আরিফ আজাদের নতুন বই ‘জীবন যেখানে যেমন’। এবারের বইটি এমন কিছু জীবন ঘনিষ্ঠ গল্প শোনাবে, যা আপনার আমার সবার জীবনের গল্প। কিন্তু অবচেতন মনে সেগুলো আমরা এড়িয়ে চলি। গল্পগুলো আমাদের ভাবাবে। জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাবে। উদ্বুদ্ধ করবে জীবন নিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলো নতুন করে গড়তে। জাগতিক ব্যস্ততার জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া হৃদয়ে ঘটাবে নতুন জীবনের সঞ্চার। এমন কিছু গল্পও এবার থাকবে, যেগুলো আমরা চাই না কারও জীবনে আসুক। তবে প্রতিটি গল্পই আমাদের বাধ্য করবে থমকে দাঁড়াতে, কতোবার যে চোখযুগল ঝাপসা হয়ে আসবে ইয়াত্তা নেই। জীবন যেখানে যেমন।
Copyright © 2024 Seanpublication.com
সাওদা সিদ্দিকা নূর –
ঘোর আমাবস্যা কিংবা ভরা জোৎস্না রাত, উভয় সময়ে দাদির আচঁলের নিচে শুয়ে বাঘ-বাঘিনী আর শেয়াল-ডাকিনীর গল্প কম শুনিনি। টানটান উত্তেজনা, হাসি আর শরীর হিম হওয়া এইসব গল্পগুলো আমাদের অবসরকে যেমন ব্যস্ত করে তুলত, ঠিক তেমন আমাদের বিনোদন দিত। কিন্তু এসব গল্প আমাদের জীবনের আসল পাঠ শেখাত না।
কিন্তু সময়ের পরিক্রমনে এখন আমাদের জীবনব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। উন্নত হয়েছে আমাদের চিন্তাধারা, আমাদের সাহিত্য, আমাদের গল্প। এখন গল্প বলতে আমরা সেই বাঘ-বাঘিনী কিংবা শেয়াল ডাকিনীর শরীর হিম হওয়া গল্প বুঝি না। এখন গল্প বলতে বুঝি জীবনবোধের গল্পকে। জীবনের ফাঁক ফোঁকর থেকে টুকে আনা এই গল্পগুলো আমাদের অবসরকে যেমন ব্যস্ত করে তোলে, ঠিক তেমন আমাদের বিনোদনের পাশাপাশি জীবনবোধ শেখায়। তেমনি জীবনবোধের এক বাক্স গল্প নিয়ে বসেছেন লেখক আরিফ আজাদ। নাম দিয়েছেন ‘জীবন যেখানে যেমন’।
.
.
◾এক নজরে বই বৃত্তান্ত:
▪️বইয়ের নাম: জীবন যেখানে যেমন
▪️লেখক: আরিফ আজাদ
▪️প্রকাশনায়: সমকালীন প্রকাশন
▪️পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৪৬
▪️মুদ্রিত মূল্য: ২৩৭ টাকা
.
.
◾আসুন একটু লেখক সম্পর্কে জেনে নেই:
আড়ালে থেকে আলো ছড়ানো খুব অসম্ভব একটি কাজ। কিন্তু আরিফ আজাদ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। খ্যাতি, মোহ আর বড়ত্বের মায়াজাল থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে বিশ্বাসী অবিশ্বাসীদের মাঝে আলো ছড়াচ্ছেন এই আলোর ফেরিওয়ালা।
অবিশ্বাসীদের দেয়াল চূর্ণ বিচূর্ণ করে তিনি এসেছিলেন প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদকে নিয়ে। তারপরের ইতিহাস স্বপ্নের মত। প্রকাশনীর ভাষায়, ‘যেন তিনি রূপকথার সেই বীর যিনি ‘এলেন, দেখলেন আর জয় করে নিলেন।’ তবে লেখক আরিফ আজাদকে পাঠক ‘জীবন যেখানে যেমন’ বইয়ে অন্যরূপে পাবেন।
.
.
◾সূচির কথা:
১৪টি জীবনের গল্পের পসরা বসেছে এই বইয়ে। যা আমাদের বাস্তব জীবনের আসল পাঠ ও বিশ্বাসীদের ইসলামি মূল্যবোধ শেখাবে। যদি ১৫টি গল্প হতো, তবে সাংখ্যিক দিক থেকে একটা দারুণ মিল হতো।
গল্পের নামগুলো দেখলেই গল্পের ভেতরের কী লুকিয়ে আছে, সেটা জানার তীব্র অধীরতা সৃষ্টি হয়।
জীবনবোধের এই ১৪টি গল্প পাঠকের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলবে নিশ্চিত।
.
.
◾পছন্দের কয়েকটি গল্প পর্যালোচনা:
প্রাথমিক আলোচনা তো অনেক হলো। এবার একটু গল্পের বাক্সটা খোলা যাক।
লেখক আরিফ আজাদ গল্পের এই বাক্সে সমাজ থেকে এমন সব চরিত্র বন্দি করেছেন যেগুলো সব সময় আমাদের চোখের সামনে ঘোরা ফেরা করে। কিন্তু আমরা তাদের অনুভব করতে পারি না। কুসংস্কার, অন্ধকার, অন্যায়, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, বোধোদয়, ভালোবাসায় মোড়ানো জীবনের এই গল্পগুলো অন্তত একবার হলেও মানুষকে জীবনের সারমর্ম সম্পর্কে ভাবাতে শেখাবে। আর প্রতিটা গল্প পর্যালোচনা করেও পাঠকদের বিরক্ত করব না। শুধু এটুকু মনে রাখতে হবে, জীবনের গল্প বলে প্রতিটা গল্প। এ যেন আমার আশেপাশের কিংবা আমারই গল্প।
বইয়ের প্রথম গল্প ‘অশ্রু ঝরার দিনে’ পড়ার সময় মনে হয়েছিল কোনো সন্তান হারা বাবা-মায়ের ভগ্ন হৃদয়ের রূপ তুলে ধরবে। কিন্তু আমাকে অবিশ্বাস্য রকমের অবাক করে দিয়ে গল্পটি মোড় নিল অন্য দিকে। ফুটে উঠলো সমাজের এক করুণ কুসংস্কারের পরিনতি। কিন্তু কী ছিল সেই কুসংস্কার? সেটা আমি অবশ্য বলব না। নিজেরাই পড়বেন আশা করি।
কুসংস্কারের বিষণ্ণতার পরপরই লেখক এনেছেন ভালবাসার চাদরে মোড়া এক দম্পত্তির গল্প। যা পাঠক হৃদয়কে এত গভীর থেকে ছুঁয়ে যাবে যে, প্রতিটা মেয়ে গল্পের স্ত্রী রেবেকার মত হতে চাইবে আর প্রতিটা ছেলে ঐ স্ত্রীর ভাগ্যবান স্বামী হতে চাইবে। গল্পটা পড়ে ভেতরে যে কেমন অনুভূতির অনুরণ হয়েছিল, সেটা একটা মেয়ে কখনো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। ভালোবাসায় বাঁধা এই গল্পের নামটা ছিল যথার্থ। ‘এই প্রেম, এই ভালোবাসা’।
বিষণ্ণতা ও ভালোবাসার পরপরই লেখক এনেছেন এক বিশ্বাসী মানুষের গল্প। অভাব অনটনের ভেতরও আল্লাহর প্রতি তার ভারসার মাপকাঠি যেন গগনচুম্বী। ‘যে রিজিক আসমান থেইকা আসে, তার লাগি এত পেরেশানি কিয়ের?’ গল্পের এই একটা লাইন পাঠকের হৃদয়ে ইমানের সিলমোহর পিটিয়ে দেয়। আল্লাহর প্রতি জমিরুদ্দিন চাচার ভরসার মাপকাঠি থেকে গল্পের নাম হয়েছে ‘আসমানের আয়োজন’।
বিষণ্ণতা, ভালোবাসা, বিশ্বাস, ত্যাগ, চাওয়া না-চাওয়া, রকমফের, সন্তানের কান্না, ধোঁকার পরে আবারো আসে সুখের গল্প। অনৈতিকতার বাজারে নিজের সততাকে আকড়ে ধরা এক যুবকের সুখের গল্প পড়তে পড়তে ভেতরে ভালো লাগার এক স্নিগ্ধ অনুভূতি তৈরী হয়। গল্পের শেষ দিকের একটি লাইন পড়ে তো একা একা হেসেছি অনেক সময়।
এরপর মহীয়সীর গল্পের কথা না বললেই নয়। এই গল্পের বিস্তারিত পর্যালোচনা করার জন্য আলাদা ভাবে একটা রিভিউ লিখতে হবে। কারণ এই গল্পে কোনো সাধারণ দু’টো বিষয় তুলে ধরা হয়নি। একজন নারীবাদীর জীবন টেনে এখানে একজন মায়ের গল্প বলা হয়েছে। আর এই নারীবাদ বর্তমান সমাজের বিস্তর আলোচিত একটা বিষয়। একে কখনো এক দুই কথায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলব বর্তমান প্রেক্ষাপটে গল্পটা খুবই উপযোগী। গল্পের ভেতরের টুইস্ট দারুণ ছিল।
মোটকথা পুরো বইটিকে একটা রত্নখনি বলা চলে। একটা প্রবাদ আছে, ‘ঝিনুকের ভেতর মুক্তো লুকানো’। এই বইটিও ঠিক তেমন। এক বসায় পড়ে ফেলার মত একটা বই।
আসলে বইয়ের প্রতিটি গল্পের বিস্তর পর্যালোচনা একটা বই রিভিউয়ের ভেতর লেখা সম্ভব নয়। তারপরও বেশ বলে ফেলেছি। আশা করি বইটির স্বার্ণালি অক্ষরের ঝলমলে আলো একটু হলেও পাঠক হৃদয়কে আলোকিত করবে।
.
.
◾পাঠ প্রতিক্রিয়া:
যে আরিফ আজাদকে একদিন যুক্তির এফোঁড়-ওফোঁড় করতে দেখেছি, সেই আরিফ আজাদ হঠাৎ আবির্ভূত হলেন নতুন রূপে। পাঠকদের উপহার দিলেন হৃদয় পরিবর্তনীয় বই ‘বেলা ফুরাবার আগে’।
তিনি শুধু সাজিদের বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তির ফোঁড়, আরজ আলীর যুক্তির খন্ডন, হৃদয় পরিবর্তনিয় বই ‘বেলা ফুরাবার আগে’ লিখে থেমে থেকেনি। এবার আবারো আসলেন নতুন রূপে।
বইটি প্রকাশের পূর্বে ভেবেছিলাম এটা কোনো তাত্ত্বিক বই হবে। হৃদয় গলিত শব্দমালা দিয়ে আবারো উপহার দিবেন ‘বেলা ফুরাবার আগে’ বইয়ের মতো আরো একটি মাস্টারপিস বই। কিন্তু আমাকে আবারো অবিশ্বাস্য রকমের আশ্চর্য করে নিয়ে এলেন হৃদয় গলিত শব্দমালা দিয়ে সাজানো দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘জীবন যেখানে যেমন’। এর আগের সাজিদ সিরিজ গল্পগ্রন্থ হলেও ‘জীবন যেখানে যেমন’ বইয়ের সাথে আকাশ-পাতাল ফারাক। তবে তাতে আমি একটুও দমে যাইনি। চিনতে পেরেছি একজন জাত সাহিত্যিককে। একজন জাত সাহিত্যিক কোনো দিন তার লেখার গণ্ডি গল্প, উপন্যাস বা যুক্তির ফাঁদে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তার বিচরণ থাকে সাহিত্যের প্রতিটি পাড়ায়, প্রতিটি অঙ্গনে। আর আরিফ আজাদের ‘জীবন যেখানে যেমন’ বইটি তার জাত সাহিত্যিকের প্রমান দেয়।
তবে বইটি প্রকাশের পরই একটা মহলে বেশ সমালোচনা হয়েছে। কেউ কেউ এই বইয়ের সাহিত্যমান নিয়ে আঙ্গুল তুলেছেন। আবার কেউ বলেছেন, জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে গল্পের বই বিক্রি করে।
তবে যে যা বলুক ভাই, আমার এমন বই আরো চাই।
যারা বইটিকে সাহিত্যের মানদন্ডে বিচার করেছে তাদের বেশির ভাগেই বইটির সূচিপত্র পড়েছে কিনা সন্দেহ। না হলে এমন অন্ধকারে ঢিল ছুড়তে পারত না। তাদের আমি বলব, শত শত পৃষ্ঠায় প্রেম আর আবেগ ঢেলে দিয়ে উপন্যাস লিখলেই কেউ বিরাট সাহিত্যিক হয়ে যায় না। আবার যারা এই বইকে স্রেফ একটা গল্পের বই ভাববে, তাদেরকে আমি বাগধারা অনুযায়ী বলব ‘গোবর গনেশ’। না হলে গল্পের সঙ্গায় এই বইকে বিচার করতে পারত না।
বইটিতে অনেকগুলো চরিত্র রয়েছে। কেউ পিতা, কেউ সন্তান, কেউ স্ত্রী, বন্ধু অথবা মা। জীবনের বিভিন্ন স্থান থেকে নেয়া এই চরিত্রগুলোকে জড়িয়ে যেহেতু বইটি লেখা হয়েছে, সেহেতু বইয়ের নামটি যথার্থ ছিল।
বইয়ের প্রতিটি গল্প ছিল ইউনিক ও সময়োপযোগী। প্রতিটা গল্পের থিম, টুইস্ট, সাহিত্য সবকিছু মিলেমিশে সত্যই জমে ক্ষির হয়েছিল।
.
.
◾প্রিয় উক্তি:
প্রতিটা গল্পেই হৃদয় ছোঁয়া কিছু না কিছু উক্তি ছিল। তবে সবথেকে প্রিয় দু’টো উক্তির একটি ইতিমধ্যে আমি বই পর্যালোচনার ভেতর লিখেই দিয়েছি। তা হলো-
‘যে রিজিক আসমান থেইকা আসে, তার লাগি এত পেরেশানি কিয়ের?’ – আসমানের আয়োজন
তাছাড়া আরো রয়েছে,
‘একটা ফুলের গায়ে চড়েছে অন্য একটা ফুল। কোন ফুলটাকে যে বেশি সুন্দর লাগছে সেটা নির্ণয় করা কঠিন। বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি।’- সুখ
এভাবে বেছে বেছে প্রিয় উক্তিগুলো উল্লেখ করা অনেক সময়ের ব্যাপার। ইতিমধ্যে আমি রিভিউ পাঠকদের অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। তাই আর কোনো উক্তি উল্লেখ করছি না। বইটা পড়ে আশা করি সুন্দর উক্তিগুলো আপনাদের হৃদয়েও স্নিগ্ধ অনুভূতির অনুরণ সুষ্টি হবে।
.
.
◾একটি মজার কথা বলি:
বইটির ভালো নারী চরিত্রগুলোতে লেখক রেবেকা নামটা ব্যবহার করেছেন। জানি না লেখকের মনে কী রয়েছে। তবে আমার মনে হলো যুবকদের জন্য লেখক যেমন সাজিদকে সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমন মেয়েদের জন্য রেবেকাকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে সাজিদের মতো মেয়েরাও রেবেকা হতে চায়। আসলে যে কয়বার বইটার কথা মনে পড়ে, সে কয়বার এই চিন্তাটা মাথায় হুটোপুটি খায়। লেখক যে কেন সব জায়গায় এই রেবেকাকে আনতে গেলেন, যদি জানতে পারতাম, তবে আমার অস্থির মস্তিষ্ক একটু হলেও স্বান্তনা পেত।
.
.
◾বিশেষ মন্তব্য:
সার্বিক দিক বিবেচনায় বইটির কভার, কভারের কালার কম্বিনেশন, বাইন্ডিং, পৃষ্ঠার কোয়ালিটি, ফন্ট, সম্পাদনা সবকিছু সুন্দর ছিল।
আর মন্দলাগা বলতে যা আছে, তা কেবল একটি সমুদ্র থেকে তুলে আনা এক বিন্দু পানির মত। আসলে বইটির সমালোচনা করার যোগ্যতা আমার আদৌ আছে কিনা জানি না। তারপরও লেখকের শুভাকাঙ্ক্ষী হিশেবে কয়েকটা কথা বলা খুব জরুরি মনে করছি। পাঠককে আকৃষ্ট করার জন্য বইয়ের দু’একটি গল্পের সাহিত্যমান বোধহয় একটু কম হয়ে গিয়েছে। জানি না আমার এমন কেন মনে হলো, নাকি পাঠক হিশেবে নিতান্তই বাজে, সেটা বুঝতে পারছি না। তাছাড়া সাহিত্যমান ও পাঠকদের ধরে রাখার ক্ষমতা থাকলেও দু’একটি গল্প ছিল বেশ সাদামাটা ও গতানুগতিক ধাঁচের।
তাছাড়া বরাবরই লেখকের নিকট থেকে আশার পরিমাণ একটু বেশিই থাকে। সেই আশার তুলনায় গল্পের সংখ্যা কম হয়ে গিয়েছে। যদি আরো কয়েকটি গল্প থাকত, তবে তৃপ্তির রেখা বোধহয় পূর্ণ হতো। এরপর আবার বেশির ভাগ গল্পই লেখকের টাইমলাইনে ও ‘গল্পগুলো অন্যরকম’ বইয়ে আগেই পড়ে ফেলেছি।
সমালোচনা বা আমার মন্দলাগা বলতে এতটুকুই।
.
.
◾যাবার পূর্বের কথা:
অসুস্থ আর অশ্লীল সাহিত্যের বাজারে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন। স্রোতের এই প্রতিকূলে চলে সময় উপযোগী সুস্থ ও রুচিশীল সাহিত্য চর্চার দিকে যে সমকালীন প্রকাশন মনোযোগ দিয়েছে, যা সত্যিই আশাজাগানিয়া। আশা করব প্রকাশনী ও লেখক উভয়ের নিকট থেকে পাঠক সমাজ ভালো কিছু পাবে। এরপরের বইয়ে আমার মতো অন্য পাঠকসমাজও এক নতুন আরিফ আজাদকে আবিষ্কার করতে চাইবে এই প্রত্যাশা রাখি।
ফাতিমা মৌ ফ্লাভিকা –
হাজারো গল্প আছে আমাদের ক্ষনস্থায়ী এই জীবনের,কিভাবে দুঃখ কষ্টের দিনগুলোকে ধৈর্যের সাথে অতিক্রম করতে হয়।কিভাবে এই ধৈর্য্যকে ধারণ করেই স্রষ্টার উপর ভরসা করতে হয় লেখক তার প্রথম গল্পে ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।গল্পের দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন এর মাধ্যমে খুব সুন্দর ভাবে একে অপরকে দৈনন্দিন জীবনের কত অবহেলিত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ গুলো সম্পর্কে মনে করিয়ে দেয়ার দ্বারা পাঠককে এই সুন্নাহ গুলো সম্পর্কে জানাচ্ছে এবং পালন করতে উৎসাহিত করছে।
তাছাড়াও রিজিক বিষয়ে একজন ছেলে ও প্রতিবেশি টুপি বিক্রেতা জমিরউদ্দিন চাচার গল্প দিয়ে পাঠককে নতুন করে ভাবনার খোরাক দিবে।আকাশে যখন কালো মেয়ে চেয়ে যায়,দূর্যোগের যখন ঘন্টা বাজে তখনও পাহাড়সম কিভাবে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে, দুনিয়ার সফলার প্রাপ্তির চাইতে আখেরাতের প্রাপ্তি কে বড় করে দেখার উদাত্ত আহবান করেছেন লেখক ‘সফলাতা সমাচার’ গল্প দিয়ে।
‘বিশ্বাস’ শিরোনামের একটি গল্পে লেখক গ্রামের সহজ সরল মানুষের চেতনা কিংবা দূর্বলতা নিয়ে পীরবূজর্গীরুপ ধারণ করে আত্মসাধ করার বিষটিও তুলে ধরেছেন নিপুনভাবে।
আবার লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে সত্যকে আলিঙ্গন আর মুখোশের আড়ালে থাকা মিথ্যাকে পায়ে ঠেলতে
হবে।
১৪ টি অসাধারণ শিক্ষামূলক,জীবনকথনমূলক গল্প নিয়ে সাজানো সুন্দর এই বইটি।
❀ ভালো লাগার কয়েকটি দিক ❀
শহুরে জীবন,গ্রামীন জীবন,এমনকি নিম্ন শ্রেনীর মানুষের কথাও বইটিতে অসাধারণ ভালো তুলে ধরা হয়েছে। সত্যিকারের প্রেম-ভালোবাসার গল্প, বাবাদের গল্প, সমাজ সচেতনতার গল্প, সামাজিক কুসংস্কার সহ সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা গল্পগুলো অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী! গল্পগুলো কাঁদাবে, ভাবাবে আর জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শেখাবে।লেখকের অন্যান্য বইয়ের চেয়ে এই বইয়ের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন হওয়ার খুব বেশিই ভালো লেগেছে।
❀ বইমুগ্ধতা;জীবনকথনঃ ❀
বইটিতে এমন কিছু লাইন আছে যা পড়লে আপনার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু গড়াবে,তার মধ্য থেকে কয়েকটি কথা শেয়ার করছি-
▪“সব লাভ কি চোখে দেহন যা গো মিয়া ভাই!”
▪“একজন সন্তানহারা নিস্ব মা এর প্রতি সকলের তীব্র অপমান ও অবহেলার পর তার রেখে যাওয়া হৃদয় শীতলকারী সেই চিরকুট!”
▪“জলন্ত চুলোর পাশে দাড়িয়ে থাকা রেবেকার মন থেকে চাওয়া স্বামীর জন্য ছোট্ট একটি দোয়া কতো সহজেই কবুল করে দিলেন রব্ব!”
▪“যে রিজিক আসমান থেইকা আসে,তার লাগি এতো পেরেশানি কিসের?জমিরুদ্দিন সরদারের এই ঈমান ও তাওয়াক্কুলের জন্য আল্লাহ কিভাবে কিভাবে তাকে কবুল করে নিলেন!”
▪“মা দেখো,আমি আমার বাবার মতোন হইনি!”
▪“ফাতিমার মতোন এতো বড় আত্নত্যাগ করার মতোন বড় হৃদয় আছে কিনা আমার, নিজেকে প্রশ্ন করতেও ভয় করেছিলো!”
▪“আহারে মানুষ!কচুপাতার ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুর মতোই ঠুনকো মানুষের জীবন।হালকা বাতাসে পাতা দুল্লেই গড়িয়ে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়!”
জীবনকথন অসাধারণ এই লাইনগুলো বইয়ের অলংকার!মুগ্ধ করে,কাঁদায়, ভাবায়!
❀ পাঠ্যনূভুতি ❀
অন্তরে দ্বীনের বুঝ আসার পরে যেই লেখকের বই পড়ে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি আর হৃদয়ে স্বস্তি পেয়েছি তিনি হলেন আরিফ আজাদ।উনার বই মানেই মুগ্ধতা,আলহামদুলিল্লাহ।সবগুলো বই পড়েই অজস্র কেঁদেছি।এই বইটাও।জীবন সায়াহ্নে যখন হতাশা নেমে আসে তখন যেসব রিমাইন্ডার অত্যন্ত দরকার সেইসব রিমাইন্ডার খুঁজে পাই উনার বইগুলো পড়েই।জীবনের একটা পরম বাস্তবতা হলো জীবন ভিন্ন ভিন্ন রুপে ভেসে উঠে। রাস্তা কিংবা রেল লাইনের মতো সমান্তরাল হয় না। আর জীবন কখন কিভাবে কেমন করে কাটাবো তা নিয়ে অত্যন্ত চমৎকার লিখেছেন এই বইটিতে।স্থান, কাল,পাত্রভেদে জীবন যেমন হয় তার ঠিক তেমন রূপ নিয়েই বইটি রচিত হয়েছে। জীবনের সবক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধানে আঁকড়ে ধরা মানুষগুলোর জীবনকথন নিয়া রচিত এই বইটি সত্যিই প্রশান্তির।
আল্লাহ আরিফ আজাদ ভাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।উম্মাহর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে কবুল করে নিন,আমীন।
বই: জীবন যেখানে যেমন
লেখক: আরিফ আজাদ
প্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশন
মূল্য :২৩৭ টাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা :১৪৬
Meher Afroz –
📙বুক রিভিউ📗
বইঃ জীবন যেখানে যেমন
লেখকঃ আরিফ আজাদ
সমাজের সব মানুষের জীবন গতি এক নদীর অববাহিকায় বয়ে চলে না। কাউকে অতিক্রম করতে হয় শত- সহস্র প্রতিকূলতা। আবার কেউ গড্ডালিকায় গাঁ ভাসিয়েও প্রশান্তির দেখা পায় না। ‘জীবন যেখানে যেমন’– যেন নামের মাঝেই ফুটে উঠেছে বইটির বিষয়বস্তুর ছোঁয়া।ঠিক তাই! গল্পের বই বলা হলেও, বইটি নিছক কোনো গল্পের বই নয়। লেখক কাল্পনিক চরিত্রের অন্তরালে এ সমাজে আমাদের মত সাধারণ জনগণের বিভিন্ন চরিত্রকে বর্ণনা করেছেন। গল্পের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন–
ফেলে আসা চঞ্চল শৈশবে, মায়ের ভালোবাসা কিংবা প্রিয়তমার স্নেহের পরশ পেতে। উপলব্ধিকে উস্কে দিয়ে বাধ্য করেছেন স্বামী- সন্তান হারানো মায়ের চোখের জ্বলকে অনুভব করতে।প্রলুব্ধ করেছেন, পকেট ফাঁকা অথচ ইচ্ছাশক্তির জোরে মানুষ কী করতে পারে সেই দৃষ্টান্ত স্বরূপ টুপি বিক্রেতার পাকা মসজিদ বানানোর ইতিবৃত্ত জানতে। তাছাড়া ভন্ড মাজার ব্যবসায়ীর সয়তানি বুদ্ধিতে কাবু হওয়া গ্রামবাসীর অদেখা কান্না তো আছেই।
বই থেকে কিছু অংশঃ—
১.‘ফ্যানের নিচে বসে হাওয়া গিলতে থাকা আমার অস্বস্তি কাটাতে বৃষ্টির জন্য দুআ করেছে জ্বলন্ত চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমনী! কী অবিশ্বাস্য ভালবাসা! কী অনুপম মায়ার বন্ধন!’
২.‘চাচা একদিন নয়ন ব্যাপারির চোখে চোখ রেখে, পরম ভরসার পারদ বুকে নিয়ে বলেছিলেন,
“ আল্লাহ কুরআনে কী কইছে হুনো নাই, মিয়া ভাই? আল্লাহ কইছেন, যারাই আল্লাহর ওপর ভরসা করবো, তাগো লাইগা আল্লাহ এমন জায়গা থেইকা রিজিক পাঠাইব যা মানুষ চিন্তাও করতে পারবো না।’
৩.‘সেই মা, যে কাকভেজা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে, আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলেছিলো, ‘তোর বাপের মতো হোস নে, বাবা।’
৪.“আহা মৃত্যু! আহারে মানুষ! কচু পাতার উপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুর মতোই ঠুনকো মানুষের জীবন।হালকা বাতাসে পাতা দুললেই গড়িশে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।”
৫.মাঝে মাঝে মনে হয়– মেয়েরা বোধকরি অন্য ধাতুতে গড়া।একেবারে অপরিচিত একটা মানুষ, একটা পরিবার একটা পরিবেশকে তারা কতো নিবিড়ভাবে আপন করে নেয়! কতো সুন্দর করে তাতে একেঁ দেয় ভালোবাসার আল্পনা!
পৃষ্ঠা নং— ২৬
৬.‘নাজিমুদ্দিনের ছেলে মতির ঈমান কতোটুকু গেছে জানা যায়নি, তবে রাসুর মা জীবনের শেষ সম্বলটুকু যে খুইয়েছে, তা নিশ্চিত।’
পৃষ্ঠা নং—৭৩
পাঠ্যানুভূতিঃ—
বইটার প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেন ভাঁজ করা হয়েছে এক একটি প্রানবন্ত জীবনের চেপে রাখা সার ‘গল্প’। প্রকাশ পেয়েছে অপার্থিব ভালোবাসা আর সত্যের শিক্ষা। ৪৪পৃষ্ঠার গল্পে ফাতেমা যখন তাঁর স্বামীকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বিতীয় বিবাহ করায়, তখন তাঁর উদারতা দেখে কখন যে চোখের পাতা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিলো খেয়ালই করিনি। অথচ, কারো স্ত্রী-ই হইনি যে অন্যকারো সাথে জীবন সঙ্গীকে বন্টন করে নেওয়ার অনুভূতি উপলুব্ধি করতে পারবো।
তাছাড়া, রিযিক নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা কাজ করত, কিন্তু জমিরুদ্দিন চাচার কাছে শিখে গেলাম, ‘এই পেরেশানি যে অহেতুক’।
বইটা নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেকটা সময় ধরে করা যাবে। তাই সংক্ষিপ্ত বাক্যে— ‘ আমার পড়া ইসলামের সাহিত্য বইগুলোর ভেতর প্রিয় একটি বই ‘জীবন যেখানে যেমন’।
মন্তব্যঃ–
প্রচ্ছদটি চমৎকার ছিলো। সম্মাদনা, পৃষ্ঠার কোয়ালিটি, ছাপা, বান্ডিং সবই মানসম্মত।
রিভিউ দাতাঃ Meher Afroz
Shahriar Mohammad Aqib –
গল্প পড়তে অনেকেই ভালোবাসেন। ছোটবেলা থেকেই আমরা গল্প শুনে অভ্যস্ত।”জীবন যেখানে যেমন” বইতে লেখক আরিফ আজাদ গল্পে গল্পে মানুষের মাঝে ইসলামি সচেতনতাবোধ জাগ্রত করতে চেয়েছেন।গল্পের স্বাদ আস্বাদনের পাশাপাশি কুরআন হাদীসের অসাধারণ অনন্য শিক্ষা লাভ করা যায় এই বইটি পড়ে।