রবিউল আউয়াল এলে তোমারই গান গাই!
এমন ঘটনা বিরল হলেও আপনাদের আশপাশে কখনো কখনো ঘটতেও পারে। আমাদের বাড়িতে কিছু ছোট ছোট দোচালা ঘর ছিল। একটি পরিবার ভাড়া থাকত। একেবারেই প্রান্তিক শ্রেণির। নিরক্ষরতা আর দারিদ্র্য তাদের ঘরে হাত ধরাধরি করে চলে। তার ছিল তিনটি সন্তান। শুনেছিলাম তার স্ত্রী আবার সন্তান-সম্ভবা। ছোট ছেলেটার বয়স তখন বছর পাঁচেক। অন্যদের সাথে গোসল করতে গিয়ে পুকুরের পাড়ে পাড়ে সাঁতার কাটে।
একদিন সকালবেলা শুনলাম লোকটার স্ত্রী আরেকটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। দরিদ্র হলেও আনন্দের সীমা নেই তাদের। ঘরের সকলের মুখে এক অনাবিল আনন্দের ঝিলিক। কিন্তু তা বেশিক্ষণ রইল না। দুপুরের দিকে শুনলাম বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি, কান্নাকাটির রোল। ছোট ছেলেটা পুকুরে ডুবে মারা গেছে। বাবা নিথর হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নীরব অশ্রু। আর প্রসূতি ঘর থেকে মায়ের সে কি আঠালি-পাঠালি চিৎকার! কী হৃদয়বিদারক কান্না।
কেন? একটি ছেলে গিয়েছে তো কী হয়েছে! আরেকটি ছেলে তো জন্ম হয়েছে আজই! একই দিনে!
ভালো-পবিত্র-ন্যায়-কল্যাণ-উত্তম—এগুলোর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বেশি থাকলেও বিপরীতটার উপস্থিত প্রভাবক শক্তি বেশি। ভালো-মন্দ, পবিত্র-অপবিত্র যদি একত্রিত হয়, সে ক্ষেত্রে মন্দই প্রভাব বিস্তার করে নেয়। একটা ভালো মানুষের পরিবেশে দু-একটা দুষ্টই গোটা পরিবেশ ধ্বংস করে দিতে পারে। এক বালতি দুধের মধ্যে যদি এক চামচ মূত্র পড়ে, তবে গোটা দুধটাই পানের অযোগ্য হয়ে যায়। একটা পবিত্র কাপড়ে সামান্য নাপাকি লাগলে পুরা কাপড়টা অপবিত্র হয়ে যায়।
এভাবে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার ব্যাপারটিও কিছুটা এমন। একই সময়ে যদি আনন্দ ও দুঃখের দুটি কারণ ঘটে, তবে দুঃখই মানুষের মনোজগতের ওপর জয়লাভ করে। একই দিনে যদি কারও একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে আরেকটি সন্তান মৃত্যুবরণ করে, তা হলে সে পরিবার সন্তান জন্মের খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করতে পারে না।
বিষয়টিকে কেবল শার’ঈ বিধান দিয়ে বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই, সৃষ্টিতে আল্লাহপ্রদত্ত প্রকৃতির মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কিন্তু মানুষ যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কিছু করে, তখন শারিআও মানে না প্রাকৃতিক বিধানও মানে না। যা মন চায় তা-ই করতে থাকে।
আমাদের সামনে রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসে এমনই একটি উপলক্ষ্য আমাদের সামনে এসেছে। এই মাসে প্রিয়নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও মৃত্যুর মাস। ঠিক কোন তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ বা মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেই দিনে বা এই মাসে আমাদের করণীয় কিছু আছে কি না, সেটা নিয়েই আজ আমাদের কথা।
প্রথমত আমাদের জানা দরকার যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন কেউ জানতই না যে তিনি ভবিষ্যতে নবি-রাসূল কিছু হবেন; বরং তিনি আরবের আর পাঁচটি ছেলের মতো একটি সাধারণ শিশু এবং এতিম অনাথ একটি শিশু। স্বাভাবিক কারণেই, ক্যালেন্ডারহীন আরবজাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করা একটি এতিম শিশুর জন্মক্ষণ ঠিক দিন-তারিখ নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখার মতো বিশেষ কোনো কারণ ছিল না। এ কারণে তাঁর জন্মের সন ও মাস নির্ভুলভাবে জানা গেলেও সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ভুলভাবে জানা যায় না। ঐতিহাসিকদের কেউ রবিউল আউয়ালের ২ তারিখ, কেউ ৪ তারিখ, কেউ ৮, কেউ ১২ তারিখ বলেছেন। এ ছাড়াও আরও কিছু ভিন্ন ভিন্ন তারিখও পাওয়া যায়।
দেখা যায় ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি যখন ইন্তেকাল করেছেন তখন তিনি ছিলেন মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মানুষ হিসেবে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন হিসেবে, আখেরী নবি ও রাসূল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাই তাঁর ইন্তেকালের দিন-ক্ষণ-তারিখ-সন নির্ভুলভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সামান্য কিছু ভিন্নমত পাওয়া গেলেও তাঁর ইন্তেকালের দিন-ক্ষণ-তারিখ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর সেই তারিখটি হলো ১২ রবিউল আউয়াল।
এক্ষণে ১২ রবিউল আউয়াল তাঁর জন্ম তারিখ কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এটা যে তাঁর মৃত্যুদিন, এটা নিশ্চিত। আর সন্দেহ ও নিশ্চয়তা একত্রিত হলে সন্দেহ নাকচ হয়ে নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেহেতু ১২ রবিউল আউয়াল নিশ্চিত তাঁর মৃত্যুদিবস। আর প্রিয়নবির মৃত্যুদিবসকে ঈদ ও আনন্দ উদযাপন তারাই করতে পারে, যারা তাঁর মৃত্যুতে খুশি হয়েছে! আল্লাহুল মুস্তা‘আন।
প্রিয়নবির জন্মদিনকে যদি নিশ্চিতভাবে প্রমাণও করা যায়, তা হলে সে দিনকে আনন্দের দিন হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কি না—এ প্রশ্নটিই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, ইসলাম কখনো মানুষের প্রকৃতিবিরুদ্ধ কোনো বিধান দেয় না। পৃথিবীতে মানুষ যে-সকল উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে খুশি হয়, আনন্দ প্রকাশ করে তার মধ্যে একটি হলো প্রিয় কারও আগমন। একটি সন্তানের জন্ম হলেও মানুষ আনন্দিত হয়, সেখানে সৃষ্টির সেরা মানুষ, প্রাণপ্রিয় নবির জন্মে সে আনন্দিত হবে না এটা হতে পারে না। অবশ্যই একজন মু’মিন আনন্দিত হবে। আনন্দিত হওয়ায় কোনো বাধা নেই।
প্রশ্ন হলো, সেই আনন্দ আপনি কীভাবে প্রকাশ করবেন তা নিয়ে। আপনি যদি বিদ‘আতের অন্ধগলিতে না ঢুকে, আল্লাহর দ্বিনের মধ্যে মনগড়া অনুষ্ঠানের জন্ম না দিয়ে, শরী‘আতের সীমার মধ্যে থেকে তা প্রকাশ করেন, তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
এক্ষেত্রে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হলেন আল্লাহর নবির প্রাণপ্রিয় সাহাবিগণ। তারা আল্লাহর নবির জন্য জীবন উৎসর্গ করাকেও তুচ্ছ মনে করেছেন। তারা আল্লাহর নবির জীবদ্দশায় তাঁর সাথে অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন, যে বছরের মধ্যে নবিজির জন্মের মাসটিও এসেছিল নিশ্চয়ই। আমরা যদি দেখতে পাই যে, তারা তাদের আনন্দ প্রকাশ করার জন্য কিছু করেছেন তবে সেটাই সর্বোত্তম পদ্ধতি আনন্দ প্রকাশ করার। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশুদ্ধ বর্ণনায় সাহাবিদের থেকে আমরা “নবিজির জন্মদিন” শিরোনামে কোনো আনুষ্ঠানিক উদযাপনের মতো কিছু খুঁজেই পাই না।
নবিজির জন্মদিনে রোজা রাখা :
ইমাম তিরমিযি আবু হুরায়রার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সোম ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহর কাছে বান্দার) আমল উপস্থাপন করা হয়; আমি চাই রোজাদার অবস্থায় আমার আমল উপস্থাপন করা হোক।” (হাদিস নং ৭৪৭, হাসান শ্রেণিভুক্ত)
ইমাম মুসলিম আবু কাতাদা আল আনসারীর সূত্রে বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর সোমবার দিনের সিয়াম পালনের কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বলেন, “এই দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনেই আমার ওপর ওয়াহি নাজিল শুরু হয়।” (হাদিস নং ১১৬২)
উল্লিখিত হাদিস দুটি থেকে এটা স্পষ্ট যে সোমবার দিন নবিজির সিয়াম পালনের একাধিক কারণ রয়েছে। জন্মগ্রহণ, ওয়াহি লাভ এবং আমল উপস্থাপন। জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি এসব কারণের একটি। আখেরি নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাত হওয়া। সুতরাং ক্ষমা লাভ, সিয়ামরত অবস্থায় আমল উপস্থাপন এবং নবিজির উম্মাত হতে পারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের। তাঁর আগমনের খুশিতে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ যদি কেউ সোমবার সিয়াম পালন করে এটা অবশ্যই একটি উত্তম কাজ হবে।
তবে মনে রাখতে হবে যে, এটা শুধু বছরের একটি সোমবার নয়; নবিজি সাধারণত প্রত্যেক সোমবারই রোজা রাখতেন। তাই যদি কেউ এই আমল করতে চায় তাঁর উচিত হলো যত বেশি সম্ভব প্রতি সোমবারে রোজা রাখা। বছরের একটি সোমবারকে আলাদা করে বিশেষভাবে রোজা রাখার কোনো সুন্নাহভিত্তিক যৌক্তিকতা নেই।
একটি বিষয় খেয়াল করুন। হাদিস থেকে নবিজির জন্মের তারিখ হিসেবে ১২ রবিউল আউয়ালের কোনো নিশ্চয়তা আসেনি, কিন্তু দিন হিসেবে সোমবারের নিশ্চয়তা এসেছে। আর প্রত্যেক বছর বার ও তারিখ যুগপৎ সোমবার ও ১২ তারিখ হওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার। যেমন এ বছরই আমাদের দেশে ১২ রবিউল আউয়াল হচ্ছে রবিবার; আরব বিশ্বে যেটা শনিবার। অথচ নবিজির জন্ম হলো সোমবার। এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন কী করবেন?
প্রচলিত মিলাদ ও মিলাদুন্নবির নামে যে ধরনের কর্মকাণ্ড আজকাল করা হয়ে থাকে এগুলো যে সর্বসম্মতভাবে প্রত্যাখ্যাত, তা নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না। কারণ, বিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ে এসে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক যে চর্চা দেখা যায়, তাতে যার ঘাড়ে মাথা আছে সে এটা এমনিতেই বুঝতে পারে যে, নবিজির ইন্তেকালের কয়েক শতাব্দী পরে ফাতিমী শাসনামলে উদ্ভাবিত এসব গর্হিত কর্মকাণ্ড কখনো ইসলামসম্মত হতে পারে না।
আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন; সঠিক পথে থাকার তাওফিক দান করুন! আমিন।
© আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান〢বিশ্বমান