জাপানের একটি অজানা দ্বীপ। ৯ম ও ১০ম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হলো কিছু খাবার, পানি ও অস্ত্রসহ। আর তাদের গলায় বেঁধে দেওয়া হলো একটি ব্যান্ড। কেউ যদি পালানোর চেষ্টা করে, তাহলে সেই ব্যান্ড ফেটে সে মারা যাবে। আর দ্বীপটি থেকে কেবল সে-ই ফিরে যেতে পারবে—যে সবাইকে হত্যা করে ওই দ্বীপে বেঁচে থাকতে পারবে।
এটি কিমজি ফুকাসাকু পরিচালিত ‘ব্যাটেল রয়্যাল’ নামক একটি জাপানি চলচ্চিত্রের কাহিনি, যা ২০০০ সালে প্রচারিত হয়। এই চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রেন্ডন গ্রীণ তৈরি করেছে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় গেইম—প্লেয়ারস আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড বা পাবজি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে অ্যান্ড্রয়েড মাধ্যমে মুক্তি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে গেমটির ডাউনলোড সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত গেমটির ডাউনলোড সংখ্যা ৭৩৪ মিলিয়ন। শুধু বাংলাদেশেই এর সংখ্যা ২৩৬ মিলিয়ন।
আমাদের আশেপাশে তাকালে দেখা যায় প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরাও এই গেইমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন জরিপ আর গবেষণার পর ২০১৮ সালের জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংস্করণে (আইসিডি-১১), ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ হিসেবে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে। বর্তমানে এই ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ বাংলাদেশের অন্যতম একটি সামাজিক সমস্যা।
এই গেইম আসক্তি একদিকে যুব সমাজের অবক্ষয়ের কারণ, অপরদিকে সুস্থ প্রজন্ম বিকাশের অন্তরায়। যেখানে একটি তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে কর্মোদ্যম থাকার কথা, সেখানে তাদেরকেই আনপ্রোডাক্টিভ সময় কাটাতে দেখা যায়। যাদের স্বপ্ন দেখার কথা অসুস্থ সিস্টেমের পরিবর্তন করা, তারাই গেইম আসক্তির ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গেইম তাদের করছে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত। শিশু-কিশোরদের হাতে দেখা যায় বইয়ের বদলে মোবাইল। টেবিলে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকার পরিবর্তে দেখা যায় গেইমে বুঁদ হয়ে থাকতে। শুধু তাই নয়, এর ফলে দিনদিন তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব গেইমে অর্থের অপচয় বিরাট আকার ধারণ করছে। শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনৈতিক ব্যবসা। অনেকেই অর্থ জোগাড় করতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
তাদের সুস্থ জীবনযাপন বাধার মুখে পড়ছে। পরিবার, সমাজ, পড়াশোনা, স্বাভাবিক খেলাধুলা থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তারা। যেকোনো কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি, পড়াশোনার মনোযোগ কমে যাওয়া, নানা ধরনের পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে এসব গেইমের প্রতি আসক্তি। এই গেইমে যুদ্ধের পরিবেশ মানুষের মনোস্বত্বে প্রভাব ফেলার কারণে উগ্রতা প্রকাশের আশঙ্কা তো আছেই। কেউ কেউ গেইমের প্রভাবে আশেপাশের মানুষকে মারতে যাচ্ছে কিংবা আত্মহত্যার পথে পা বাড়াচ্ছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম।
আজ বস্তুবাদ গেড়ে বসেছে আমাদের মাঝে, ভুলতে বসেছি আমাদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। এই গেমিং অ্যাডিকশনের পেছনে সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ কারণ নিজের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা না করা। লক্ষ্য সম্পর্কে উদাসীন হওয়া। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে মুমিনের যেসব গুণ উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে অনর্থক কথাবার্তা ও অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকা একটি। লক্ষ্য যদি হয় চূড়ান্ত সফলতা, তাহলে পাবজির মতো অসার ক্রিয়াকলাপে মেতে সময় অপচয় করা যায় না। এছাড়াও নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে।
বাংলাদেশে পাবজি গেইমের নেতিবাচক প্রভাব শুরু থেকে লক্ষ্যণীয় হলেও ২০২০-২১ সালে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় অনলাইনে ক্লাস করার সুবাদে শিক্ষার্থীরা ইনটারনেটের অবাধ ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে পাবজি নামক এই মানসিক বিকৃতিকারী গেইমের জগতে। বাড়ছে বইবিমুখতা, সৃষ্টি হচ্ছে নিত্য নতুন সমস্যা।
এছাড়াও অভিভাবকদের অসচেতনতার ফলে মাদকাসক্তির মতো এসব অনলাইন গেইম তরুণ- তরুণীদের গ্রাস করে ফেলছে। হাতে ফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার তুলে দিয়ে পিতামাতা দুজনেই যখন সন্তানের ভবিষ্যত সুখ নিশ্চিত করতে ব্যস্ত, তখন আর খেয়াল রাখেন না এগুলোর অপব্যবহার তার সন্তানের সেই ভবিষ্যত ধ্বংস করতে যথেষ্ট। অভিভাবকরা সন্তানকে ঠিকমতো সময় না দেওয়ায় তারা এসব অনলাইন গেইমে মেতে ওঠে এবং একসময় তা আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
যেকোনো সমস্যা সমাধানে গূরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, সেই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে। একটা গেইম তৈরির পিছনে মুখ্য বিষয় হচ্ছে ব্যবসা। যেসব ব্যবসার কারণে তরুণ সমাজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়, সেসব ব্যবসা বন্ধ করতে সোচ্চার না হওয়ার ফলে দিনকে দিন বেড়েই চলছে অনৈতিক ব্যবসা আর তরুণদের অনলাইন গেম আসক্তি।
বাংলাদেশে সম্প্রতি শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) পাবজি ও ফ্রি ফায়ার বন্ধ করতে সুপারিশ করেছে। তবে এখনো এটি বাস্তবায়িত হয়নি। সমস্যা সমাধানে আমাদের করণীয়:
• জরুরি ভিত্তিতে প্রসাশনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পাবজিসহ আসক্তি সৃষ্টকারী গেইমগুলোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা।
• সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া এবং মূল্যবোধ শেখানো। একই সঙ্গে সন্তান-অবিভাবকের সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো। শিশু-কিশোরদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, তাদের কথা শোনা, তাদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করা।
• ছোটদের অযথা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার না দেওয়া এবং এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইসসমূহের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করা।
• সভা-সেমিনার করে অনলাইন গেমিং-এর কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
• বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। বই পড়লে মনের পরিধি বাড়ে। একই সঙ্গে সৃজনশীলতা, চিন্তা করার ক্ষমতা উদ্ভাবনী শক্তিও বাড়ে। এতে করে একদিকে যেমন অনলাইন গেমিং-এর করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, অন্যদিকে জ্ঞান অর্জনে এগিয়ে যাবে তরুণ সমাজ। তাই পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন আত্ন-উন্নয়নমূলক বই পড়তে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা। তরুণ প্রজন্মকে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভাবনার খোরাক জোগায় এমন বই পড়তে দিলে তাদের মধ্যে নিজস্ব সচেতনতা তৈরি হবে এবং অনলাইন গেইমের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও কমে যাবে।
• দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও স্বাভাবিক খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখা।
তরুণ প্রজন্মকে বলতে চাই, তারুণ্যের এই উদ্যমী সময়টা কি কেটে যাবে তুচ্ছ একটি গেইমের পিছনে? দেখো পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন—তোমরাই সর্বোত্তম জাতি। মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভূত করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো ও আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো। [আলে-ইমরান: ১১০]
আমাদের সময়গুলো যদি এই অর্থহীন গেইমের পিছনে চলে যায়, তাহলে কখন আমরা সমগ্র মানবজাতির প্রতি দায়িত্ব পালন করব? আমাদের সমাজের বিধর্মীদের তাওহীদের দিকে ডাকব? আমরা সৎকাজ না করলে কীভাবে অন্যকে সৎকাজের আদেশ দেবো? গেইমের পিছনে আমাদের চিন্তাশক্তি বিকিয়ে দিলে কীভাবে আমরা উম্মাহকে নিয়ে চিন্তা করব? কীভাবে ডুবন্ত এ উম্মাহকে বাঁচাব—যদি নিজেরাই গেইমের নেশায় ডুবে যাই? কীভাবে অসুস্থ সিস্টেমকে পরিবর্তন করব—যদি নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ি?
আল্লাহ তাআলা বলেন—যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে বিগলিত হওয়ার সময় হয়নি? [সূরা হাদীদ: ১৬]
অনেক তো হলো মিথ্যা মরীচিকার পেছনে ছোটা। জাগো তারুণ্য, জাগাও অন্যকে। এগিয়ে চলো দীনের পথে। স্রোতের টানে ভেসে না চলে শুরু হোক পরিবর্তনের সূচনা।
একটি দেশ বা জাতির ভবিষ্যতের সোপান হচ্ছে তার তরুণ প্রজন্ম। তরুন প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গেলে শুধু তার নিজের ভবিষ্যতই ধ্বংস হয় না, ধ্বংস হয় তার দেশ ও জাতি। অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারদিক। একটু সচেতনতা, কোন উদ্যোগ এই অন্ধকার ছাপিয়ে তরুন প্রজন্মকে দেখাতে পারে এক টুকরো আলো। সেই আলোয় আবার চারপাশ হতে পারে আলোকিত, সুন্দর। আসুন মাদককে ‘না’ বলার মতো গেমিং অ্যাডিকশনকেও ‘না’ বলি।
তথ্যসূত্রঃ
(১) Wikipedia.com
(২) roarmedia.com
(৩) প্রথম আলো ও অন্যান্য
(৪) বই-আয়নাঘর
© সাদিয়া সুলতানা
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান