ফিলিস্তিন নিয়ে উপন্যাস-গল্প-কবিতা-ইতিহাস অনেক পড়া হয়েছে। অনেক ইমেজ, ডকুমেন্টারি, ভিডিও দেখা হয়েছে। কিন্তু এমন কলজেছেঁচা উপন্যাস কখনো পড়েননি। জেনিনের একটি গ্রাম থেকে দূরবীন চোখ দিয়ে ফিলিস্তিনের ৭০ বছরের ইতিহাসকে উপন্যাসের ফ্রেমে আটকে দেওয়া হয়েছে। একটি পরিবারের কাহিনি, একটি পরিবারের চার প্রজন্মের বন্ধন, আত্মত্যাগ, সহমরণ, অবিনাশী চেতনা, প্রেম-ভালোবাসা, হাসি-কান্না—আর এর মাঝ দিয়ে খচ খচ করে কাঁটার মতো রক্তাক্ত করা দানব-নাম—ইসরাইল!
না, এ বইয়ে টান টান উত্তেজনার সাসপেন্স নেই। থ্রিলার উপন্যাসের আচমকা কোনো ক্লাইমেক্স দৃশ্য নেই। নেই সাহসী কোনো বীরের গল্প। তবে এ বইয়ের প্রতিজন ফিলিস্তিনি একেকজন বীর। প্রতিজন মা একেকজন খাওলা, একেকজন আসমা। যারা সন্তানের রক্তমাখা শার্ট ফ্রেমে বন্দি করে টাঙিয়ে রাখে ঘরের দেয়ালে। প্রেমিকের জন্য পাঠায় গোলাপ এবং মাথায় বাঁধবার একটি সাদা-কালো কুফেইয়া। ট্যাংক আর যুদ্ধবিমানের ছোঁড়া বোমায় ছিন্ন ভিন্ন দেহের পরিচয় হবে ওটা—আমার স্বামী শহিদ!
ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম ও মাতৃভূমি হারানোর বিক্ষুব্ধ বেদনাকে ভাষ্য করে সুজান আবুলহাওয়া রচিত ২৫টি ভাষায় অনূদিত বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা উপন্যাস মর্নিংস ইন জেনিন বাংলাভাষী পাঠকের জন্য সুপ্রভাত ফিলিস্তিন নাম দিয়ে অনুবাদ করেছেন নাজমুস সাকিব।
Meher Afroz –
বইঃ সুপ্রভাত ফিলিস্তিন
লেখিকাঃ সুজান আবুলহাওয়া
অনুবাদঃ নাজমুস সাকিব
প্রকাশনাঃ নবপ্রকাশ
মূল বইয়ের নাম ‘মর্নিংস ইন জেনিন’। যা ফিলিস্তিন শহরের জেনিনের একটি গ্রামের গল্প। ত্বীন আর জয়তুন গাছে আচ্ছাদিত এক ছায়া সুনিবিড় গ্রাম হলো ‘আইনে হুজ’। কিন্তু এ গল্প কী কেবলই আইনে হুজের?
না! এ বইটি গল্প বলেছে পুরো ফিলিস্তিনের,ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের আদি-অন্ত বয়ান করেছে ভালোবাসার টলমলে চোখে। সুতরাং, একে গল্পগ্রন্থ বললেও ভুল হবে না। কারণ, এই আমল, ডালিয়া, সারা, হাসান, হুদা, ইউসুফ, আরি কিংবা ফাতিমা’ চরিত্রগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে সত্যিকারের ফিলিস্তিনির অধিবাসী। আর ডেভিড, আমাল, বাসিমা, মাজিদ’ দের জীবনধারা বর্ণনায় উঠে এসেছে সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, ভালোবাসা, প্রতীক্ষা, প্রেম এবং ফিলিস্তিনের প্রতিটি রক্ত বিন্দুর বুকফাটা আকাঙ্খা।
নিজ দেশ থেকে বিতারিত ইহুদিদের তারা দয়াবশত ফিলিস্তিনে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছিলো।আর সেই অভিশপ্ত ঈহুদিদের বুটের আঘাতে শত শত মুসলিম প্রাণ আজ খসে পড়ছে। তবু সেই অতি দয়ালু ও অসহায় ফিলিস্তিন বাসি তাদের মতো হিংস্রতা প্রদর্শন না করে শুধু নিজেদের নায্য আবাস ভূমি ও নিরাপত্তা চেয়ে গেছে। আর তাই তো নিজ দেশে স্মরনার্থী হয়ে থেকেও নিজের ভূমি-ভিটা পাবার প্রতিক্ষায় থাকে। সত্তর বছরের নিরন্তর প্রতিক্ষা একদিন তাঁরা ফিরে পাবে হারানো জমিন। প্রতিটি ভোর এসে তাদের কানে শুনিয়েছে বিজয়ের নাকারা।
পাঠ্যানুভূতিঃ—
আমি বাসিমা, ডালিয়া আর আলম’ সম্পর্কে পড়ে স্থবির হয়ে যাই। এই প্রেরণাদাত্রীগণ ছিলেন (আছেন) বলেই হাসান, ঈউসুফ আর মাজিদেরা বারংবার যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে এবং একসময় শহীদি মৃত্যু উপভোগ করে।
আমার ভালো লাগে বিয়ের আগে ডালিয়ার ছেলে ‘মানুষী’, ‘আরি’ আর ‘হাসানে’র গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনটি’কে।ভালো লাগে হুদা আর আমলের শৈশব-কৈশোর থেকে বড় হয়ে উঠার দিনগুলো।তাদের দুষ্টুমিগুলো। আরোও ভালো লাগে হাজি সালেমের ফোঁকলা দাঁতের হাসিটুকু। ইয়াহিয়া, হাজি সালেমের এক সাথে বসে পাশা খেলে নিঃসঙ্গতা দূর করার সময়গুলো। ভালো লাগে ‘আমল আর মাজিদের’ ছোট্ট সংসার, সারা’কে নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আরো একটা দম্পত্তিকে ভালো লাগে। ইউসুফ আর ফাতিমা। ভালো লাগে হুদার বিড়ালের মতো ভালোবাসার কুঁড়েঘরকে।
কিন্তু ভালো লাগে না সেই প্রাণচঞ্চল ডালিয়ার জীবন্তলাশ হয়ে থাকা দিনগুলো।ভালো লাগে না ইয়াহিয়া, ইউসুফ, হাসানের হৃদয়বিদারক শেষ পরিণতি। আমি ডুকড়ে কেঁদে উঠি।আমার ভালো লাগে না গর্তে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট ‘হুদা’ আর আমলে’র কোলের মৃতবাচ্চার গলে যাওয়া পাকস্থলীটি। ভালো লাগে না শ্মরনার্থী শিবিরে পড়ে থাকা কাঁটা হাত, কাঁটা মগজ, উলঙ্গ নারীর মৃতদেহ। কিংবা মাটিতে পরে থাকা জোয়ান ছেলেগুলোর কর্তনকৃত লিঙ্গ।পড়তে নিয়ে গাঁ গুলিয়ে বমি আসে যুবকদের উলঙ্গ মৃতদেহ আর গণকবরের বর্ণনা।
বইটি পড়ে পাঠক জানতে পারবেন পরাধীন ফিলিস্তিনের উপর চালানোর ধ্বংসযোগ্যের নির্মম বর্ণনা। বইটা কেবল আমাকে কাঁদিয়েছে।আবার কাঁদনের মাঝে শিখিয়েছে ইসলামের তরে বেঁচে থাকার আনন্দ কতটা! বইটি সকলের পড়া উচিৎ। জানা উচিৎ ফিলিস্তিনের নির্মম অতিত।নিজেকে বসিয়ে অনুভব করা উচিৎ পরাধীনতার স্বাদ কেমনতর হয়।
রিভিউদাতাঃ Meher Afroz