বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা মুসলিম মুজাহিদদের সংখ্যা বলুন তো কত? ৩১৩ জন। এ তথ্য অধিকাংশ মুসলিমই জানে। প্রায় চৌদ্দ শ বছর আগে সংঘটিত একটা যুদ্ধে কতজন যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের নাম, তাদের গোত্রের নাম, তাদের বয়স, সেই যুদ্ধে আরোহণ করা উট ও ঘোড়ার সংখ্যা, যুদ্ধে উভয় দলের নিহতের সংখ্যা, কুরাইশবাহিনীর বন্দী হওয়া যোদ্ধাদের নাম ও গোত্রের নাম—এমন সকল কিছু ইসলামের ইতিহাসে লেখা রয়েছে।
রাসুল নিজে নিরক্ষর ছিলেন, লিখতে পড়তে জানতেন না। কিন্তু সাহাবিদের শিক্ষার জন্য তিনি যেন আধুনিক যুগের মায়েদের মতো ছিলেন, যারা বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য হাতে সবসময় একটা বই নিয়ে ঘুরে বেড়ান। রাসুলের অবস্থাও ঠিক এমন ছিল। যেখানে সামান্য লেখাপড়ার সুযোগ হতো সেখানেই তিনি সাহাবিদের জন্য শিক্ষার দ্বার খুলে দিতেন।
বদরের যুদ্ধের পরবর্তী দৃশ্যের দিকে লক্ষ করুন। এ যুদ্ধে কুরাইশদের ৭০ জন যোদ্ধা বন্দী হয়। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে রাসুল সিদ্ধান্ত নেন, এ বন্দীদের মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। এক হাজার দিরহাম থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয় বন্দীদের মুক্তিপণের হার। যারা অবস্থাসম্পন্ন ছিল তাদের জন্য চার হাজার, আর যারা খানিকটা কম সম্পন্ন ছিল তাদের জন্য তিন, দুই বা এক হাজারে মুক্তির শর্ত নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু যেসব কুরাইশ বন্দী একেবারেই কপর্দকশূন্য গরিব ছিল, তাদের ব্যাপারে কী করা হবে? তারা তো অর্থ দিতে পারবে না। রাসূল শিক্ষার এই সুযোগও হাতছাড়া করলেন না। তিনি জানালেন, যারা মুক্তিপণের অর্থ দিতে পারবে না, তারা প্রত্যেকজন মদিনার দশজন করে বাচ্চাকে আরবী পড়া ও লেখা শেখাবে। যখন এসব বাচ্চা পড়তে ও লিখতে শিখে যাবে তখন তাদের মুক্তি দেওয়া হবে।
রাসুল কেন শিক্ষার প্রতি এত গুরুত্ব দিয়েছিলেন? বস্তুত তিনি ভবিষ্যত মদিনাকে একটি শিক্ষিত ও সংগঠিত কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। মুসলিমদের তিনি এমন একটি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যারা আজকের ইতিহাস যেমন লিখতে পারবে, তেমনি লিখতে পারবে ভবিষ্যত পৃথিবীর ইতিহাসও।
রাসুল মদিনায় আগমনের পরই লক্ষ করেছিলেন, মদিনার ইহুদিরা ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে বসবাস করছে। মদিনার নেতৃত্ব আউস-খাজরাজ গোত্রের হাতে থাকলেও সকল সিদ্ধান্তের জন্য ইহুদিদের ধর্না ধরে বসে থাকতে হতো। কারণ আউস-খাজরাজের লোকেরা তাদের কাছে দেনার দায়ে আবদ্ধ ছিল। সবচে বড় কথা, ইহুদিদের সকলেই ছিল শিক্ষিত। ঐশীগ্রন্থ তাওরাতের নির্দেশনায় তাদের সবাই শিক্ষাগ্রহণ করত এবং মদিনায় তাদের একটি স্বতন্ত্র বিদ্যায়তনও ছিল। যেখানে ইহুদি পণ্ডিতরা শিক্ষা দিত তাদের সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের। জ্ঞানে ও ধনে ইহুদিরা সবসময় বড়াই করত মদিনাবাসীর ওপর। নেতৃত্বের মসনদ আউস-খাজরাজের দখলে থাকলেও শিক্ষা ও জ্ঞানের কারণে তারা তাদের গোনায় ধরত না। এ বিষয়টি রাসুলের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।
M. Hasan Sifat –
৩১৩ ! সংখ্যাটা খুব পরিচিত লাগছে তাই না ? ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল এই সংখ্যাটি । এই সংখ্যাটির সাথেই জড়িয়ে আছে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, চেতনা আর অনুপ্রেরণা । এই সংখ্যাটিকেই উপজীব্য করে লেখক সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ইতিহাস আশ্রিত গল্পভাষ্য– “৩১৩ : বদরযুদ্ধের ঐতিহাসিক গল্পভাষ্য” ।
–
❒ বইয়ের আলোচ্য বিষয়—
 ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄
বইটি ইতিহাসকে আশ্রয় করে লেখা গল্পভাষ্য । ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের ইতিহাসকে শব্দের অনুপম গাঁথুনি দিয়ে গল্পের আদলে উপস্থাপন করা হয়েছে । শ্বাসরুদ্ধকর সেই ইতিহাস কখনো নবিজীর হাত ধরে, কখনোবা সাহাবীদের হাত ধরে ছুটে বেড়িয়েছে বইয়ের পাতায় । কখনো হাজার হাজার বছর পূর্বের ইয়েমেন সাম্রাজ্যে, কখনো তপ্ত মরুভূমিতে, কখনোবা মক্কা থেকে ইয়াসরিবের খেজুর বাগানে আর সবশেষে পূর্ণতা পেয়েছে বদরের প্রান্তরে বিজয়ীর বেশে ।
–
বইটি বদর যুদ্ধের গল্পভাষ্য হলেও শুরু হয়নি বদরের প্রান্তর থেকে । শুরুতেই লেখক আমাদেরকে নিয়ে গেছেন হাজার হাজার বছর আগে । বইটির শুরুতেই আছে বদর যুদ্ধের তিনটি পূৰ্বাভাষ ৷ পূৰ্বাভাষগুলোতে আলোচিত হয়েছে মদিনায় ইহুদিদের গোড়াপত্তন, আউস ও খাজরাজের গোড়াপত্তন এবং ইয়াসরিবের ইহুদিদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিলীন হওয়ার ইতিহাস ৷ ৬ যুবকের হাত ধরে মদিনায় কিভাবে ইসলামের সূচনা হলো সে ঘটনা দিয়েই শুরু হয়েছে বইয়ের মূল পর্ব ৷ বাদ যায়নি নবিজী ﷺ এর মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের ঘটনা আর সেখান থেকে কিভাবে তিনি হয়ে উঠলেন মদিনা রাষ্ট্রের প্রাণ । এরপর ধাপে ধাপে লেখক পৌছেছেন বইয়ের মূল আলোচনায়, ১৭ রমাদানের সেই রাতটিতে । যে রাতের দুআ সপ্তাকাশ ভেদ করে যাত্রা শুরু করেছিল আল্লাহর আরশ অভিমুখে ।
–
❒ পাঠ্যানুভূতি—
 ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄
গদ্যশৈলি আর বর্ণনাভঙ্গির অপূর্ব সংমিশ্রণের কারনে বইটিকে সুখপাঠ্য মনে হয়েছে । হাজার বছর আগের ইতিহাসের অলিতে-গলিতে ছুটে বেড়ানো এক সুদীর্ঘ জার্নি যেন এই বইটি । এই জার্নি জেরুজালেমের ইহুদি সাম্রাজ্য থেকে ইয়েমেন সাম্রাজ্যে । কখনোবা ফল, ফসল আর প্রাচুর্যে পূর্ণ ইয়াসরিবে । মনে হয়েছে, লেখক টাইম মেশিনে করে বদরের প্রান্তরে ঘুরতে নিয়ে এসেছেন আর আমি যুদ্ধের ময়দানের একপাশে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় যুদ্ধক্ষেত্র অবলোকন করছি । যুদ্ধের ময়দানের কিছু কিছু দৃশ্যে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি । লেখক যথাসম্ভব ইতিহাসের শুদ্ধতা বজায় রেখেছেন ৷ শুধুমাত্র পাঠকের একঘেঁয়েমী দূর করতে মূল বর্ণনাকে ঠিক রেখে ভাষাকে গল্পের মতো করে বর্ণনা করেছেন । সবকিছু ছাপিয়ে হাদিস ও সিরাতের সূত্রনির্ভর ধারাবর্ণনায় রচিত হয়েছে এই বইটি ।
–
প্রিয় পাঠক, ইতিহাসের মরুবালিতে পা ডুবিয়ে, পড়তে পারেন এ বইটি ।
মনোরম গল্পভাষ্যে আর বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বাংলাভাষায় সিরাত পাঠের এটি একটি নতুন সংযোজন ।
–
–
বই— “৩১৩ : বদরযুদ্ধের ঐতিহাসিক গল্পভাষ্য”
প্রকাশনী— “নবপ্রকাশ” পাবলিকেশন ।