জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের উপরে সন্তুষ্ট নই। নিজেরাই নিজেদের বলি হুজুগে বাঙালি। কিন্তু আমরা এই হুজুগের কারণ খুঁজতে ভুলে যাই। নিজেদের ‘হুজুগে’ দোষারোপ করাকেই আমরা আত্মসমালোচনা মনে করি। স্থুল বুদ্ধির কারণে অনলাইনে আমরা হয়ে উঠি নির্বিচার বিনোদনবাদী, ট্রলবাজ। জাতি হিসেবে গণপরিসরে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নেই বললেই চলে। জ্ঞান আর অজ্ঞতার মধ্যে আমরা পার্থক্য করতে জানি না। ফলত, আমরা নিজস্ব কতগুলো ডগমাকে আঁকড়ে ধরে থাকি, আর তাকেই সত্যজ্ঞান করি। আর অবচেতন মনে বারবার আওড়ে চলি- ‘আমিই সত্য, আমিই ঠিক।’
ডগম্যাটিক মেন্টালিটির কারণে আমরা অন্যদের মতামতকে স্পেইস দিতে শিখি না। আমরা ক্রমশই অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে থাকি। একটা ঘটনাকে যে অপরাপর দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যায়- তা আমরা ভুলে যাই। আমাদের দৃষ্টিতে যেহেতু অন্যরা ভুল- তারা ক্রমেই হয়ে ওঠে আমাদের শ্রেণিশত্রু। ফলে যে শান্তির খোঁজে আমাদের এত এত ডগমার সৃষ্টি- সে ডগমাই হয়ে ওঠে আমাদের শত অশান্তির মূল কারণ।
তাই বলে সব মতামতই কি সত্য? অবশ্যই না, তবে সত্যের উন্মোচনের জন্য সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তা থাকা লাগে। ধরলাম আমার অনেক কিছুই সঠিক, তাই বলে কি আমি পুরোপুরিই ঠিক? এখানে ‘আমি’ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। ইগোর চর্চা আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা পরস্পর ব্যস্তানুপাতিক। বুদ্ধিবৃত্তির নামে এদেশে যা চর্চা হয় তাকে বেশিরভাগ সময় ইগোর চর্চা ছাড়া অন্যকিছু বলা যায় না। আবার যারা সত্যিকারের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন- তাদের চিন্তার ব্রাহ্মণ্যবাদীতা কিম্বা ভাষাগত দুর্বোধ্যতার কারণে গণমানস তা নিজেদের জীবনের সাথে রিলেইট করতে পারে না। ইগোর চর্চাকারীদের ভাষাগত তুলনামূলক স্পষ্টতার দরুন তাদের বৌদ্ধিক অপ্রতুলতা জনতার চোখে ঢাকা পড়ে যায়। আর চিন্তানায়কদের অপরিপক্ব অনুসারীরা জন্ম দিয়ে চলে নতুন নতুন ডগমা।
মানুষ কীভাবে বুঝবে- কোনটা সত্য আর কোনটা ভুল? এটা বোঝার জন্য গণমানসে মিনিমাম লেভেলের যোগ্যতা তৈরি হওয়াটা জরুরি। দুঃখজনক হলেও সত্যি- আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের চিন্তা করতে শেখায় না। আমরা শৈশবের সেই বুদ্ধিদীপ্ত মননকে হারিয়ে ফেলি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাযন্ত্রের গ্যাড়াকলে। ফলে এদেশের স্কুল-কলেজে পড়ে আমরা বের হই অদক্ষ-বস্তুবাদী কর্মচারী হয়ে, আর মাদ্রাসায় পড়ে আমরা হয়ে উঠি হীনমন্য কিম্বা গোঁড়া! বাস্তবতার সাথে আমরা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে রিলেইট করতে পারি না; কিম্বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে কীভাবে জীবনের সাথে মেলাতে হয়- তা আমরা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে শিখতে পারি না।
জাতি হিসেবে আমরা চিন্তাশীল ও মননশীল হতে পারি নি, তার পেছনে অনেক ঐতিহাসিক কারণ যেমন আছে- তেমনি এর পেছনে সরকারি বেসরকারি অব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোগের অভাবও বহুলাংশে দায়ী। আমরা গণপরিসরে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারি নি। শেখার চাহিদা মানুষের স্বভাবজাত, কিন্তু শিক্ষার উপযুক্ত উপকরণ ও পরিবেশের অভাবে তারা ঝুঁকে পড়ে চা দোকানের গসিপ আর গুজব চর্চায়, অথবা বানোয়াট কেচ্ছা-কাহিনী নির্ভর বিভিন্ন গ্রামীণ ওয়াজের মজলিসে। আর বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতার ফলে আমাদের সো-কল্ড শিক্ষিত সমাজ ও চিন্তানায়কদের অপরিপক্ব অনুসারীরা ভীড় করে নব-নব ডগমায়।
গণপরিসরে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আর উপযুক্ত স্থান ও পরিবেশ থেকে শেখার সুযোগ না পাওয়ায় তাদের মাঝে চলে জ্ঞানের নামে অজ্ঞতার চর্চা। এতে করে মোটাদাগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৃহত্তর সমাজ ও সংস্কৃতি।
শেখার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সুযোগ হোক অবারিত। এরজন্য সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠুক নবনব সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হয়ে উঠুক সহজবোধ্য ও লৌকিক। মানুষের মাঝে কমনসেন্সগুলো জাগ্রত হোক। মানুষ হয়ে উঠুক পরমতসহিষ্ণু ও প্রাণবন্ত। সত্যিকারের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হোক সহজলভ্য। সমাজ হয়ে উঠুক ইতিবাচক অর্থে প্লুরালিস্টিক এবং ইনক্লুসিভ। জাগ্রত হোক গণমননশীলতা, উদ্দীপিত হোক আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। এই হোক আমাদের আগামীর প্রত্যাশা।
© জাহিদ হাসান
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান