উস্তাদ মুহাম্মাদ হুবলস। অস্ট্রলিয়ান দাঈ। প্রচন্ডভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে পারেন। জাহিলিয়াত থেকে মানুষকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসা, বস্তুবাদি যান্ত্রিক আটপৌরে জীবনে হাঁপিয়ে উঠা এই আমাদেরকে আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেওয়া, জান্নাতের পথে চলার সীমাহীন শক্তি যোগাতে এই উস্তাদের তুলনা তিনি নিজেই।
.
উস্তাদের লেকচার অবলম্বনেই এই বইটি। বর্তমান সময়ে আমরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছ তা ভয়াবহ। ফিতনার সময় চলছে। আমাদের অনেক সমস্যা, অনেক প্রতিবন্ধকতা। তার মধ্যে অন্যতম মুসলিম পরিবারে জন্মেও উম্মাহর একটা বড় অংশ্যই এখনও কাফেরদের লাইফ স্টাইলে চলে। অনেকসময় আমরা বুঝি যা করছি ভুল করছি, এটা সঠিক পথ নয়, কিন্তু ভুলের সেই চক্র থেকে বের হতে পারি না। তখন আমাদের একটি ধাক্কার দরকার পড়ে। এমন কিছু যা আমাদের অন্তরকে কাঁপিয়ে দিবে। বস্তুবাদ, চোখ ধাঁধানো আলোর এই মোহের জগৎ নিমিষেই ভেঙে গুড়িয়ে দিবে। এই বইটি সেই ধাক্কা হিসেবে কাজ করবে এই আমাদের বিশ্বাস।
mahmud03 –
মুসলিন পরিবারে জন্মেও উম্মাহর একটা বড় অংশই অনুসরণ করছে কাফেরদের লাইফস্টাইল। আধুনিকতার সাথে ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে মোডিফাই করতে গিয়ে নিজের দ্বীনকেই বিকৃত করে ফেলছি আমরা অনেকেই। অনেক সময় আমরা বুঝি যে আমরা ভুল করছি, এটা সঠিক পথ নয়, আমাদের লক্ষ্য এমন হওয়ার কথা ছিল না, আমার কাজ আমাকে গন্তব্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে না। কিন্তু ভুলের সেই চক্র থেকে বের হতে পারি না। তখন আমাদের একটা তীব্র ধাক্কার দরকার পড়ে যাতে আমাদের মোহ কেটে হুশ ফিরে আসে। প্রয়োজন হয় এমন কিছুর যা আমাদের অন্তরকে কাঁপিয়ে আমাদের ভুলগুলোকে চোখের সামনে তুলে ধরবে। সেই প্রয়োজনবোধ থেকেই অস্ট্রেলিয়ান দাঈ উস্তাদ মোহাম্মাদ হোবলোস এর লেকচারের শর্ট রিমাইন্ডারগুলোর অনুবাদ নিয়ে সাজিদ ইস্লামের “এপিটাফ” বইটি।
বইয়ের বিষয়বস্তু:-
বইয়ের প্রথমেই তুলে ধরা হয়েছে বিলাসবহুল জীবন কাটানো আলি বানাতের জীবন শেষের গল্পটুকু। মোহে আচ্ছন্ন মানুষটিকে কিভাবে আল্লাহ তায়ালা হেদায়েত দিলেন ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি রোগের মাধ্যমে। ক্যান্সার কি কখনো কারও জন্য উপহারস্বরূপ হতে পারে? কিন্তু আলী বানাতের জন্য ছিল তা রবের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় উপহার।
.
আজকাল কোনো যুবক যদি আয়নায় তাকিয়ে চেহারায় সামান্য একটা পিম্পল দেখে সে আঁতকে উঠে, নিমিষেই মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু বইয়ে এমন একজনের কথা বলা হয়েছে যার সারা শরীরে ঘা হওয়ার ফলে পুরো শরীর ব্যান্ডেজ দিয়ে বেধে রাখার পরও তা নিয়ে ভাবার সময়ও তার সময় নেই। সে চিন্তিত রবের দরবারে মিলিত হওয়া নিয়ে।
.
বইয়ে বিভিন্ন সেলিব্রিটির কথা বলা হয়েছে যাদের দুনিয়ার মাফকাঠিতে আদর্শ মনে হলেও, তারা নিজেরাই ছিলেন জীবন নিয়ে হতাশ। এর মধ্যে আছেন বিখ্যাত অভিনেত্রী ‘জাইরা ওয়াসিম’ থেকে ওয়াল্ড চ্যাম্পিয়ন ‘বিলি’ও।
.
আলোচনা এসেছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ‘আসল পুরুষ’ ক্রাইটেরিয়ার। আসল পুরুষ বা রিয়াল ম্যান বলতে আমরা কি বুঝি আর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন তা নিয়ে বিস্তর টনক নাড়ানো বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। আমরা যে ক্রাইটেরিয়া তৈরি করেছি তাতে রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবিরাও ফিট হবেন না, অথচ তারাই ছিলেন ইসলামের আসল পুরুষ। বীর, সাহসী, আল্লাহভীরু। তবে কি আমাদের মানদণ্ডই ভুল। এই অংশটা পড়ে একটা বড় ধাক্কা খেয়েছি।
.
তৎকালীন সময়ে অন্যতম একটি আলোচনার বিষয় হচ্ছে- নারীর বেপর্দা। এটা কি কেবলই নারীদের দোষ? যেখানে নারীদের উপর তাদের বাবা, বড় ভাই, স্বামীকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। পুরুষরা যেদিন ‘পৌরুষ’ হারিয়েছে, নারীদের তখন হারিয়ছে হায়া। এ ব্যাপারেও কিছু ঘটনা ও যুক্তি তুলে ধরেছেন।
.
আরো আছে, জান্নাতের বর্ণনা, কুরআনের আলোকে দুনিয়ার বাস্তবতা। কেন মুসলিম উম্মাহর উপর নির্যাতনের জন্য প্রত্যেকে আমরা নিজেরা দায়ী।
কিভাবে আমরা আল্লাহর সামান্য ইবাদত করেই নিজেদের অনেক বড় কিছু ভাবি, এর ভয়বহতা কি। মুসা ও ঈসা (আ.) এর সময়কার কিছু ঘটনাও উল্লেখ আছে। জীবনের উদ্দেশ্য কি, কেনই বা আমাদের পৃথিবীতে পাঠানো হলো, বলিউডের আড়ালের কথা এবং শয়তানের ধোকা দেওয়ার পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে এই বইটিতে।
.
‘প্রতিটি মানুষই স্পেশাল’ নামে একটা মোটিভেশনাল প্রবন্ধও আছে। কিভাবে এবং কেন আমরা প্রত্যেকে স্পেশাল তা নিয়ে মাঝারি ধরনের আলোচনা আছে। কেবল মোহাম্মাদ হোবলোসের লেকচারই নয় বরং কিছু বিদেশি গল্পও স্থান পেয়েছে বইটিতে। সর্বোপরি, দু’টি কবিতার মাধ্যমে বইটির ইতি টানা হয়েছে।
ভালো লাগা-মন্দ লাগা:-
বইটির অনুবাদ খুব সহজ এবং সাবলীলভাবে করা হয়েছে, অনুবাদে কোন ক্রুটি চোখে পড়েনি। নিত্যদিনে করা ছোট ছোট থেকে বড় বড় ভুলগুলোর কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যা আগে তেমনভাবে ভেবে দেখিনি।
বইয়ের প্রচ্ছদটা হয়েছে অনুপম। প্রচ্ছদটাই এমন – যে দেখলে বইটার বিষয়বস্তু কি সেটা নিয়ে মনের মধ্যে কৌতুহল জাগে।
খারাপ লাগা বলতে- বইয়ে বেশ বানান ভুল দেখা গিয়েছে। কিছু পৃষ্ঠা পর পরই ভুল চোখে পড়েছে, সম্ভবত প্রুফ রিডিং করা হয় নি।
আর বইয়ে এমন কিছু আলোচনা তুলে আনা হয়েছে যা অনেক আগেই বাংলায় অনুদিত আছে, তাই তেমন নতুনত্ব অনুভব করি নি। এগুলো বাদ দিলেও পারতো। বইয়ে উল্লেখিত হাদিসগুলোর খুব কম সংখ্যকেরই রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে, যদিও হাদিসগুলো বহুল পরিচিত এবং বিশুদ্ধ। তবুও এটি বইয়ের মান প্রকাশ করে।
মন্তব্য:-
বইটি প্রথমে একটানা পড়ে শেষ করবো বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু খানিক পড়েই নিজেই লজ্জা পেতে থাকি। তাই ধীরে ধীরে পড়ি এবং নিজের ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা করি। ‘নবীজি যেখানে প্রতিবেশী’- এই লেখাটা আমাকে লজ্জা দিয়েছে। চরম লজ্জা। ‘এমন জান্নাত- যার তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত’- এই লেখাটা আমার অন্তরকে সবচেয়ে বেশি ছুঁয়েছে। জান্নাতে যাওয়ার জন্য আমার অন্তরকে ব্যাকুল করে তুলেছে। আমার ধারণা, এই লেখাটা পড়ার পর বেশিরভাগ মানুষের জান্নাতের যাওয়ার আগ্রহ আরো প্রবল হয়ে যাবে । বইটা মনের কোণায় নতুন চিন্তার খোরাক তৈরি করবে, যা আমারো হয়েছে। নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে কি করছি আমি? এটাই কি আমার করার কথা ছিল? আমাকে কি এরই আদেশ দিয়ে পাঠানো হয়েছিল?