আর রাহীকুল মাখতূম: একটি অনবদ্য সীরাত-গ্রন্থ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত পর্যালোচনায়, সীরাতের ঘটনামালার সুসংহত ও মনোজ্ঞ উপস্থাপনায় বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি সত্যিই এক নজিরবিহীন রচনা। আল কুরআনুল কারীম, হাদীসে নববী ও বিশুদ্ধ আছার এবং ঐতিহাসিক বর্ণনার নির্যাস বের করে প্রাজ্ঞ লেখক তাঁর এ বইটি সুবিন্যস্ত করেছেন।
বইটি নির্ভরযোগ্যতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড রক্ষা করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সীরাত উপস্থাপন করেছে, যা পাঠকের সামনে উজ্জ্বল করে দেয় সীরাতুল মুস্তাকীমের নিশানাসমগ্র। দেখিয়ে দেয় সীরাতুন্নাবী পাঠের সঠিক পদ্ধতি।
এই গ্রন্থে বিস্তারিত ভাবে যে সকল বিষয় আলোচিত হয়েছে সেগুলো হল –
• তৎকালীন আরবের ভৌগোলিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা
• রবের ধর্ম-কর্ম ও ধর্মীয় মতবাদ
• জাহিলিয়াতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
• রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে বংশ পরিচয়, বিবাহ, দাম্পত্য, সন্তান-সন্ততি, তাঁর আবির্ভাব এবং এর পর ঘটনা বহুল পবিত্র জীবনের চল্লিশটি বছর
• নুবুওয়াত লাভের পূর্বকালীন সংক্ষিপ্ত চিত্র
• নবুওয়তী জীবন এবং তার দাওয়াত
• প্রথম পর্যায়ের মুসলিমগণের ধৈর্য ও দৃঢ়তার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ
• মক্কা ভূমির বাইরে ইসলামের দাওয়াত প্রদান
• ইসরা ও মিরাজ
• হিজরত
• মাদানি জীবন
• যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ধি-চুক্তি
• রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
• সামাজিক ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং তার ইহ লৌকিক জীবন থেকে তিরোধান
সাওদা সিদ্দিকা নূর –
◾প্রারম্ভিকা:
‘তিনি এমনই একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন।’
মানুষ যা ভাবে ভাবুক। আমি এই লাইন দু’টো শুধু একজনের জন্যই বরাদ্দ রেখেছি। কতশত জায়গায় যে তাঁর কথা উল্লেখ করে এই লাইন দু’টো ব্যবহার করেছি, সেটার কোন হিশেব নেই। হিশেব রাখতেও চাই না। তাঁকে কতটুকু ভালোবাসি সেটার হিশেব কি রাখা সম্ভব? আমরা যেখানে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদার প্রকাশ ঘটাতে ব্যর্থ, সেখানে মাত্র দু’টো লাইনের হিশেব নেয়াটা কৃপণতা। কিন্তু কে তিনি যাকে এত ভালোবাসি?
[এখানে এক জনম বলতে ইহাকালে তাকে ভালোবেসে মন ভরবে না। জান্নাতেও আমরা আমাদের রাসুলকে ( ﷺ) ভালোবাসব।]
ইসলাম পূর্বে আরবরা তাঁর বিশ্বস্ততার মানদন্ড দেখে আল আমীন উপাধি দিয়েছিল। নির্লজ্জ পাপাচারের তিমির যুগে বাস করেও যিনি ছিলেন পুষ্পের ন্যায় নিষ্কলুষ। তাঁর দয়া, দানশীলতা ও ইনসাফ ছিল অতুলনীয়। তাঁর পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল আরব। তাঁর তাওহীদের অমিয় সুধা পান করে মানবজাতি পেয়েছিল দিশা। তিনি হলেন সায়্যিদুন নবি, নবিদের সেরা নবি, মহামানবদের মহামানব হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (ﷺ)।
মানবতা, মহানুভবত্ব, দয়া, প্রেম, আদর্শে যিনি ছিলেন সর্বযুগের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামিনের সবথেকে প্রিয় হাবিব। তাঁর মত কেউ কোন দিন জন্ম নেননি, আর কেউ জন্ম নিবেও না কখনো। আমরা যারা এই মহামানবকে দেখিনি, সাহচর্য পাইনি, তাদেরকে এই মাহামানবের জীবনদর্শন সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবহিত করার জন্য শাইখুল হাদিস আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরি (রহ.)-এর অসাধারণ ও অনন্য প্রয়াস হচ্ছে ‘আর রাহীকুল মাখতূম।’ যার বাংলা অনুবাদ করেছে বহুসংখ্যক নবিপ্রেমিরা। তবে আমি পড়েছি আব্দুল খালেক রহমানী ও মুয়ীনুদ্দীন আহমাদ অনুদিত তাওহীদ পাবলিকেশনের বইটি।
.
.
◾লেখক পরিচিতি:
আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরি (রহ.) বিশ্ব বিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ আর রাহীকুল মাখতূমের রচয়িতা হিশেবে সবথেকে বেশি পরিচিত হলেও তাঁর আরো অনেক পরিচয় আছে। তিনি একাধারে একজন আরবি ভাষাবিদ, তাফসির, হাদিস, উসুলে হাদিস, ফিক্বাহ, উসুলে ফিক্বাহ অত্যান্ত পারদর্শি।
.
.
◾বইটি রচনার প্রেক্ষাপট:
১৯৮৭ সালে রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী সংস্থা কর্তৃক নবি (ﷺ)-এর জীবনীর উপর একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে ১১৮২টি পান্ডুলিপির ভেতর প্রথম স্থান অধিকার করে ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ বইটি। যারা বিচারকার্য পরিচালনা করেন, তাঁরা ছিলেন যুগ শ্রেষ্ঠ সীরাত শাস্ত্র ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ের বিশেষজ্ঞ
লেখকের একাডেমিক যোগ্যতা, প্রতিযোগিতার নিরীক্ষণ টিমের দক্ষতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই সিরাতের অথেনটিক মান সম্পর্কে ধারণা দেয়। কোন সংশয় ছাড়া পড়ার মত একটি সিরাত গ্রন্থ।
.
.
◾বই কথন:
চলুন ফিরে যাই ১৪০০ বছর পূর্বে।
সিরাতের দর্পণে দেখি তৎকালীন আরবের অবস্থা ও এক মহামানবের আগমনের ইতিবৃত্ত।
.
আরবরা তখন ছিল অজ্ঞতার চরম পর্যায়ে। তারা রক্তের বদলে রক্ত, জীবনের বদলে জীবনে বিশ্বাসী ছিল। কন্যা সন্তান ছিল তাদের কাছে লজ্জার বিষয়। তখন মনুষ্যত্ব দিয়ে নয়, মানুষকে বিচার করা হতো সম্পদ ও ক্ষমতা দিয়ে। কুসংস্কার, কুপ্রবৃত্তি ও অশ্লীলতার আস্তরণে ঢাকা ছিল গোটা মরুবাসি। পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র ঘরে ছিল ৩৬০টি মূর্তি।
এই অন্ধকার অমানিশায় ডুবন্ত অসহায় মানুষগুলোর মাঝে আলোর মশাল নিয়ে আবির্ভাব হলো এক মহামানবের। তপ্ত মরুর বুকে এনেছিলেন মানবতার ঝর্ণাধারা। তিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)। এক আলোর ফেরিওয়ালা।
সমগ্র বিশ্বজাহানের মালিক স্বয়ং তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,
“তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” [৩৩:২১]
তিনি ছিলেন সকল মানবীয় গুণাবলির আধার।
তিনি অন্যায়ের নিকট ছিলেন ইস্পাত কঠিন, অসহায়ের নিকট ছিলেন কুসুম কোমল। ধৈর্যের পরীক্ষায় ছিলেন মাটির মত সহিষ্ণু, উদারতায় ছিলেন আকাশ সমান। ভালোবাসায় ছিলেন অকল্পনীয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন সবথেকে দক্ষ সমর বিশারদ। সিংহাসনে ছিলেন ন্যায়বিচারক ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। আবার স্ত্রীদের নিকট প্রেমময়ী স্বামী, সন্তানদের নিকট আদর্শ পিতা, প্রতিবেশির নিকট অনুসরণীয় ব্যক্তি। কী ছিল না তার মাঝে? পৃথিবীর কোনো বিশেষণে বিশেষিত করা সম্ভব নয় তাঁকে। এই মানুষটির গোটা জীবনের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ বইয়ে।
রাসুল (ﷺ)-এর আগামনের পূর্বে আরব অবস্থা, তাঁর আগামন, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বিয়ে, নবুয়ত প্রাপ্তি, ইসলামের পয়গাম পৌঁছানোতে প্রতিবন্ধকতা, মানুষের ইসলাম গ্রহন, মদিনায় হিজরত, মদিনার সিংহাসন, যুদ্ধ জয়, মক্কা বিজয় এবং ওফাত, সবকিছু খুব সুশৃঙ্খল ভাবে এই বইয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখকের সাবলীল বর্ণনা ভঙ্গি ও অথেনটিক হাদিস অনুযায়ী জীবনী বর্ণনা খুব ভালো লেগেছে। যেকোন শ্রেণীর পাঠকের জন্য বইটি উপযোগী। রাসুলের (ﷺ) জীবনী জানার জন্য অত্যান্ত নির্ভরযোগ্য একটি বই।
.
.
◾ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য:
আল কুরআন ব্যতীত কোনো বই ভুলের উর্ধ্বে নয়। তাই এই বইয়েও হয়ত ভুল রয়েছে। কিন্তু সেটা হয়ত বইয়ের ইতিবাচকতার অন্তরালে ঢাকা পড়েছে।
.
.
◾সবথেকে পছন্দের উক্তি:
১. তাওহিদী নূরে যখন মু’মিনের অন্তর আলোকিত হয়, উদ্বেলিত ও পুলকিত হয়ে ওঠে, পর্বত-প্রমান প্রতিবন্ধকতাও তখন তাঁর সামনে তৃণখণ্ডের মতো তুচ্ছ মনে হয়।
২. তাঁদের অন্তর থেকে উৎসারিত ভক্তি ও ভালোবাসার ধারা ঠিক সেভাবেই নবি (ﷺ)-এর দিকে প্রবাহিত হতো, যেমনটি জলের ধারা উচ্চ থেকে নিম্নভূমির দিকে প্রবলবেগে প্রবাহিত হতে থাকে। [এখানে সাহাবাদের (রা.) কথা বলা হয়েছে।
.
.
◾পাঠ্যানুভূতি:
রাসুল (ﷺ)-এর সাথে প্রত্যেক মুসলিমদের অভাবনীয় আবেগ জড়িয়ে আছে। মুহাম্মাদ (ﷺ) নামটা শুনলেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায়-শিরায় শিহরণ উঠে যায়। আর্দ্র হয়ে ওঠে আখিকোণ। কল্পনায় ভাসে এক মহামানব, যিনি ১৪০০ বছর পূর্বে ইয়া উম্মাতি, ইয়া উম্মাতি বলে কেঁদেছেন।
যেসব বই পড়ে আমি সবথেকে বেশি কেঁদেছি, তার মাঝে আর রাহীকুল মাখতূম একটা। বইটি পড়ার সময় তায়েফবাসীর প্রতিটা পাথরের আঘাত আমার অন্তরে সুক্ষ্ম তীরের মত বিঁধেছে। রাসুলের (ﷺ) প্রতি আবু লাহাব, আবু জাহেল সহ সকল নিকৃষ্ট মানুষগুলোর অপমান ও ঘৃণার কথাগুলো প্রচন্ড ভাবে আঘাত করেছে। ওফাতের পূর্বে যখন আমার রাসুলকে (ﷺ) আলী (রা.) ও ফজল (রা.)-এর কাঁধে ভর করে আয়িশাহ (রা.)-এর ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তাঁর পবিত্র পা দু’টো মাটিতে হেঁচড়িয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখার মত শক্তি ছিল না তাঁর। ঐ হেঁচড়ানো পা দু’টোর কথা মনে পড়লেই আমার মনে হয়, আমি যদি সেখানে থাকতাম, তবে নিজের পিঠ পেতে দিতাম, যেন পা দু’টো ওমন হেঁচড়িয়ে না যায়। যখন আমার রাসুলের (ﷺ) ওফাত হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল এর থেকে নিদারুণ দৃশ্য পৃথিবীতে আর হতে পারে না। যদি পারতাম, তবে আমিও তাঁর সাথে মরে যেতাম।
এই যে পাঠ্যানুভূতি লিখতে বসেও কেঁদে ফেলেছি। সমগ্র জীবনের সমস্ত আবেগ নিংড়ে দিলেও তাঁর সম্পর্কে বলা শেষ হবে না। আর যে বই থেকে এই মানুষটি সম্পর্কে জানতে পেরেছি, সে বইটি যে কত প্রিয়, সেটাও বলে বোঝানো যাবে না।
লেখকের সহজ-সরল বর্ণনা ভঙ্গি, হাদিসে যেসব বিষয়ে একাধিক বর্ণনা রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুক্তি নির্ভর তথ্য গ্রহন করাটা খুব ভালো লেগেছে।
.
.
◾যবনিকা:
যবনিকা টানতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এটাই পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়ম। হোক সেটা বইয়ের কিংবা রাসুলের (ﷺ) জীবনের। যবনিকা টানতেই হবে। আশা করি বইটি পড়ে বর্তমান যুগের দিক ভ্রান্ত বেহুশ মানুষগুলো আবারো জেগে উঠবে। প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয়ে ও চরিত্রে ফুটে উঠবে এক মহামানবের প্রতিচ্ছবি। তিনি মুহাম্মদ (ﷺ)।
.
.
.
______________________________________
◾এক নজরে বইটি:
বইয়ের নাম: আর রাহীকুল মাখতূম
লেখক: শাইখুল হাদিস আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরি (রহ.)।
অনুবাদ: আব্দুল খালেক রহমানী, মুয়ীনুদ্দীন আহমাদ
প্রকাশনায়: তাওহীদ পাবলিকেশন
মুদ্রিত মূল্য: ৫৫০ টাকা
_______________________________________
Din Muhammad Sheikh –
◾ প্রাককথন
____________
মানুষ অনুসরণ প্রিয়। অন্যকে অনুসরণ করে সে হতে চায় সেরা, যাপন করতে চায় তার পার্থিব জীবন। কাউকে না কাউকে সে তার জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবেই। তাই তো কেউ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে কার্ল মার্ক্সকে, কেউবা মুসোলিনি বা লেলিনকে। কেউবা গ্রহণ করে আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা, জিয়াউর রহমান কিংবা শেখ মুজিবকে। আচ্ছা, অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে শ্রেষ্ঠ কে? কার অনুসরণে আমরা পেতে পারি ইহকালীন শান্তি? কাকে অনুসরণ করলে আমরা পরকালেও পেতে পারি মুক্তি? প্রশ্নগুলোর উত্তর দেখুন সূরা আহযাবের ২১ নং আয়াতে।
“অবশ্যই তোমাদের প্রত্যেকের জন্য রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।”
হ্যাঁ, একমাত্র রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলেন পরিপূর্ণ অনুসরণীয় আদর্শ। কেবল তাঁর অনুসরণেই মানবতার কল্যাণ; কেবল তাঁর অনুকরণেই মানবতার মুক্তি।
সুতরাং মানবতার মুক্তির দূত সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, তাকে চিনতে হবে। তাই তো তাঁর জীবনী পাঠ করা আমাদের জন্য একান্ত জরুরি। আল কুরআনই হচ্ছে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনীগ্রন্থ। অতঃপর আল হাদীস। এছাড়াও তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে হাজার হাজার পৃষ্ঠা, রচিত হয়েছে অসংখ্য সীরাহ।
◾ সীরাহ কী ও কেন
___________________
মূলত মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীর ওপর রচিত গ্রন্থকেই পারিভাষিক অর্থে সীরাহ বলা হয়। আমাদের জীবনে রাসূলুল্লাহর সীরাহ পাঠের গুরুত্ব, বেঁচে থাকতে অক্সিজেনের গুরুত্বের সমতূল্য বলা যেতেই পারে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে গেলে অবশ্যই তাঁর জীবনাচার আমাদের জানতে হবে। আর তাই পড়তে হবে সীরাহ।
চলুন আজ আমরা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সীরাহ গ্রন্থের সাথে পরিচিত হই। এর গ্রন্থকার আমাদের ভারত উপমহাদেশেরই রত্ন। হ্যাঁ, বলছিলাম মাওলানা সফিউর রহমান মুবারকপুরী এবং তাঁর রচিত “আর রাহীকুল মাখতূম” এর কথা।
◾ আর রাহীকুল মাখতূমের পটভূমি
_______________________________
আর রাহীকুল মাখতূম। বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রসিদ্ধ সীরাহ। লিখেছেন মাওলানা সফিউর রহমান মুবারকপুরী রহিমাহুল্লাহ। অসাধারণ এ সীরাহ গ্রন্থটি তিনি রচনা করেন ১৯৭৬ সালে। সে বছর রবিউল আউয়াল মাসে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত রাবেতায়ে আলমে ইসলামির সীরাতুন্নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মেলন থেকে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল – ইতিহাস ঘেঁটে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্য পর্যালোচনা উপস্থাপন করা। প্রতিযোগিতায় ১১৮২টি পাণ্ডুলিপি জমা হয়। এতো এতো পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে মাওলানা সফিউর রহমান মুবারকপুরীর পাণ্ডুলিপি, যা আজ ” আর রাহীকুল মাখতূম” নামে মলাটবদ্ধ হয়েছে।
◾ সীরাহ হিসেবে আর রাহীকুল মাখতূমের অসাধারণত্ব
_____________________________________
সীরাহ হিসেবে আর রাহীকুল মাখতূম অনন্য। এর রয়েছে এমন কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যার কারণে অন্যসব সীরাহ গ্রন্থের তুলনায় আর রাহীকুল মাখতূম পেয়েছে বহুল জনপ্রিয়তা। এখানে সংক্ষেপে কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যেতে পারে।
• সীরাহ হিসেবে গ্রন্থটি অতিদীর্ঘও নয়, খুব সংক্ষিপ্তও নয়, বরং এ দুয়ের মাঝামাঝি। তাই যেকোনো পাঠক, বিশেষ করে নবীন পাঠকেরা পড়তে গিয়ে মনোযোগ হারিয়ে ফেলবেন না।
• সংক্ষিপ্ত হওয়ার পরেও প্রয়োজনীয় বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির কমতি নেই এতে। বরং বেশ তথ্যসমৃদ্ধ হওয়ায় এ বইটি নিজেই আরেকটি রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
• এই একটি সীরাহ রচনা করতে গিয়ে লেখক সাহায্য নিয়েছেন প্রায় ৯১টি গ্রন্থের! সুতরাং বইটির বিশুদ্ধতা নিয়ে আলাপ করা নিষ্প্রয়োজন।
• স্বাভাবিকভাবেই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীতে রয়েছে এক মহনীয় টান। অত্র গ্রন্থটির বর্ণনার ধারাবাহিকতা এবং প্রাঞ্জলতা যেকাউকেই আরো আকর্ষিত করবে এর শেষ অবধি পড়ার জন্য।
• বইটিতে কেবল রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীই মলাটবদ্ধ করা হয়নি, বরং প্রাক-ইসলামি যুগে আরবের প্রাকৃতিক, জাতিগত, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি অবস্থাও তুলে ধরা হয়েছে। অতঃপর ক্রমান্বয়ে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভ, মাক্কী জীবন, হিজরত, মাদানী জীবন, জিহাদি জীবন, মক্কা বিজয়, ইন্তেকাল – সবকিছুই বর্ণনা করা হয়েছে।
• এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত স্থানের মানচিত্রও যোগ করা হয়েছে গ্রন্থটিতে। এতে মূল ঘটনা বুঝতে বেশ সহজ হয়েছে।
◾ পাঠ মূল্যায়ন : ভালো লাগা – মন্দ লাগা
____________________________________
সীরাহ পাঠের অনুভূতি কেমন হয়, তা আসলে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়৷ তার ওপর “আর রাহীকুল মাখতূম” এর মতো অসাধারণ সীরাহ! রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী পড়তে গেলে কখনো আপনাকে কাঁদতে হবে, কখনো আপনার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠবে হাসির রেখা, আপনার অন্তরাত্মায় লাগবে প্রবল ঝাঁকুনি, বৃদ্ধি পাবে ঈমান। সীরাহ হিসেবে “আর রাহীকুল মাখতূম” এর প্রভাবও এর ব্যাতিক্রম নয়।
আমার হাতের কপিটি মূলত দারুল হুদা কুতুবখানা থেকে প্রকাশিত মূল বইয়ের বঙ্গানুবাদ। অনুবাদ বেশ ঝরঝরে। ভাষায় মাধুর্য আছে, আছে আবেগের সফল-মিশ্রণ। দাম অনুযায়ী পৃষ্ঠার মানও তেমন খারাপ না। প্রচ্ছদটাও মোটের ওপর সুন্দরই বলা যায়। সীরাহ হিসেবে “আর রাহীকুল মাখতূম” যেমন সফল, অনুবাদ গ্রন্থ হিসেবে দারুল হুদার অনুবাদটিও প্রশংসার দাবিদার।
তবে দারুল হুদার এ কপিটির দুই-এক জায়গায় আমার কাছে একটু অশোভনীয় লেগেছে। যেমন :
• বইয়ের কভারে লেখকের নাম লেখা আছে এভাবে – ‘মুবারকপূরী’। অথচ ‘পূরী’ শব্দাংশের ‘প’ এর নিচে ‘হ্রস্ব-উ কার’ হবে। বইয়ের কভারেই এ রকমের ভুল নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু।
• যদিও বইয়ের কভারে ‘মুবারকপূরী’ আছে, তবে ভেতরে লেখা হয়েছে ‘মোবারকপুরী’। আবার এক জায়গায় আছে ‘ইসলামী’, আরেক জায়গায় ‘ইসলামি’। একই বইয়ে একই শব্দের বানানে বৈসাদৃশ্য নিশ্চয় বইয়ের মান কমিয়ে দেয়।
◾ গ্রন্থকার সম্পর্কে দু’কলম
____________________
মাওলানা সফিউর রহমান মুবারকপুরী রহিমাহুল্লাহ। জন্ম গ্রহণ করেছেন ১৯৪৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুবারকপুরের হুসাইনাবাদ গ্রামে। এ মহান আলেমে দ্বীন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাত্রত্ব শেষ করার কিছুকাল আগেই রচনা করেন “আর রাহীকুল মাখতূম” এর মতো কালজয়ী সীরাহ। এছাড়াও রচনা করেছেন আরো ত্রিশোর্ধ্ব কিতাব। কর্মজীবনে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে এ মহান মনীষী ইন্তেকাল করেন।
◾ একনজরে গ্রন্থ পরিচিতি
______________________
• গ্রন্থ : আর রাহীকুল মাখতূম
• গ্রন্থকার : মাওলানা সফিউর রহমান মুবারকপুরী রহিমাহুল্লাহ
• প্রকাশনী : তাওহীদ পাবলিকেশন্স
• পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৫৫৯
• প্রচ্ছদ মূল্য : ৫২০ ৳