১.
মানুষের নানা ভীতি থাকে। কেউ ভয় পায় তেলাপোকাকে, আবার অনেকে ভূত-পেত্নীতেও ডরে না। সেদিন পরিচিত একজন ফোন দিলেন, তিনি বিয়েকে ভয় পাচ্ছেন। ভয়ের কারণ স্পষ্ট—অজানা পার্টনার সম্বন্ধে আশঙ্কা এড়াতে পারছেন না।
আমি নানান কথা বলে তার ভয় ভাঙাবার চেষ্টা করলাম। একমাত্র ফেরেশতা ছাড়া প্রতিটি প্রাণীকেই আল্লাহ জোড়াবদ্ধ করেছেন। এমনকি গাছও পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় প্রজনন ধারা জারি রাখে। আল্লাহ আমাদের হৃদয় দিয়েছেন; কিন্তু সে হৃদয় আমাদের কাছে থাকে না, অন্যের কাছে জমা রাখতে হয়। এ এক প্রশান্তি; যেটা বর্ণনা করার আ-কার ই-কার উ-কার নেই।
২.
সিয়ান পাবলিকেশনের মহিমান্বিত কুরআন–এরদ্বিতীয় সংস্করণ আসছে। একমনে খুঁটিনাটি ত্রুটিগুলো কুটিকুটি করছি। সুরা ফুরকানের ৫৪ নম্বর আয়াতে এসে চোখ থেমে গেল। সেখানে আল্লাহ বলছেন—‘তিনিই মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। তোমার রব সবকিছু করতে সক্ষম।’
এখনে আল্লাহ মানুষের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে দিয়েছেন, মানুষের বংশপরিচয় আছে, যেটা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। হাতি, হরিণসহ অনেক প্রাণীই দলবদ্ধ হয়ে চলে; কিন্তু বংশীয় পরিচয় তাদের নেই।
তারপর সব প্রাণীই জোড়াবদ্ধ; কিন্তু মানুষের মতো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নয় (জিন ছাড়া)। বিবাহের বিশেষ নিয়ামত আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে তাদের জীবনপ্রবাহ সুসংহত, সুগঠিত ও সুপরিকল্পিত করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
৩.
পৃথিবীতে বিবাহভীতি নতুন কিছু নয়। আগেকার মুনিঋষিরা তাদের ধ্যানে ব্যাঘাতের ভয়ে বিয়ে না করে বৈরাগ্য জীবনযাপন করত। ইসলাম বৈরাগ্যকে নিরুৎসাহিত করেছে। উলটো নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা, একত্রে বসে থাকা, ভালোবাসা বিনিময় করায় সাওয়াব রেখেছে। এগুলো বরং আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ।
বর্তমানে পশ্চিমা সংস্কৃতি পরিবারপ্রথা উপড়ে ফেলছে। বিবাহকে সীমাবদ্ধতা মনে করে বহুগামিতার প্রমোট করছে। যেখানে কোনো দায়বদ্ধতা নেই, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নেই, সুন্দর জীবন উদযাপনের যূথবদ্ধ আকাঙ্ক্ষা নেই।
আমাদের দেশে যে শ্রেণিটা বিবাহে নিরুৎসাহিত করে, খেয়াল করে দেখলাম, এরা হলো সুবিধাবাদী ফেতনাবাজ। মানে নাস্তিকতার সংজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসলামের বিরোধিতা করা। বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের গণহারে খুন করা হচ্ছে, এদের বর্ণনায় সেটাও মুসলমানদেরই দোষ; খুনিরা নাকি সন্যাসী! এদের দ্বিতীয় কাজ হলো, নারীদের খুঁজে খুঁজে ইনিয়ে-বিনিয়ে বিছানায় যাওয়ার কথা বলা। এর ডের নজির আছে আমাদের সামনে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরা বেশ সক্রিয়। বিয়ে নিয়ে যাচ্ছেতাই মন্দাচার করে যায়। একাধিক বিয়ে তো এদের চোখে পৃথিবীর গুরুতর অপরাধ; কিন্তু এরাই আবার পরকীয়া অধিকারের পক্ষে স্লোগান তোলে, বহুগামিতাকে স্বাধীনতা বলে প্রচার করে।
৪.
স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ মানুষকে অন্যের প্রতি দুর্বল করে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের মনটা, মনের খুশিটা আসলে নিজেদের কাছে না, অন্যের কাছে থাকে। পুরুষদের ব্যাপার ম্যানশন করে আল্লাহ কুরআনে বলেই দিয়েছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রোম, ২১)
এই আয়াতে আল্লাহ পুরুষদের বলছেন, ‘যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও’। অর্থাৎ স্ত্রীরা পুরুষদের শান্তির জায়গা। ক্লান্ত শ্রান্ত স্বামী ঘরে এলে স্ত্রী যখন দুয়ার খুলে হাসিমুখে সালাম দেয়, পুরুষের সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি নিমিষে উবে যায়। তারপর আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ককে আল্লাহ সুরা বাকারার ১৮৭ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, ‘তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরা তাদের পোষাকস্বরূপ।’
আমার পরিচিতদের যারা বলে, বিয়ে তো প্যারা। দু-তিনদিন বাদে আবেগ সব পরিবর্তন হয়ে যাবে ‘তেল লাগবে নুন লাগবে’ শিরোনামে। এইতো শুরু প্যারা। আমি তাদের বলি, বিয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই আর সব ছেড়ে দ্বিনদারিকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেমন তুমি চেয়েছ খুব রূপবতী হবে, ক্লাসের ফার্স্টগার্ল থাকবে, কথাবার্তায় স্মার্ট হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সত্যি কথা হলো, কেউই চাহিদামতো ষোলো আনা পায় না। এটা সম্ভব না। মানুষ হিসেবে কেউই নিখুঁত নয়। তার জন্য নিখুঁত হওয়া জরুরিও নয়। সুতরাং আপনি সব ছেড়ে যখন দ্বিনদারিতা প্রাধান্য দেবেন, আপনার জন্য জায়নামাজে বসে দুআ করতে থাকা ব্যক্তিটি কখনোই ইচ্ছে করে আপনাকে কষ্ট দেবে না। সে-ই বরং হবে আপনার ‘কুররাতু আইয়ুন—চোখের শীতলতা’।
সুতরাং, কুরআনের ভাষ্যমতে যখন আপনারা পরস্পরের পোশাক হবেন, আপনাদের মাঝে ছলনা ভণিতা মিথ্যা প্রবঞ্চনা অবহেলা থাকবে না, পোশাকের মতোই পরস্পরকে জড়িয়ে থাকবেন, সঙ্গীর সম্মান রক্ষায় সর্বোচ্চ হওয়ার নিয়ত করবেন, এতে আশা করি বিবাহভীতি কেটে যাবে। যেখানে স্বামী-স্ত্রী একই অঙ্গ, সেখানে সঙ্গীকে প্যারা মনে হবে কেন? আমরা নিজেদের হাত নিয়ে কি অস্বস্তিতে ভুগী? পা দুইটা কেন, তা নিয়ে কি বিরক্ত হই? স্ত্রীও যখন সে রকমই আপনার অঙ্গ, পা মচকে যাওয়ার মতো তার মেজাজ বেঁকে গেলে কেন আপনি তা প্যারা মনে করবেন? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বিবাহ আমার সুন্নাহ। যে আমার সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সুনানু ইবনি মাযাহ, হাদিস নং ১৯১৯)
এবার ভেবে দেখুন, অনলাইনে নারীবাদী হাবিজাবি ছিঁচকেদের প্রোপাগাণ্ডায় পড়ে যখন আপনি তাদের শেখানো পদ্ধতিতে চিন্তিত হচ্ছেন, বিপরীতে কি আল্লাহ ও তার রাসুলের বিপক্ষে চলে যাচ্ছেন না?
বিবাহভীতি কাটিয়ে ওঠার জন্য পড়ুন :
© ওমর আলী আশরাফ
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান