কাগজ কালার: ফোর কালার
তাজউইদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ক্রমবিকাশ ও বিস্তারিত আহকাম সম্বলিত ২২৮ পৃষ্ঠার বই ‘মালামিহু ফিত তাজউইদ’। বইটিতে রয়েছে দুটি অংশ। কিতাবের ‘তাজউইদ শাস্ত্রের ইতিহাস’ অংশটুকু সংকলন করতে আরবী, ইংরেজি ও বাংলা ভাষার বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধের সহায়তা নেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে প্রাচ্যবিদদের গবেষণার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হতে হয়েছে, যেহেতু সেসব ক্ষেত্রে মুসলিম গবেষক নেই বললেই চলে। কেবল এই ক্ষেত্রে উদ্ধৃতি উহ্য রাখা হয়েছে, বাকি ক্ষেত্রে যেখান থেকে সংকলন করা হয়েছে সেটার উদ্ধৃতি পাদটীকায় সংযোজন করার যথাযথ চেষ্টা করা হয়েছে। তাজউইদের ইতিহাসের জের টানতে গিয়ে মাঝে মাঝে অন্যান্য স্বতন্ত্র শাস্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে কিবোর্ড চালাতে হয়েছে। কখনো কখনো সন্দেহপোষণকারীদের প্রশ্নের সুষ্ঠু জবাব দেয়া হয়েছে।
কিতাবের ‘বিস্তারিত আহকাম’ অংশটুকু সংকলনের ক্ষেত্রে তাজউইদ শাস্ত্রের বেশ কিছু জনপ্রিয় বইয়ের সহায়তা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম মাহমুদ খলীল আল-হুসারী (রহ)-এর ‘আহকামু কিরআতিল কুরআনিল কারীম’। এছাড়া তাজউইদকে সহজ করার জন্য যেসব ছবি কিতাবে যুক্ত হয়েছে সেগুলো নেয়া হয়েছে ‘আত-তাজউইদুল মুস্বাওয়্যার’ কিতাবটি থেকে।
সংকলনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে। তার ওপর নিরীক্ষণ করে যাবতীয় ভুল শুধরে দিয়েছেন সম্মানিত উস্তায কমারুদ্দীন আহমেদ (হাফি.), যিনি দীর্ঘকাল জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম (ফরিদাবাদ মাদ্রাসা)-এর সম্মানিত শিক্ষক ছিলেন। আল্লাহ কিতাবটিকে দূর-দুরান্তে ছড়িয়ে দিক, কুরআন প্রেমীদের আখিরাতের পাথেয় করুক।
Muhammad Tamimul Ihsan –
❝ বুক রিভিউ ❞
•
▪︎ বইয়ের নাম : ❝মালামিহু ফিত তাজউইদ❞ (তাজউইদের ইতিহাস,ঐতিহ্য,ক্রমবিকাশ ও বিস্তারিত আহকাম)
▪︎ সংকলক : আব্দুল্লাহ ইবনে জা’ফর
▪︎ নিরীক্ষণ : শাইখ কমারুদ্দীন আহমেদ (হাফি:)
▪︎ প্রকাশক : Inbaat Publication
▪︎ বইয়ের ধরন : তাজউইদ শাস্ত্র
▪︎ প্রচ্ছদমূল্য : ৩২৫/=
▪︎ প্রকাশকাল : মে ২০২১,শাওয়াল ১৪৪২
ו পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং পবিত্রতম গ্রন্থটি হলো পবিত্র কুরআনুল কারিম। আর এই পবিত্র গ্রন্থ সহিহ ও শুদ্ধভাবে পড়তে পারাটা একজন মুসলিমের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আর পবিত্র কুরআনুল কারিম সহীহ শুদ্ধ ভাবে পড়ার অন্যতম মাধ্যমটি হলো ইলমুত তাজউইদ সম্পর্কে অবগত থাকা। আর তা নাহলে কুরআন তিলাওয়াত সহিহ এবং শুদ্ধ ভাবে পড়াটা একপর্যায়ে অসম্ভব বলা চলে।
ইলমুত তাজউইদ মূলত ইলমুল কিরাআ’তের সাথে সম্পর্কিত। আর এই শাস্ত্রটি ইসলামি শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে আদিকাল থেকে হাদীস এবং ফিক্বহ শাস্ত্র নিয়ে ব্যাপক রকমের চর্চা হলেও সমানতালে চর্চা হয়নি বা গুরুত্ব পায়নি ইলমুত তাজউইদ বা কিরাআ’ত শাস্ত্র। এদিকটা থেকে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। আপনি যদি শহুরে জীবন ছেড়ে একটু উঁকি দেন গ্রাম-গঞ্জের দিকে, তাহলেই দেখতে পাবেন আমি কেনো বলছি এই শাস্ত্রে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। এতো কিছুর পরেও আমাদের বাংলা ভাষায় তাজউইদ নিয়ে কোনো বিস্তারিত বই নেই বললেই চলে। যে কয়টা বই আছে তাতে শুধু উঠে এসেছে তাজউইদের সহজ সহজ সহজ আহকামগুলোই। কিন্তু তাজউইদের বিস্তারিত হুকুম আহকাম,ইতিহাস,ঐতিহ্য ও ক্রমবিকাশ নিয়ে কোনো বইই নেই বললে চলে। আর এর সুযোগই একের পর এক ফাঁদ পাতছে মুসলিম বিদ্বেষী প্রাচ্যবিদরা। যার মায়াজালে আটকা পড়ছে আমাদের মুসলিম সমাজের বড় একটি অংশ। আর তাই “ইনবাত পাবলিকেশন” প্রাচ্যবিদদের কঠিন এ ফাঁদ নস্যাৎ করতে এবং বাঙ্গালি মুসলিম সমাজকে কুরআনুল কারিম সহীহ শুদ্ধ ভাবে পড়ার নিয়মাবলি অবগত করাতে নিয়ে এলো ❝মালামিহু ফিত তাজউইদ❞ নামের তাজউইদ শাস্ত্রের উপর দু’শ আটাশ পৃষ্ঠার চমৎকার এ বইটি।
■ কি নিয়ে লেখা এই বইটি :
• শুরুর আলাপে এতক্ষণে হয়তোবা অনেকেই বুঝে গিয়েছেন কি নিয়ে লেখা চমৎকার এই বইটি। তারপর সবার বোঝার স্বার্থে একটু বিস্তারিত আলোচনা করছি। ❝মালামিহু ফিত তাজউইদ❞ বইটি মূলত তাজউইদ শাস্ত্রের উপর একটি সংকলন গ্রন্থ। যা তাজউইদের উপরে বিভিন্ন আরবি কিতাবাদি থেকে অনুবাদ করে বাংলায় সংকলন করা হয়েছে। বইটির বিভিন্ন অংশ সংকলনের তাজউইদ শাস্ত্রের উপর বেশ কিছু জনপ্রিয় কিতাবের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো মাহমুদ খলীল আল-হুসারী (রাহি.)-র লিখিত বিখ্যাত তাজউইদের কিতাব “আহকামু কিরাআতিল কুরআনিল কারীম”। এছাড়াও তাজউইদকে সহজ করার জন্য যেসব ছবি বইটিতে যুক্ত করা হয়েছে সেগুলো নেয়া হয়েছে তাজউইদ শাস্ত্রের উপর আরেকটি জনপ্রিয় কিতাব “আত-তাজউইদুল মুস্বাওয়্যার” থেকে। যা বইটির গুণগত রচনার মান বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ו বইটিতে তাজউইদের আলোচনা শুরু হয়েছে শিক্ষার একদম শুরু থেকে, অর্থাৎ আদম (আ) থেকে। এরপর ধীরে ধীরে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমাচার, সেগুলো বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণ আর এর বিপরীতে কুরআনের সংরক্ষণে তাজউইদের অপরিসীম গুরুত্ব বিস্তারিত দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। তারপর আরবী বর্ণমালার ইতিহাস,ক্রমবিকাশ,বংশধারা নিয়ে চমৎকার আলোচনা করে ক্রমান্বয়ে কুরআন নাযিলের প্রেক্ষাপট, সংরক্ষণ, আবু বকর (রা) এর সময়ে লিপিবদ্ধকরণ, উসমান (রা) এর সময় এক পদ্ধতিতে কুরআন সংকলন, সাবা’আতু আহরুফ, কিরআত কী,কীভাবে এলো, কুররাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী, তাজউইদের সুবিস্তৃত বিভিন্ন আহকাম সহ তাজউইদ নিয়ে এমন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বইটিতে। যা পাঠককে বিচরণ করাবে অনন্য এক জ্ঞানের জগতে।
■ বইয়ের পাতায় পাতায় :
বইটিকে মোট তেত্রিশটি অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত করে আলোচনা করা হয়েছে,যা পাঠককে ধারাবাহিকভাবে জ্ঞান অর্জন এবং সহীহ শুদ্ধভাবে কুরআনে কারিম তিলাওয়াতের নিয়মাবলি ও তাজউইদের ইতিহাস জানতে অসাধারণভাবে সাহায্য করবে।
ו বইটির শুরুর দিকেই আলোচনা করা হয়েছে পূর্ববতী আসমানী কিতাবসমূহ নিয়ে,পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের বর্তমান অবস্থা, সেগুলো বিকৃতি হয়ে যাওয়ার কারণ এবং এর বিপরীতে কীভাবে কুরআনের অস্তিত্ব,টিকে থাকা,ও এর মর্যাদা এই তাজউইদের মাধ্যমেই আল্লাহ টিকিয়ে রেখেছেন তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ו এছাড়াও বইটিতে তাজউইদ নিয়ে মূল আলোচনায় যাওয়ায় আগে আরবী বর্ণমালা কীভাবে এলো,বর্ণমালার উৎপত্তি, হরফের ইতিহাস,হরফের ক্রমবিকাশ,বর্ণমালার বংশধারা, কুরআনের অবতরণ ও লিপিবদ্ধকরণ, কুরআনের সংকলন,কুরআন সহজকরণ নিয়ে বিস্তারিত বিভিন্ন তথ্যগুলো চিত্রসহকারে অসাধারণভাবে আলোচনা করা হ’য়েছে।
ו আলোচ্য বইটিতে এরপরের আলাপে তাজউইদ কবে,কীভাবে,কেন এল? কিরাআত কী,কিরাআত কীভাবে এল,আহরুফ ও কিরাআত কি এক? খত্বের ভিন্নতা,কিরাআতসমূহ লিপিবদ্ধকরণ এবং যে কারণে এসব বিষয়ে ধারণা রাখা প্রয়োজন, তা নিয়ে অসাধারণভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও কুররাদের জীবনীকে দুইভাগে ভাগ করে বিখ্যাত কুররাদের প্রত্যেকের জীবনী রেফারেন্স ভিত্তিক অসাধারণভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
ו বইটির এরপরের অংশে থেকেই মূল বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা শুরু। তাজউইদ পরিচিতি,সুরাতুত তিলাওয়াত,ইস্তি’আযা ও বাসমালা পাঠের নিয়ম,লাহনের হুকুম,হরফ ও হরকত,মাখরাজ,সিফাতে লাযিমাহ,সিফাতে ‘আরিদ্বাহ,মাদ,ওয়াকফ এবং অন্যান্য অধ্যায়ের মাধ্যমে আরো বিভিন্ন সংক্ষিপ্ত সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন জটিল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় উপস্থাপন এবং চিত্র সহকারে উপস্থাপন বইটিকে যেকোনো পাঠকের কাছে অনন্য করে তুলবে।
ו সর্বশেষ বইটিতে মাক্বামাতের পরিচিতি,আটটি মাক্বামাতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং কুরআনুল কারীমের মদীনা মুসহাফ ও ইন্দোপাক মুসহাফের মাঝে পার্থক্য বর্ণনা করে আলোচনার ইতি টানা হয়েছে।
■ যে কারণে বইটি পড়া উচিৎ :
কুরআনুল কারীম শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে না পারাটা সাধারণত দোষের কিছু নয়। অনেকসময়ই পরিবার ইসলামিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা ইসলাম পালনে তেমন আগ্রহী না থাকার ফলে কুরআন তিলাওয়াতটা সহীহ শুদ্ধভাবে হয়ে শেখা হয়ে ওঠে না। তবে শুদ্ধভাবেতিলাওয়াত করার চেষ্টা না করাটা মারাত্মক দূষণীয় ও গুনাহের কাজ। হরফসমূহ নাচেনা, সেগুলোর মাখরাজ ও বৈশিষ্ট্য না জানা থাকা,মাদের হুকুম,গুন্নাহ সম্পর্কে অবগত না থাকার ফলে আমরা বাংলা অক্ষর দিয়ে যখন অনেক সময়আরবি লেখা কুরআন পড়তে যাই তখম তার অর্থ সম্পূর্ণ বিকৃত করে সওয়াবের বিপরীতে উল্টো গুনাহগার হচ্ছি। ফলে এর থেকে উত্তরণের জন্য তাজউইদ শেখার
কোনো বিকল্প নেই। আর তাই বাংলা ভাষায় তাজউইদের উপর এ অনন্য বইটি সবার পড়া উচিৎ বলে মনে করে থাকি।
■ ব্যক্তিগত অনুভূতি ও মতামত :
বইটি প্রকাশিত হওয়ার দু থেকে তিনদিনের মাথায়ই নিয়েছিলাম। হাতে পাওয়ার পরই এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছে। বিশেষ করে যখন দেখি পেইজ ফোর কালারের (রঙ্গিন ছবিসহ)। এছাড়াও যে যে বিষয়গুলো ভালো লেগেছে-
• বইটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এবং ছবিগুলো রঙ্গিন করার ফলে বিষয়গুলো বুঝতে সুবিধা হচ্ছে। যে কারণে অন্যান্য সাধারণ বইয়ের থেকে মাখরাজগুলো ও অন্যান্য হুকুম আহকামগুলো বুঝতে খুবই সহজ মনে হয়েছে।
• প্রতিটি তথ্যের নিচে রেফারেন্স এবং তথ্যসূত্র উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে পাঠক নিজেই আরবি জানা থাকলে তথ্য এবং রেফারেন্সগুলো চেক করে বইটির তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করতে পারবেন।
• ইতিহাসের অংশগুলো খুবই সহজ সাবলীল করে বর্ণনা করা হয়েছে। পড়ার সময় মনে হচ্ছে ইতিহাসের কাঠখোট্টা কোনো বিষয় পড়ছি না,গল্পের মতো মনে হয়েছে ইতিহাসের অংশটুকু।
▪︎ সর্বোপরি এক কথায় বলতে গেলে, বাংলা ভাষায় তাজউইদের উপরে ‘এক ভিতরে সব’ ধরণের প্যাকেজ একটি। কুরআন পরিপূর্ণভাবে সহীহ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে হলে এবং শিখতে হলে একজন বাঙ্গালি মুসলিমের জন্য বইটি সংগ্রহে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করে থাকি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই বইটিকে কবুল করেনিন। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন ।
মাআসসালাম_____!!