আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নিদর্শন। একজন বিশ্বাসীর চোখ কীভাবে সেখানে খুঁজে পায় স্রষ্টার অস্তিত্ব? প্রকৃতির ফুল-পাখি-ফল, শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত-বর্ষার নানা ঘরোয়া আলোচনায় উঠে এসেছে কুরআন-সুন্নাহর ঝিনুক। কখনো বসন্তের কোকিলের বেশে, কখনো ঝরঝর বাদল দিনের আবহে, কখনো রক্তজবা ফুলের মৌতাতে।
কথায় কথায় এসেছে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-জসীম উদদীন, শেক্সপিয়র-ডিকিন্সন-ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যাইদ সাবিত-ইমরুল কাইস—বাংলা, ইংরেজি, আরবি কবিতা ও কবিতার কাব্যানুবাদ। তাদের আর আমাদের চিন্তার আর দর্শনের ফারাক।
সাহিত্য আর সুন্নাহ মিলেমিশে অদ্ভুত এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এ প্রবন্ধগল্প গ্রন্থে।
ফাতিমা মৌ ফ্লাভিকা –
◾প্রাথমিক কথন:
ফুটন্ত ফুল, উড়ন্ত প্রজাপতি,মেঘ রোদ্দুর বৃষ্টি,পাখির কলতান কিংবা সোনাঝরা বসন্ত নিয়ে কবিমননের কতশত লেখা তো কম পড়িনি!প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে উদাসী কবি কতনা উপমা নিয়ে আসেন।সেসব পড়ে পাঠকও উদাস হয়ে যায়।আনমনে ভাবে কতশত ভাবনা;কিন্তু এসব ভাবনা কি আমাদের আসলেই সত্যিকারের ভাবনার কাছে নিয়ে যায়?জীবনের আসল পাঠ শেখায়?
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ মানুষের হৃদয়ে এসেছে পরিবর্তনের এক নতুন জোয়ার!তাই প্রকৃতি,জীবনবোধ আর মাটি মানুষের গল্প শোনাতে শোনাতে পাঠককে রব্বের কথা,পরকালীন জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য একঝুড়ি গল্প নিয়ে পাঠকের মাঝে হাজির হয়েছেন তরুণ এক লেখক, কবি,সাহিত্যিক এবং গল্পকার আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব।
গল্পের ডানায় ভার করে, সবুজের মোহনীয়তার ডুব দিয়ে,একটি সবুজপিয়াসী মন নিয়ে প্রবেশ করা যাক লেখকের অসাধারণ একটি বইয়ে;নামঃ বৃষ্টিমুখর রৌদ্রমুখর!
▪বইকথন
প্রকৃতি আর জীবনের মেলবন্ধনে একাকার হয়ে যাওয়া ৫টি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি।যা আমাদের বাস্তব জীবনের আসল পাঠ ও বিশ্বাসীদের ইসলামি মূল্যবোধের ভাবনা উদ্রেগকারী।সাহিত্য আর সুন্নাহ্ মিলেমিশে এক মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।জীবনের পরতে পরতে জান্নাতের পুষ্পসৌরভে শোভিত করার প্রেরণা যোগানোর জন্যে,বিশ্বাসী তারুণ্যকে সুন্নাহর সবুজতা চিনিয়ে দেয়ার প্রয়াস নিয়েই রচিত হয়েছে বইটি। প্রকৃতির ফুল-পাখি-ফল, শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত-বর্ষার নানা ঘরোয়া আলোচনায় উঠে এসেছে কুরআন-সুন্নাহর আয়নায়।গল্পের শিরোনাম চয়েজে রয়েছে আরেক মুগ্ধতা-
‘বনের পাখিরে কে চিনে রাখে’
‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে’
‘ফজরে আমি উঠতে পারি না’
‘রৌদ্রমুখর’
‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’
ছন্দ রসে মিশানো প্রকৃতির গল্প তো বহু শুনেছি,তবে এমন বর্ণনা শুনিনি কভু।লেখকের বর্ণনার ভঙ্গি অসাধারণ।
‘বনের পাখিরে কে চিনে রাখে’ শিরোনামের প্রবন্ধটিতে গ্রাম বাংলার চিরচেনা সব পাখির কথা বর্ণনা দিয়ে পাখি এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কুরআন এবং সুন্নাহর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।
‘আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে’ শিরোনামের প্রবন্ধতে অপরুপ রুপের রানী বর্ষা ঋতুর সজীবতা,স্নিগ্ধতা নিয়ে অনুপম বর্ণনাশৈলী পাওয়া যাবে। বর্ষার বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা এবং মুমিন বান্দার দু’আর মধ্যে যে অদ্ভুত সংযোগ রয়েছে তার কথাও বর্নিত আছে।
‘ফজরে আমি উঠতে পারি না’শিরোনামের প্রবন্ধটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।গল্পটি তাদের জন্য যারা হেলায় ফজরের সালাত কাযা করে।প্রত্যেক প্র্যাক্টিসিং মুসলিমের জন্য অনুপ্রেরণামূলক এবং চিন্তা চেতনায় পরিবর্তনকারী একটি প্রবন্ধ !
‘রৌদ্রমুখর’ গল্পটিতে গ্রীষ্মঋতুর বর্ণনা এবং প্রচন্ড উত্তাপের দিনে মাটি ও মানুষের দুনিয়ার জীবনের কষ্টের সাথে আখিরাতের ভাবনা পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
সবশেষে, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে প্রবন্ধটিতে প্রকৃতির বসন্তকাল এবং মুমিন জীবনের বসন্তকালের তুলনা কুরআন হাদিসের ভাষায় রূপায়িত করা হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার প্রতিটি সৃষ্টি কতোটা অর্থবহ, সৃষ্টিনৈপুণ্য কতটা নিখুঁত সেসবকিছু ভাবতে শিখিয়েছে বইটি।আল্লাহর মহত্ব ও মাহাত্ন্য কত উঁচু তা ভেবেছি বইটি পড়ে। বসন্তের কোকিলের বেশে,কখনো ঝরঝর বাদল দিনের আবহে, কখনো রক্তজবা ফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণে।বর্ণনার প্রঙ্গে উঠে এসেছে নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-জসীম উদ্দীন, শেক্সপিয়র-ডিকিন্সন-ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যাইদ সাবিত-ইমরুল কাইস—বাংলা, ইংরেজি, আরবি কবিতা ও কবিতার কাব্যানুবাদ।চিন্তা আর দর্শনের দুই মেরু কাউকে রব্বের কথা স্মরণ করায় কাউকে অন্ধকারেই ফেলে রাখে।
◾বিশেষ মন্তব্যঃ
বইটির কভার, কভারের কালার কম্বিনেশন, বাইন্ডিং, পৃষ্ঠার কোয়ালিটি, ফন্ট, সম্পাদনা সবকিছু সুন্দর ছিল।নামের সাথে মিল রেখে প্রচ্ছদও তৈরী করা হয়েছে।
বইটির সমালোচনা করার যোগ্যতা আমা আছে কিনা জানি না।তবু লেখকের একজন ক্ষুদে পাঠক হিসেবে একটি কথা বলতে চাই।পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে প্রবন্ধগুলোর আকার আরেকটু ছোট হলে ভালো হতো,সুখপাঠ্য হতো।সমালোচনা বা আমার মন্দলাগা বলতে এতটুকুই।
বইয়ের শিরোনাম নাম পড়লে অনেকেই ভাববে এটি তাত্ত্বিক কোনো বই কিংবা ছোট গল্পের বই।কিন্তু ‘মেঘপাখি’ বইয়ের মতো এটিও একটি প্রবন্ধগ্রন্থ।হৃদয় গলিত করা শব্দমালা দিয়ে প্রকৃতির বর্ননা দেওয়ায় বইটি পড়লে হৃদয়ে রস সঞ্চারিত হয়।বইয়ের প্রতিটি গল্পের রেফারেন্স, বর্ণনা এবং ভাষাশৈলী চয়েজে রয়েছে অনন্যতা।প্রতিটা গল্পের থিম, টুইস্ট, সাহিত্য সবকিছু মিলেমিশে সত্যই জমে ক্ষির হয়েছিল।
▪ব্যক্তিগত মতামতঃ
সত্যি বলতে সব লেখকের বই পড়তে আমি সাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা।হাতে গোনা অল্পকিছু লেখকের বই পেলে এক লহমায় পড়ে শেষ করে ফেলি।আবদুল্লাহ মাহমুদ নজীব ভাইয়ার প্রতিটি লেখায় মেঘ, বৃষ্টি রোদ্দুর আর জোছনা নিয়ে রয়েছে আজন্ম মুগ্ধতা। প্রকৃতিমুগ্ধ লেখক এগুলো নিয়ে অসাধারণভাবে কুরআন সুন্নাহর আলোকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেন।গৎবাঁধা সাহিত্যের বেড়াজাল থেকে বের করে পাঠককে নিয়ে যান জগৎ পাতা সুন্দর সাহিত্যের আঙ্গিনায়।
অসুস্থ আর অশ্লীল সমাজে তরুণ তরুণীদের চিন্তা চেতনায় নতুন জোয়ার এনে দিতে সিয়ান পাবলিক থেকে প্রকাশিত প্রতিটি বই-ই অসাধারণ।সিয়ান পাবলিকেশনের এ আশাজাগানিয়া অগ্রগতি সামনের দিকে এগিয়ে যাক দু’আ রইলো।
▪বই সম্পর্কেঃ
বইঃ বৃষ্টিমুখর রৌদ্রমুখর।
লেখকঃ আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব
সিয়ান পাবলিকেশন
পৃষ্ঠা সংখ্যা—২২৪
প্রচ্ছদ মূল্য— ৩৪৫ টাকা ।