্দধ্বণি তপ্ত মরুর বুকে জাগায় প্রশান্তির আমেজ। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি প্রকৃতির সে-ই লীলা নিকেতনে। প্রকৃতির এই রূপ-রস- গন্ধ হৃদয়ে মেখে কত কবি সাহিত্যিক এমনকি সাধারণ মানুষ কত কথাই না বলেছেন। চাঁদ- হাতি- সূর্য- গরু- পদ্ম- সাপের সুন্দর্যে ব্যকুল হয়ে এসব সৃষ্টিকে স্রষ্টার আসনে সমাসীনা করেছে এবং করছে। এভাবে যে প্রকৃতির সুন্দর উপভোগ করি, এই উপভোগ করার সঠিক উপায় কী আমরা আদৌ অবলম্বন করেছি? প্রকৃতপক্ষে এই প্রকৃতির রূপবৈচিত্রের পেছনে কে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন? আকাশে ভেসে বেড়ানো উড়ন্ত মেঘমালার আসল স্রষ্টা কে, কখনও চিন্তার উদ্রেক হয়েছে?
‘বৃষ্টিমূখর – রৌদ্রমূখর’ বইটিতে লেখক মূলত সৃষ্টির নিগূঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে সেই প্রকৃত স্রষ্টার পরিচয়’ই ব্যক্ত করেছেন।প্রকৃতিকে ঠিক কেমন চোখে দেখতে হবে তার সঠিক পন্থা বাতলে দিয়েছেন।সেই সাথে স্রষ্টার সৃষ্ট উপাদান সমূহের সৃষ্টি করণের মূল লক্ষ্য কী সেই দিকটিও স্পষ্ট করেছেন।
বইটি যাদের জন্যঃ—
⇨যারা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে স্রষ্টার পরিচয় সৃষ্টির সাথে গুলিয়ে ফেলেন বইটি তাদের জন্য।
⇨যারা সাহিত্যের ভাঁজে ভাঁসে স্রষ্টার গুণগান শুনতে পছন্দ করেন বইটি তাদের জন্য।
⇨যারা সৃষ্টিকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উদার চিত্তে ⇨সঠিক পন্থায় অনুভব করতে চান বইটি তাদের জন্য।
⇨এবং যারা প্রকৃতির বর্ননা পাঠ্যের মাধ্যমে কল্পনার রাজ্যে সাজাতে চান বইটা তাদের জন্য।
বই থেকে কিছু অংশঃ—
‘পৃথিবীর অলিখিত নিয়মই যেন এটা।আপন শৌর্য-বীর্য ও প্রতাপ-প্রভাব নিয়ে নিজের জগত গড়ে তুলতে না পারলে,দুর্বলতা ও দাক্ষিণ্যনির্ভরতায় অন্যের করায়ত্ত জগতে বিচরণ করলে যে কাউকেই নির্মম পরিণতি বরণ করতে হয়।’
পৃষ্ঠা নং—২৬
‘বিত্ত-বৈভবের পাহাড়টাও হঠাৎ কোনো ভারী বর্ষণে ধসে যায়, নিদেনপক্ষে ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু পরিশুদ্ধ কর্মের আবেদন প্রবাহমান নদীর মতো, ভারী বর্ষণে তার দুকূল উপচে পলিমাটি জমে, যতদূর বয়ে যায় উর্বর করে যায় দুপাশেত জমি।’
পৃষ্ঠা নং—৩১
‘আপনারা যারা বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘জাহান্নামে যাবো’, আপনাদের মূল্য ঐ বাদূরগুলোর মতোই। আমরা যারা জান্নাতের স্বপ্ন দেখি, আল্লাহর কাছে ময়না পাখির মতোই। জান্নাতীদেরকে আদর-যত্ন করে প্রশস্ত জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তাই তাদের জন্য বরাদ্দ বেশি। জাহান্নামীদের ঠাসাঠাসি করে ভয়ানক শাস্তিতে নিক্ষেপ করা হবে, এজন্যে তাদের বরাদ্দ এত অল্প।’
পৃষ্ঠা নং—৫৯
‘গান শেষ হলে বনের পাখিকে কেউ মনে রাখে না, জীবনের খেলাঘরে বেলা পড়ে এলে মানুষকেও মানুষ মনে রাখে না।’
পৃষ্ঠা নং— ৬২
‘দুনিয়ার জীবনে যে ইবাদতগুলো আমাদের জন্যে ফরয করা হয়েছে,এগুলো তো সেই ট্রেনের মতোই,যে ট্রেনে চড়ে পৌঁছতে হবে চূড়ান্ত গন্তব্যে।’
পৃষ্ঠা নং—৭৩
‘রাখালকে তার পশুর ঝাকের দিকে সতর্ক ও তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হয়, যেন কোনভাবেই বেহাত না হয় বা হিংস্র জন্তুর আক্রমণে না পড়ে। পরিবারের কর্তাকেও সেরকম সজাগ থাকা চাই, যেন পরিবারের কোন সদস্য শাইত্বানের চাঁদমারিতে ঢুকে না পড়ে। ’
পৃষ্ঠা নং—১০০
‘আমার রব বান্দার আকুতি শোনেন, বান্দার হৃদয়াবেগ তাঁর দুয়ারে কখনো আহত হয় না, কেবলই আদৃত হয়।’ পৃষ্ঠা নং—১১৭
‘একজন মুমিন কখনোই অস্থির হওয়ার সুযোগ পায় না। সুখের অতি মিষ্টতা কিংবা দূ:খের অতি তিক্ততা কোনটাই তার জীবনে পানসে করে তুলতে পারে না। স্বাদ আর বিস্বাদের মাঝখানে যে বিন্দুটি স্থির হয়ে আছে তাকে খুজে পায় শুধু মুমিনরাই।’
পৃষ্ঠা নং— ১২৭
‘বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা যখন ঝিনুকে প্রবেশ করে, তখন ঝিনুকের ভেতরে মুক্তার জন্ম হয়। আবার বিষধর সাপের বিষদাঁতে বিষ সৃষ্টি হয় এই বৃষ্টিফোঁটা থেকেই! সুতরাং, ভূমিকাটি বৃষ্টিফোঁটার নয়, বরং বৃষ্টিফোঁটা গ্রহণকারীর। যারা কুরআনের অমূল্য রতন ধারণ করার জন্যে চাতকের মতাে অপেক্ষমাণ, কুরআন তাদের জন্যে মুক্তা হয়েই আত্মপ্রকাশ করবে। আর যারা অসুস্থ হৃদয় নিয়ে নিজেদের বক্রতা পরিপুষ্ট করার লক্ষ্যে কুরআন খুলে বসে, তাদের বিষাক্ত অন্তরে বিষ বেড়ে যাওয়া ছাড়া এই পাঠে তেমন কোনাে উপকার আসবে না।’
পৃষ্ঠা নং—১৭২
‘একটা গাছ কল্পনা করি। এই গাছের সব পাতা ঝড়ে গেছে। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে গাছটি পত্রপল্লবে আবার সুশোভিত হয়ে উঠলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার পাতাগুলো শুকিয়ে গেলো। শুকিয়ে তো গেছেই, ঝড়ে পড়া পাতাগুলো সেখানে স্থির থাকলো না। বাতাসের টানে দূরে উড়ে গেলো, চলে গেলো দৃষ্টিসীমার বাইরে। পৃথিবীর জীবন তো এটাই!’
পৃষ্ঠা নং— ২০০
পাঠ্যানুভূতিঃ—
বইটি পড়তে নিয়ে মাঝে মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রকৃতির গহিণে।নানা রকম পাখ-পাখালি আর গাছের সমাহারে সাজানো এই প্রকৃতি ঘুরে ঘুরে দেখতে কার না ভালো লাগে। আর তার এই রূপের প্রকৃত স্বার্থকতা তখনই, যখন দর্শকের মনে সৃষ্টির সুন্দর্য দেখে স্রষ্টার মহিমা স্মরণ হয়। লেখক তাঁর প্রতিটি বাক্যে সেই চিরন্তন সত্য এবং রবের গুণাবলি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করি। শুদ্ধ সাহিত্যের রস কেমন হওয়া উচিৎ সে প্রমাণ বইটি বহণ করে। বই পড়লেও যে মন সজীব সতেজ আর প্রাণবন্ত হয় তা এই বইটি না পড়লে কেউ বুঝতে পারবে না।
সর্বোপরি, বইটির প্রচ্ছদ ছিলো রুক্ষ মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মত মনোমুগ্ধকর। সম্পাদনা, পৃষ্টাসজ্জা এবং বাইন্ডিং ও ছিলো মানসম্মত।
রিভিউ দাতাঃ Meher Afroz