ছেলেটা ছিল এক বন্ধুর ছোট ভাই। সে এক নায়িকার প্রেমে বদ্ধ পাগল হয়ে পড়ল। তখনকার সময়ে প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না, ভিসিআরের যুগ। ঘরে যুদ্ধ করে ভিসিআর কিনল, একাকি ঘরে বসে তার মুভি দেখার জন্য।
এফডিসির গেইটে গিয়ে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। কোনোক্রমে যদি জানতে পারত কোথাও সেই নায়িকার আউটডোর শ্যুটিং চলছে যে-কোনো মূল্যে সে সেখানে হাজির হয়ে যেত। বাবা ইউরোপে থাকত। বাড়িতে টাকা-পয়সা যা পাঠাতো নানারকম ছলচাতুরি করে টাকা-পয়সা নিয়ে এসব করে বেড়াত। সংসারে এসব নিয়ে নানারকম অশান্তি হতো।
তার নিজের রুমের চারিদিকের ওয়ালে সেই নায়িকার নানারকম আবেদনময়ী অঙ্গভঙ্গির ছবি টানানো থাকত। সার্বক্ষণিক দেখার জন্য মানিব্যাগে ছবি থাকত। সেই নায়িকার যে কোনো মুভি বের হলে সেটা এনে একা একা ঘরে বসে দেখত। হলে গিয়ে দেখতে চাইত না, কারণ সেখানে অন্যরাও একসাথে তাকে দেখে–এটা তার নাকি সহ্য হয় না।
দিনে দিনে তার চেহারা-সুরৎ স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছিল। তদন্ত করে জানা গেলো যে, যখন সে এক্সট্রিম মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে, নায়িকার উদ্যাম নাচের ভিডিও ছেড়ে দেখে, আর মাস্টারবেশন করে।
লেখাপড়া গোল্লায় গেছে। বাবা বিদেশ গিয়ে কামলা খেটেছিলেন এই আশায় যে সন্তানরা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে, কিন্তু পরে বাবার মতো নিজেকেও বিদেশ গিয়ে কামলা খাটতে হচ্ছে। কিছুই হতে পারেনি ছেলেটা, যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট হওয়া সত্ত্বেও।
সমাজের জন্য একজন নায়িকা বেশি ক্ষতিকর না একজন পতিতা এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে, বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে যুক্তি বলে একজন নায়িকা বেশি ক্ষতিকর। কারণ, একজন পতিতা অসংখ্য পুরুষকে উত্তেজিত করে না, বরং একজন উত্তেজিত পুরুষকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শান্ত করে দেয়; এটাকে বৈধ বা ভালো বলা হচ্ছে না, কেবল সাধারণ কর্মবিবরণ মাত্র। পক্ষান্তরে একজন নায়িকা হাজারো মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে উত্তেজিত করে রাস্তায় ছেড়ে দেয়।
শোবিজ তারকাদের কেউ যখন কোনোরকম রেইপ কিংবা শ্লীলতাহানির শিকার হন; এমনকি তাদের কেউ যদি আত্মহত্যা করেন, কিংবা যদি স্যুটকেসে তাদের লাশ পাওয়া যায়, তবুও সমাজের ব্যাপক শ্রেণির মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি তেমন কোনো দরদ দেখা যায় না; বরং তাদের প্রতিক্রিয়াটা এমন হয় যেন, “ঠিকই হইছে, ভালো হইছে, এমনটাই তোর প্রাপ্য ছিল”।
কেন সাধারণ মানুষের তাদের প্রতি দরদ নেই সেটা তাদের ভেবে দেখা দরকার। কিছুদিন আগে পরালোকগত এক বিখ্যাত নায়িকা জীবিতকালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি জীবনে এমন একজন মানুষ পাননি যার সাথে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে গল্প করা যায়! এটা খুবই দুখঃজনক ব্যাপার।
যারা অসংখ্য মানুষের চোখের কাছে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত করে তোলেন- তারা হয়ত কোনো কারণে কারো হৃদয়েই কাঙ্ক্ষিত থাকেন না। বরং সকলের কাছেই সস্তা ও সহজলভ্য ওঠেন।
পর্দায় যখন কোনো নায়ক নায়িকাকে অশ্লীল দৃশ্যে দেখা যায় তখন দর্শকদের মধ্যে অবচেতনে তাদের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দানা বাঁধে। খলচরিত্রে অভিনয়কারী ভিলেনের ব্যাপারেও যেমন, অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয়কারী নায়িকার প্রতিও তেমন। তখন যার কাছে টাকা আছে তিনি ভাবেন, কিছু টাকার বিনিময়ে যেহেতু সে একজন পরপুরুষের সাথে অভিনয়ের নামে এতটা ঘনিষ্ঠ আর অশ্লীল হতে পেরেছে, তাহলে অঙ্কটা আরেকটু মোটা হলে হলে হয়তো তার থেকে ‘বাকিটুকুও’ নেওয়া যাবে। যার কাছে ক্ষমতা আছে তিনি ভাবেন ক্ষমতা খাটালে এদেরকে বিছানায় নেওয়া ব্যাপার না! এভাবেই তারা তাদের কৃতকর্মের মাধ্যমে অন্যের মনে সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ার মেসেজটা অজান্তেই দিয়ে দেন। আর তারা যখনই সুযোগ পান যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। এসব ঘটনার যতটুকু বা যে ক’টা প্রকাশ পায় তা কেবলই টিপ অব আইসবার্গ।
হ্যাঁ, কেউই নির্যাতিত হলে “ঠিকই হইছে” টাইপ প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই অগ্রহণযোগ্য—সন্দেহ নেই। একজন মানুষ যতই উচ্ছৃঙ্খল হোক না কেন, যদি নির্যাতনের শিকার হন তখন সেটাকে নির্যাতন হিসেবেই নির্ণয় করা উচিৎ। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির অন্য অপরাধকে টেনে এনে তার উপর সংঘটিত কোনো নির্যাতনকে হাল্কা করার প্রবণতা নির্যাতককে ইনডেমনিটি দেওয়ার নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। একইভাবে একজন মানুষ যেমনই হোক না কেন আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার তার আছে। একজন মানুষ যতই উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করুক না কেন তা তাকে ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের বৈধতা দেয় না।
কিন্তু এত বেশি সংখ্যক মানুষ যখন একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়- তখন সেটাকে কেবল সঠিক বেঠিক নির্নয়ের মধ্যে রাখলেই চলবে না। সাথে এটাও ভেবে দেখা দরকার যে কেন তারা এমন প্রতিক্রিয়া দেখালো; এর পেছনে কী মনস্তত্ব কাজ করছে!
আমাদের দেশের নায়িকারা সিনেমার গানে, অভিনয়ে যে ধরণের অশ্লীল পোশাক পরে থাকেন এবং অশ্লীল আবেদনময়ী অঙ্গভঙ্গি করে থাকেন- তাতে তাদের দর্শকদের অনেকেই ধর্ষক হয়ে ওঠে। তাদের বড় একটা অংশের মধ্যে তাদেরকে সোনালী রুপালি পর্দা থেকে নামিয়ে বিছানায় নেওয়ার একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। সবার তো আর সেই পরিমাণ অর্থবিত্ত শক্তি ক্ষমতা থাকে না। তাই নিজে না পারলেও অন্য কেউ যখন সেই নায়িকাকে তেমন কিছু একটা করে- তখন সে আসলে কিছুটা আঠারোপ্লাস তৃপ্তি পায়; সে সেই ক্রিয়া-কর্মের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় এবং কিছুটা আরামও বোধ করে হয়ত। এই চিন্তাধারা খারাপ নিঃসন্দেহে, তবে এর দায়ভারের বড় অংশটা এই নায়িকাদের নিজেদের ওপর বর্তায়।
অশ্লীল আবেদনময়ী কাজকর্মের স্বাভাবিক অর্থ গ্রহণ করা হয় অন্যকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা। আকৃষ্ট করা ব্যাপারটির মধ্যে বিপরীত পক্ষের প্রতিক্রিয়ার প্রতি একটা মৌন সম্মতি থাকে। একটা মেয়ে যদি অশ্লীল আবেদন করে তাহলে বিপরীতপক্ষ অবেচতনভাবে ধরেই নেয় যে, সে যদি জবাবে তার সাথে একটু ‘দুষ্টুমি’ করে তাতে সে বিরক্ত নয় বরং একটু খুশিই হবে। তো দীর্ঘদিন নায়ীকাদের এসব অশ্লীল আবেদনের পর যখন হঠাৎ কোনোদিন সে তার ধর্ষিত হওয়ার খবর শোনে তখন সে অবচেতনভাবেই ভেবে ওঠে “আরে সে যা চাইছে, তা-ই তো পাইছে, তো রাগ করতেছে কেন?” নায়িকা যে কেবল পয়সা কামাই করার জন্য অভিনয় করছে, এসব অঙ্গভঙ্গি আর আবেদন যে কেবলই কমার্শিয়াল, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যে তার অভিনয়ের চেয়ে ভালোও হতে পারেন, তা বুঝে ওঠার মতো চিন্তা অধিকাংশের মধ্যে না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
অনেক ক্ষেত্রে একজন পতিতাও বেনিফিট অফ ডাউট পাওয়ার সুযোগ রাখে। এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ত রাখে। কারণ, কোনো নারীই স্বেচ্ছায় আনন্দের সাথে পতিতাবৃত্তি করে না। প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই তারা পরিস্থিতির শিকার। সেটা হতে পারে শারীরিক, আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা মনস্তাত্বিক।
একজন পতিতা নিজের কাজ নিয়ে সাধারণত গর্ববোধ করে না, নিজের কাজকে গ্লোরিফাই করে না। প্রকাশ্যে এমন কিছু করে না যে আরও হাজারটা মেয়ে পতিতা হওয়ার জন্য লাইন দেবে। কেউ আপ্রাণ প্রচেষ্টা, অধ্যবসায় আর দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে পতিতা হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে না। পক্ষান্তরে একজন নায়িকা নায়িকা হওয়ার হওয়ার জন্য এর সবগুলো কাজ করে। এবং পর্দায় ও সমাজে এদের গ্লামারাস লাইফস্টাইল দেখে সমাজের হাজারো মেয়ে এই নায়িকা হওয়ার জন্য লাইন দেয় মডেল হাউজগুলোর দুয়ারে, যাদের অধিকাংশের পরবর্তী জীবন নিষিদ্ধ জগতে বিলীন হয়ে যায়।
এই গ্লামারাস ওয়ার্ল্ড-এ গ্লামার পায় হাতে গোনা দু’চার পাঁচটা মেয়ে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মেয়েরা এই গ্লামার দেখে এই জগতে আসার জন্য নিজের ইজ্জত বিকোনোর জন্য প্রস্তুত হয়, ইজ্জত বিকোয়। এই নায়িকারা পতিতাদের মতো পেটের দায়ে, বেঁচে থাকার তাগিদে, নিরুপায় হয়ে এই পেশায় থাকে না। তারা গ্লোরিফাইড পেশা, গ্লামারাস লাইফ, অর্থবিত্তের লোভে এখানে আসে এবং এই স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা অনেক সময় নিজেদের অন্যের বিছানায় বিসর্জন দিতে পিছ-পা হয় না।
সিনেমায় রোল পাওয়ার জন্য নায়িকাদের বিছানায় যাওয়ার যেসব স্টোরি এই পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে- তার মধ্যে অনেকগুলোতেই দেখা গেছে যে এটাকে তারা উন্নতির জন্য প্রয়োজন মনে করেই মেনে নিয়েছেন। তারা এই পেশায় আসার চেয়ে যদি নিজের ইজ্জতকে অধিক মুল্যবান মনে করতেন- তবে চাইলেই ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু যাননি। তাদের অনেকে জীবনের অনেক বসন্ত পার হওয়ার পর তারা সেটাকে ধর্ষণ বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে এগুলোও থাকে নতুন করে মিডিয়ায় ফোকাস পাওয়ার কৌশল। ইজ্জত লুটিয়ে দেওয়াও পেশার জন্য, আবার অনেক দিন পর সেই রগরগে কিচ্ছাও বিক্রি করা হয় পেশার উন্নতির জন্য। তো জনগণ যখন তাদের এসব ঘটনা জানেন- কেউ তাদেরকে কিছু করলে তখন তারা যদি রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া দেখান- তা দেখে জনগণ বোকার মতো বলে বসে, ‘হাহা, কী হইছে? রাগ হইতেছ কেন?”
তাই আমরা শোবীজের বোনদেরকে বলব, একটু ভাবুন, আপনার দর্শকদের আপনি মনের অজান্তেই ধর্ষক বানিয়ে তুলছেন না-তো? যারা আপনাদের উপর চড়াও হওয়ার জন্য ওঁত পেতে থাকবে?
© আবু তাসমিয়া আহমদ রফিক
সিয়ান পাবলিকেশন
বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান