রবি বিন খুসাইম রহ. তার জীবনে এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। যখন তার এক পার্শ্ব অবশ হয়ে পড়েছিল, তখনও তিনি দুজন ব্যক্তির কাঁধে ভর করে মসজিদে গমন করতেন। তার শিষ্যরা বলত, ‘হে আবু জাইদ, আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার জন্য সুযোগ রয়েছে। আপনি চাইলে বাড়িতেই নামাজ পড়তে পারেন।’ জবাবে তিনি বলতেন, ‘সুযোগ আছে বটে, কিন্তু আমি যখন মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে শুনতে পাই “হাইয়া আলাল ফালাহ—এসো সফলতার দিকে।” তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। সুতরাং তোমাদের কেউ যদি সফলতার প্রতি এই আহ্বান শুনতে পায়, সে যেন বুকে ভর দিয়ে কিংবা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও সেই ডাকে সাড়া দেয়।’ (হিলইয়াতুল আওলিয়া : ২/১১৩)
কেমন ছিল পূর্ববর্তী নেককারদের সালাত? কীভাবে তারা সালাতের মাধ্যমে আমাদেরকে এগিয়ে গেলেন? সালাতের তাৎপর্য, খুশু খুযু অর্জনের উপায়, সালাত পরিত্যাগকারীর বিধান, ইত্যাদি আলোচনায় ভরপুর বক্ষ্যমাণ বইটি।
Din Muhammad Sheikh –
▪ অবতরণিকা :
“সাত বছর বয়সে তোমাদের সন্তানদের নামাজের ব্যাপারে আদেশ করবে এবং দশ বছর বয়সে নামাজ না পড়ার কারণে প্রহার করবে।”
সম্ভবত আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের ব্যাপারে এরচেয়ে কঠিনভাবে আর কখনোই কিছু বলেননি।
আমরা জানি, মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা উচ্চারণ করেছিলেন, তা ছিল, “সালাত, সালাত।”
আমরা এও জানি, বিচারের দিন প্রথমে সালাতের হিসেবে নেওয়া হবে।
তাই সালাত মুমিনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এক ইবাদাত। উপরন্তু মুমিন এবং কাফেরের মাঝে পার্থক্যকারী এই সালাত।
আজ আমরা পরিচিত হবো সালাত সম্পর্কিত একটি বইয়ের সাথে, যার নাম “জান্নাতের চাবি”। লিখেছেন শাইখ আব্দুল মালিক আল কাসিম।
▪ একনজরে বই পরিচিতি :
◾ বই : জান্নাতের চাবি
◾ লেখক : শাইখ আব্দুল মালিক আল কাসিম
◾ অনুবাদ : হাসান মাসরুর
◾ প্রকাশনী : রুহামা পাবলিকেশন
◾ প্রকাশকাল : নভেম্বর, ২০১৯
◾ পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৫৬
◾ প্রচ্ছদ মূল্য : ৬৭/-
▪ লেখক সম্পর্কে দু’কলম :
ড. শাইখ আব্দুল মালিক আল কাসিম (হাফি:)। জন্মেছেন রিয়াদের উত্তরে অবস্থিত ‘বীর’ নগরীতে। বাপ-দাদা উভয়েই ছিলেন যশস্বী আলেম। বলা যায়, পৈত্রিক সূত্রে তিনিও পেয়েছেন সে সম্পদ। উপহার দিয়েছেন সত্তরেরও অধিক কিতাব। ‘আইনা নাহনু মিন হা-উলায়ি’ নামে তাঁর আত্মশুদ্ধিবিষয়ক সিরিজটি কুড়িয়েছে বেশ জনপ্রিয়তা। সে সিরিজের দ্বিতীয় কিতাব ‘জান্নাতের চাবি’।
▪ বইয়ের আদ্যোপান্ত :
বইয়ের শুরুতেই ছোট্ট একটি ভূমিকা। অতঃপর ‘ইসলামে নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য’ শিরোনামে মূল আলোচনা।
– কোন ইবাদাতকে আল্লাহ তা’আলা প্রথম ফরজ করেছেন?
– দ্বীনের কোন বিধানটি সবশেষে হারিয়ে যাবে?
– ‘ওয়াইল’ নামক জাহান্নাম কাদের জন্য?
– নবীজীর শেষ অসিয়াত কী ছিল?
প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে আপনাকে পড়তে হবে বইয়ের এ অংশটুকু। সংক্ষিপ্ত অথচ দলিল-আদিল্লায় পরিপূর্ণ এক প্রেরণাদায়ক আলোচনা!
এরপর লেখক আমাদেরকে দেখিয়েছেন নামাজের প্রতি সালফে সালেহীনদের আবেগ ও ভালোবাসা। আহ! নামাজকে কতটাই না ভালোবাসতেন তাঁরা!
নামাজ ফরজ। জামাআতে নামাজ আদায় করা ওয়াজিব, কম করে হলেও সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। জামাআতের গুরুত্ব অনির্বচনীয়। জামাআত পরিত্যাগকারীর প্রতি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতটাই না ক্রুদ্ধ হতেন! এ পর্যায়ে লেখক দলিল এবং সালাফদের ঘটনা উল্লেখপূর্বক জামাআতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব এবং ফজিলত বুঝিয়েছেন।
খুশু-খুজুহীন নামাজ প্রাণহীন দেহের মতো। নামাজে সালাফদের খুশু-খুজুর বর্ণনা পড়লে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়, ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। লেখক এখানে সালাফদের খুশু-খুজুর উদাহরণ পেশ করেছেন খুব আকর্ষণীয় ভাষায়।
এছাড়াও বইটিতে লেখক নামাজের ব্যাপারে মানুষকে পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। হে আল্লাহ, আমাদেরকে বইয়ে উল্লিখিত পঞ্চম শ্রেণির নামাজি হিসেবে কবুল করে নাও।
বইটির একদম শেষের দিকে নামাজ পরিত্যাগকারীর বিধান আলোচিত হয়েছে। লেখক এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ পরিত্যাগকারীকে কাফের বলেছেন। অবশ্য কিছু হাদীসে এরূপ ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। এটি একটি ইখতিলাফি বিষয়। তবে আমাদের মতে হাদীসে উল্লিখিত কুফর দ্বারা ছোট কুফর নির্দেশিত, যার দরুন ব্যক্তি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে না।
▪ পাঠ-প্রতিক্রিয়া :
অসাধারণ একটি বই। পড়েছি, ভেবেছি নিজেকে নিয়ে; মিলিয়েছি নিজেকে সালাফদের সাথে। ধিক্কার জানিয়েছি নিজেকে নিজের গাফলতের জন্য। পেয়েছি প্রেরণা, জেগেছে উৎসাহ। ছোট্ট একটি বই, অথচ অত্যন্ত প্রভাবক। তাই বলবো, “আপনিও পড়ুন।”
▪ বইটি কেন পড়বেন :
বইটি আপনার পড়া উচিত। কারণ :
– বইটি পড়ে আপনি নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে পারবেন।
– এতে আছে নামাজ সম্পর্কিত কিছু আয়াত-হাদীস, যা আপনাকে নামাজের প্রতি আকর্ষিত করবে।
– এ আয়াত-হাদীসগুলো আপনার মনে ভয় জাগাবে, যদি আপনি নামাজে উদাসীন হয়ে থাকেন।
– আপনি জানতে পারবেন জামাআতের গুরুত্ব ও ফজিলত, যা আপনাকে জামাআতে যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
– সালাফদের খুশু-খুজুর ঘটনা পড়ে নিজেকে সে পথে পরিচালিত করার উৎসাহ পাবেন।
– নামাজ পরিত্যাগকারীর বিরুদ্ধে কঠিন হুঁশিয়ারি শুনে আপনি নামাজের ব্যাপারে আরো হুঁশিয়ার হবেন।
ইংশা আল্লাহ।
▪ ভালো লাগা-মন্দ লাগা :
• বইটির যা ভালো লেগেছে :
– উন্নত বাধাই
– প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ
– বানান বিভ্রাটের অনুপস্থিতি
– সাবলীল অনুবাদ
– দালিলিক আলোচনা
– অল্প কথায় অধিক ভাব প্রকাশ
• বইটির যা মন্দ লেগেছে :
– নামাজ পরিত্যাগকারীর হুকুম নিয়ে ফুকাহায়ে কেরামের মাঝে ইখতিলাফ আছে। বইয়ের লেখক যে মতাবলম্বন করেন, তা তিনি উল্লেখ করেছেন। সম্পাদকের উচিত ছিল, টীকার মধ্যে দু’চার কথায় লেখকের বিপরীত মতটাও উল্লেখ করে দেওয়া৷ আমাদের দেশের অধিকাংশরাই লেখকের বিপরীত মতের তাকলিদ করে থাকেন। সুতরাং এ কথা বিবেচনা করে, উক্ত মতকেও টীকায় সংযুক্ত করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি।
▪ পরিশেষ :
সালাত ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। নামাজে আরো প্রেরণা পেতে, আরো আগ্রহী হতে আমাদের আলোচ্য বইটি বেশ কার্যকরী। আল্লাহ বইয়ের লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক এবং তৎসংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন।