ইতিহাস বিজয়ী আর বিজয়কেই ফলাও করে; পরাজয় আর পরাজিতকে ঢেকে রাখে বিস্মৃতির আড়ালে; কিন্তু কোনো কোনো পরাজয় ও পরাজিত পক্ষ এতই মহিয়ান হয়, তা গৌরবের দিক দিয়ে অনেক বিজয়কে ছাড়িয়ে যায়—দূর বহু দূর। ইতিহাসের তেমনই পরাজিত এক মহানায়ক সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ।
জালালুদ্দিন ছিলেন খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান। তিনিই তাতারদের প্রথম প্রতিরোধকারী। গ্রন্থটি তাঁকে নিয়েই রচিত। তবে খাওয়ারিজম সাম্রাজের ইতিহাসও সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে গ্রন্থটিতে।
তাতারঝড়ে যখন গোটা মুসলিম বিশ্ব লন্ডভন্ড, ঠিক সে মুহূর্তে ধুমকেতুর ন্যায় আবির্ভূত হয়েছিলেন মুসলিমবিশ্বের ত্রাতা হিসেবে। তাতারদের মোকাবিলায় তাঁর প্রতিরোধযুদ্ধ অসফল হলেও ব্যর্থ ছিল না মোটেও। অন্তত সাত-আটটি বছর তিনি আটকে রেখেছিলেন তাদের বিজয়ের স্রোত। দৌড়ের উপর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই বিশ্বত্রাস শক্তিকে। অনেক ক্ষেত্রে নাকানি-চুবানিও খাইয়েছিলেন পিশাচ তাতারদের। এই রক্তপিপাসুদের নিজের সঙ্গে ব্যস্ত রেখে দিয়ে গেছেন বাগদাদের খিলাফত, হারামাইন, মুসলিমবিশ্বসহ মানবসভ্যতার সুরক্ষা। সিন্ধু নদের তীরে বীরত্বের যে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন এই অমর বীর, তা চিরকাল মুসলিম মুজাহিদদের জন্য হয়ে থাকবে প্রেরণার উৎস। ইতিহাসের মাজলুম সেই মহান সুলতানের জীবনালেখ্যই ফুটে উঠেছে এই গ্রন্থে।
গ্রন্থটি রচনা করেছেন পাকিস্তানের খ্যাতনামা আলিম, ইতিহাসবিদ ইসমাইল রেহান। দীর্ঘদিন তিনি জামিয়াতুর রশিদ করাচিতে অধ্যাপনা করেছেন। লিখেছেন ইতিহাস বিষয়ে জনপ্রিয় অনেক গ্রন্থ। তাঁর রচিত আফগানিস্তানের ইতিহাস গ্রন্থটিসহ আরও কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করবে কালান্তর প্রকাশনী।
গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন ইমরান রাইহান। পড়াশোনা কওমি মাদরাসায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে লেখালেখিকেই ব্যস্ততা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আগ্রহ ইতিহাস বিষয়ে। তার রচিত ও অনূদিত আরও কিছু গ্রন্থ কালান্তর থেকে প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।
Ruponti Shahrin –
‘সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ’। শেষ থেকে শুরু। শুরু থেকে শেষ। মুগ্ধতার আরেক নাম।
**সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহঃ বুদ্ধিদীপ্ত টগবগে তরুণের টানটান উত্তেজনার রক্তেরঞ্জিত কাহিনী। **
হিজরি সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে খাওয়ারিজমই ছিল মুসলিমবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী জনপদ। যারা যেকোনো ধরনের শত্রুর মোকাবিলায় সক্ষম ছিল। খাওয়ারিজম ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ছিল অতুলনীয়। সাইর নদী ও আমু দরিয়া থেকে অসংখ্য ছোট নদী প্রবাহিত হচ্ছিল। এসব নদীতে চলত সওদাগরের নৌকা। চাষাবাদ ও পানির ব্যবস্থা ছিল। সকল প্রকারের ফলমূলসহ পাহাড়ি অঞ্চলের জন্মাত নামীদামী ফল। কিশমিশ, আখরোট ও বাদাম ছিল বিখ্যাত। লোকে পেয়ালা ভরে পান করত ডালিমের রস। দারগান শহরের চারপাশে ছিল কয়েক মাইল জুড়ে আঙ্গুগের বাগান। দামগানের আপেল ছিল সুস্বাদু। শাস শহর ছিল কারপাস তুলার জন্য বিখ্যাত।
আরগেঞ্চ, সমরকন্দ ও বুখারা ছিল বাণিজ্যিক শহর হিসেবে বিখ্যাত। বলখ, মার্ভ আর নিশাপুর ছিল বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। প্রায় প্রতিদিন আসত বাণিজ্যকাফেলা। তাদের সঙ্গে থাকত হালাবের শিসা, রোমের রেশমি কাপড়, ইয়ামেনের চাদর, চীনা বাসনপত্র, ভারতবর্ষের মসলা। খাওয়ারিজমের কোনো কোনো শহর ছিল চামড়ার জন্য বিখ্যাত। সে কালে কাসানের মখমল ছিল বিখ্যাত। ফারগানার মিহি কাপড় মন কাড়ত আমিরদের। এখানকার তলোয়ার ছিল যোদ্ধাদের অতিপ্রিয়। তিরমিজে ছিল সাবান বানানোর কারখানা। তুর্কিস্থানের খারাপ খঞ্জর আর তেজী ঘোড়া উভয়ই নিজেদের দ্রুততার জন্য বিখ্যাত ছিল।
মাওয়ারাউন নাহারের অনেক এলাকাতেই ছিল সোনা, রুপা ও লোহার খনি। সাম্রাজ্যের সর্বত্রই নির্মিত হচ্ছিল দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। বুখারার শাহী মসজিদ ছিল সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। অমুসলিম পর্যটকেরা এই মসজিদ দেখে থমকে দাড়াত। তারা ভাবত এটি রাজপ্রাসাদ। শহরের সড়কগুলো ছিল প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন। দুপাশে থাকত সারিবদ্ধ গাছ। ঘরবাড়ি বানানো হত ইট, পাথর ও কাঠ দিয়ে। অনেক সময় শুধু কাঠের বাড়িই হত। প্রতিটি মসজিদে ছিল মক্তবের ব্যবস্থা। এর বাইরেও ছিল অসংখ্য মাদরাসা। সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে এসব মাদরাসার জন্য ওয়াকফ বরাদ্দ হত। শিক্ষকদের ভাতা নির্ধারিত হত। ছাত্রদের পড়া ও আবাসিক ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক। আরগেঞ্চের জামে মসজিদে পড়াতেন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী আলিম ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রাহ)। আত তাফসিরুল কাবির গ্রন্থের লেখক তিনি।
নির্মল বাতাস, সবুজ মাঠ, ঘন জঙ্গল, ফলের বাগান কিংবা শীতে মৃদু তুষারপাত, এসব ছিল পরিচিত দৃশ্য। ইবনু খালদুন তাই লিখেছেন, “আল্লাহর জমীনে এরচেয়ে নির্মল, সুন্দর শহর আর নেই।”
তারপর কী এমন হলো যে, পালটে গেল দৃশ্যপট?
এই সুন্দর ভূমির উপর নজর পড়েছিল হিংস্র, পাষন্ড চেঙ্গিস খানের। শত্রুকে খাটো করে দেখতে নেই। আর সেটাই করেছিল সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ। চেঙ্গিস খানের পাঠানো দুতকে তিনি বন্ধুরুপে নিজের গুপ্তচর বানিয়ে প্রথম ভুল করেছিলেন। আব্বাসিয় খিলাফাতের সাথে দ্বন্দ্ব ছিল তুষচাপা আগুনে বাতাস দেয়ার মত কাজ। সুলতানের বড় দুর্বলতা ছিল নিজস্ব শক্তিশালী গোয়ান্দাবাহিনী গঠন না করেই সীমানাপ্রাচীর নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। এদিকে নাসিরের ষড়যন্ত্র, আরেকদিকে চেঙ্গিস খানের প্রস্তুতি।
খাওয়ারিজম শাহের সাথে আব্বাসি খিলাফাতের দ্বন্দ্ব তাতারদের জন্য পরিষ্কার বার্তা ছিল। মুসলিমরা যতদিন নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকবে বহিঃশত্রুর আক্রমণে তারা কেউ কারো সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।
খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ছিল। এ ছিল নিয়তি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। তখনও আল্লাহর এক বান্দার সাহসীকতায় তাতারদের বিরুদ্ধে তুলে নিয়েছিল ঈমানী হাতিয়ার। বিশ্বের বুক থেকে মুসলিমরা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পূর্বেই তার অবদান ইতিহাসের পাতায় যেন অলিখিত সোনালি অধ্যায়।
অনেকেই মনে করেন সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ, যিনি ছিল আলালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহের পুত্র, তিনি শুধু তাতারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মেধাধারণ করার জন্যই ইতিহাসের পাতায় ও মুসলিমদের অন্তরে সদা জাগ্রত। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। সাম্রাজ্য পরিচালনা ও ধর্মের ঝান্ডা ধারণে তার ত্যাগ ও তিতিক্ষা অবিস্মরণীয়। তবে তা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। মানুষের বিবেক জাগ্রত করতে বহুল প্রচার নেই। সব পশ্চিমা সংস্কৃতির বদৌলতে।
এ এক এমন রোমহর্ষক কাহিনী পাতায় পাতায় লোম দাঁড়িয়ে যায়। অন্তরে রক্তক্ষরণ হয়। তাতারদের পৈশাচিকতা, সুলতানের ব্যক্তিত্ব ও গুণের কাছে কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল আপনাকে জানতেই হবে। সুলতানের জীবনের রাজকীয় সূচনা ও শেষ দিনগুলোর মাঝে বড়ই তফাৎ। যখন সকলে দুনিয়াবি সুখশান্তি অর্জনে ব্যস্ত, তখন তিনি পরিবারের নারী ও শিশুদের আল্লাহর ভরসায় কীভাবে অকূল দরিয়ার বুকে ছুড়ে ফেলেছিলেন, কীভাবে একত্র করেছিলেন সীমাহীন সাহসীকতা। এক বিশাল নরপিশাচের দলের বিপরীতে ক্ষুদ্র বাহিনী পরিচালনার দক্ষ কৌশল খাটিয়ে মুসলিমদের জন্য আদর্শ হয়েছিলেন, আপনাকে জানতে হবে। শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
সুলতানকে নিয়ে বইটির শেষে আলোচনা ও সমালোচনাও রয়েছে। পাঠকের একরাশ মুগ্ধতার জায়গা এই পরিচ্ছেদটিও দখল করে নেবে। বইয়ের প্রচ্ছদটি আমার কাছে যেমন ইউনিক মনে হয়েছে, এর সাথে মানানসই রিবন বুকমার্কটিও রুচিশীল।
এ এক এমন হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস, যা আপনার হৃদয় অশ্রুও হরণ করে নেবে।
Shahriar Mohammad Aqib –
ইসমাইল রেহানের “সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ” ইতিহাস বিষয়ে একটি চমৎকার গ্রস্থ।খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান; সুলতান জালালুদ্দিন খাওয়াজিরম শাহের অসাধারণ ও বিরল বীরত্ব, সাহসিকতা চমৎকার ভংগীমায় ব্যক্ত করা হয়েছে।খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের সীমানা সুলতান আলাউদ্দীন খাওয়ারিজম শাহের আমলে অনেক বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু যতটা দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে ততটা দ্রুত তা নিশ্চিহ্নও হয়ে যায়।এর মূল কারণ ছিলো সুলতান আলাউদ্দীনের বিভিন্ন সমস্যা বিশেষত গোয়েন্দা বিভাগ দুর্বল থাকা, আপর দিকে তাতারদের হিংস্র আক্রমণ।তাতাররা আলাউদ্দীনের সাথে এক সমস্যার জের ধরে যখন খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে আক্রমণ করে ও বিভিন্ন শহর দখল করতে থাকে তখন সেসকল শহরে গণহত্যা চালিয়ে একেবারে বিরান করে ফেলে।অনেক শহরবাসী তাতারদের হাত থেকে বাঁচতে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেদের মুসলিম ভাইদের সাথে।তাতাররা তাদেরকেও জীবিত রাখে নি।বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি এমনই হয়। যাই হোক, তাতারদের এরকম হিংস্রাত্মক আক্রমণে আলাউদ্দীন খাওয়ারিজম শাহ একেবারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি পালিয়ে বেড়াতে থাকেন।তাঁর অনেক বিশ্বস্ত সেনাপতি, উজির,তার শাহজাদা জালালুদ্দিন তাকে পরামর্শ দিয়েছিলো লড়াই চালিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি ভয়ে একেবারে কাবু হয়ে গিয়েছিলেন।তার মৃত্যু হয় এক নির্জন দ্বীপে। অবশ্য এর আগেই তাঁর আত্মিক মৃত্যু হয়ে গিয়েছিলো।মৃত্যুর আগে তিনি তার শাহজাদা জালালুদ্দিনকে পরবর্তী সুলতান ঘোষণা করেন। সুলতান জালালুদ্দিন বাবার মত ভীতু ছিলেন না। সাহসের সাথে তিনি তাতারদের মোকাবেলা করেন। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করে তাতারদের আত্মবিশ্বাস দুর্বল করে দেন। তিনি যখন তাতারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন তখন ছিলেন রিক্তহস্ত। তবু সেখান থেকে তিনি শুরু করেন।তাতারদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিরোধ মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক কল্যাণ বয়ে এনেছিল।কেননা আশংকা ছিল তাতাররা হিজাজ ভূমিতে আক্রমণ করার। সুলতান জালালুদ্দিন তাতারদের নিজের সাথে ব্যস্ত রাখেন। ফলে তারা হিজাজ ভূমির দিকে এগোনোর সুযোগ পায় নি।হিংস্র, বর্বর তাতারদের বিরুদ্ধে তিনি একাই লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন।অন্যান্য মুসলিম সাম্রাজ্য থেকে তিনি অধিকাংস সময়ই সাহায্য পান নি বরং তাদের শত্রুতার মুখোমুখি হয়েছেন।তাঁর অসাধারণ সাহসিকতার জন্যই তিনি পেরেছিলেন তাতারদের বিরুদ্ধে যুলকারনাইনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে।তবে মুসলিম উম্মাহর অনেক ইতিহাসবিদ তাঁকে ভুল বুঝেছেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন।