বাংলাভাষায় সীরাতে রাসুল সা. সম্বলিত গ্রন্থ ব্যাপকভাবে উপস্থিত থাকলেও তার ব্যক্তিক জীবন বা শামায়েল নিয়ে পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ নেই বললেই চলে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, অন্য ভাষায়ও শামায়েল সম্পর্কিত যথাযথ গ্রন্থ খুব একটা নেই। সুতরাং বিষটির অভাব প্রকৃতপক্ষেই ভাবিত হওয়ার মতো।
লেখকের দাবি ও আমাদের পর্যবেক্ষণের ফলে অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়, ‘মুহাম্মাদ সা.: ব্যক্তি ও নবী’ গ্রন্থখানি সেই অভাব অনেকাংশে পূরণ করেছে।
আরবের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখক সালেহ আহমদ শামী রচিত বইটি নানা কারণেই অনন্য। বইটিতে তিনি রাসুল সা.-এর ব্যক্তি-জীবনকে হাজির করেছেন সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিসসমূহের আলোকে। লেখক বেশিরভাগ হাদিসই উদ্ধৃত করেছেন বুখারী ও মুসলিম থেকে। এর বাইরে যেসব হাদিস তিনি এনেছেন, তাতেও সনদ ও গ্রহণযোগ্যতায় সর্বোচ্চ সতর্কতা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
Copyright © 2024 Seanpublication.com
Muhammad Rafsan Nasir –
অজ্ঞতার তামসিকতায় মানুষ যখন সুপ্তিমগ্ন তখন দিশেহারা ও পথভ্রষ্ট মানুষকে রুদ্ধশ্বাস অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য যাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল তিঁনিই হলেন জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, জগৎবাসির আদর্শ, আমাদের নেতা “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।” আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছেন সুমহান চরিত্রে। অনুপম শিষ্টাচারে সাজিয়েছেন তাঁর পবিত্র জীবনকে। তাঁর দেখানো পথেই রয়েছে জীবনের পরম সফলতা ও মুক্তি। যারা সাফল্যের প্রত্যাশা রাখে অনন্ত জীবনে,আল্লাহর ভালোবাসায় নিজেকে করতে চায় উজ্জিবিত, তিঁনি তাদেরই আসমানি রাহবার।
নিঃসন্দেহে, মুহাম্মাদ ﷺ হলেন গোটা মানবজাতির জন্য আদর্শ। তাঁর পুরো জীবনই আদর্শে পরিপূর্ণ। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তিঁনি যেমন আদর্শবান, তেমনি ব্যক্তি জীবনেও মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাঁর পবিত্র কালাম পাকে ইরশাদ করেন _
وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡہُ وَ مَا نَہٰىکُمۡ عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا ۚ
রসুল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং তোমাদের যা নিষেধ করেন, তা বর্জন করো। [সূরা হাশর : ৭]
সূরা আহযাবে ইরশাদ হচ্ছে _
لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِی رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةࣱ لِّمَن كَانَ یَرۡجُوا۟ ٱللَّهَ وَٱلۡیَوۡمَ ٱلۡـَٔاخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِیرࣰا [الاحزاب ٢١]
অর্থঃ নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ ; কেবল তার জন্য যে আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। [সূরা আহযাব : ২১]।
আরবের বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক ‘সাহেল আহমদ শামী’ একটি সিরাত-সেমিনারে ডাক পাওয়ার পর ৫৪ বছর বয়সে প্রথম লিখেন “মিন মায়ীনিস সিরাত ” শিরোনামে এক অনন্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি ব্যাপক সমাদৃত হয় এবং পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে বাংলাভাষী পাঠকের কল্যাণে “মুহাম্মদ ﷺ ব্যক্তি ও নবী” নাম দিয়ে আকিক পাবলিকেশন্স তা প্রকাশ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দেন। গ্রন্থটি মূলত শামায়েল তথা রাসুলুল্লাহ ﷺ এর ব্যক্তিক জীবন নিয়ে রচিত।
লেখক পরিচিতি _
সালেহ আহমদ শামী দামেস্কের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দুমা নগরিতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালে। পড়ালেখা সমাপ্ত করেন ১৯৫৮ সালে সিরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে, যা বর্তমানে দামেস্ক ইউনিভার্সিটি নামেই সমধিক পরিচিত। কর্মজিবনের শুরু থেকেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবের কিং সাউদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধীনে অধ্যাপনা করেছেন। আখলাক, ইমান, ইসলাম ও ফারায়েজ বিষয়ক দশের অধিক গবেষণা গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। তার সাড়া জাগানো গ্রন্থ “মিন মায়ীনিস সিরাত “। মূলত সিরাত রচয়িতা হিসেবেই তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। বর্তমান রিয়াদে সপরিবারে বসবাস করছেন।
বইটি যে কারণে অন্যন্য _
বইটিতে সম্মানিত লেখক রাসুলুল্লাহ ﷺ এর ব্যক্তি – জীবনকে হাজির করেছেন সবচেয়ে বিশুদ্ধ হাদিসসমূহের আলোকে। লেখক বেশিরভাগ হাদিসই উদ্ধৃত করেছেন (সহীহ ও হাসান পর্যায়ের হাদিস) বুখারী ও মুসলিম থেকে। এর বাইরে যেসব হাদিস তিনি এনেছেন, তাতেও সনদ ও গ্রহণযোগ্যতায় সর্বোচ্চ সতর্কতা রক্ষা করার চেষ্টায় তা উল্লেখ করে দিয়েছেন।
বই আলাপন _
গ্রন্থটিকে আমরা তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারিঃ-
*প্রথমঃ রাসুলুল্লাহ ﷺ এর কর্মসম্বন্ধীয় ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যাবলী। যেমন, সাহসিকতা ও লজ্জা। প্রায় শামায়েল রচয়িতাগণ এ প্রাকারেই তাদের সংকলন সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
*দ্বিতীয়ঃ রাসুলুল্লাহ ﷺ এর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত তাঁর ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যাবলি। যেমন ; ইখলাস। ইখলাসের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ﷺ প্রবল উৎসাহ দিয়েছেন। সতর্ক করেছেন ইখলাস যেনো হারিয়ে না যায়। এ বিষয়টি ইন্দ্রিয় নির্ভর ঘটনাবলিতে প্রকাশ পায় না। এটা মানুষের নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।
*তৃতীয়ঃ রাসুলুল্লাহ ﷺ এর মন্দ কাজ পরিহার-সমন্ধনিয় বৈশিষ্ট্যাবলি।
বইটির সূচিপত্রকে মূল দশটি অধ্যায়ে সাজানো হয়েছে। যার প্রতিটি অধ্যায়ে বিভিন্ন শিরোনাম, উপশিরোনামের আলোকে পরিচ্ছেদ অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত কলেবরে দালিলিক ও তথ্যবহুল আলোচনা স্থান পেয়েছে।
সূচিপত্রের মূল শিরোনামগুলোর এক ঝলক _
★প্রথম অধ্যায় : সম্ভ্রান্ত বংশ ও পবিত্র আত্নীয়তা (এই অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিষয় অনুযায়ি ৮ টি পরিচ্ছেদে আলোচনা স্থান পেয়েছে)।
★দ্বিতীয় অধ্যায় : নবিজির বৈশিষ্ট্য ও গঠন (৩ টি পরিচ্ছেদে এই অধ্যায় সমাপ্ত করা হয়েছে)।
★তৃতীয় অধ্যায় : নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নৈতিকতা ও চরিত্র (২২ টি পরিচ্ছেদ মিলে নৈতিকতা ও চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে এবং এটি সর্ববৃহৎ অধ্যায়)।
★চতুর্থ অধ্যায় : অসচ্চরিত্র থেকে পবিত্র থাকা (অনুরূপ ৫ টি পরিচ্ছেদ স্থান পেয়েছে এই অধ্যায়ে) ।
★পঞ্চম অধ্যায় : নবিজির আদব ও সৌজন্য (এখানে ১০ টি পরিচ্ছেদ মিলে শিক্ষামূলক আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে)
★ষষ্ঠ অধ্যায় : পার্থিব প্রয়োজন সম্পাদনে নবীজি (৫ টি পরিচ্ছেদ)
★সপ্তম অধ্যায় : অনাবৃত সতর্ককারী (৩ টি পরিচ্ছেদ)
★অষ্টম অধ্যায় : নবিজির ইবাদতের অন্যদিক ( ৩ টি পরিচ্ছেদ)
★নবম অধ্যায় : নবিজির প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা ( ৪ টি পরিচ্ছেদ)
★দশম অধ্যায় : নবিজির অধিকার পূরণে মুসলিমদের দায়িত্ব। (অবশেষে ৩ টি পরিচ্ছেদ মিলে এই অধ্যায়ের আলোকে বইটির পূর্ণতা প্রদান করা হয়েছে)।
বইটি কেন পড়বেন _
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমরা ভালোবাসি। নিজেদের তাঁর উম্মত দাবি করি। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে কতটুকু জানি? যদি আমাদের তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতে বলা হয়, তখন কি আমরা তাঁর সম্পর্কে অনর্গল বলে যেতে পারবো? কত গল্প- উপন্যাসই তো আমরা অধ্যয়ন করি, বিশ্বের নানা প্রান্তের কত অদ্ভুত খবরের পেছনে পড়ে থাকি কিন্তু, দাবিকৃত প্রাণপ্রিয় মানুষটি সম্পর্কে জানার সুযোগ বের করতে পারি না। আফসোস! শুধু ভালোবাসার দাবি করলেই কি ভালোবাসা হয়। ভালোবাসার জন্য তো প্রিয় মানুষটি সম্পর্কে জানার পূর্ণ আগ্রহ থাকতে হয়। তাই বলবো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তি ও নবি জীবন সম্পর্কে ভালোমতো অবগত হতে চাইলে এই বইটি অবশ্যই আমার পাঠ্যতালিকার টপ লিস্টে রাখা উচিত। নিজের উপলব্ধির আলোকে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে বলছি _ বইটি পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি আপনার ভালোবাসা পূর্বের তুলনায় যৎসামান্য হলেও, বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ।
পাঠ পর্যালোচনা _
বাংলাভাষায় সিরাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্বলিত গ্রন্থ ব্যাপকভাবে উপস্থিত থাকলেও তাঁর ব্যক্তিক জীবন বা শামায়েল নিয়ে পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ নেই বললেই চলে। আমার জানা মতে, অন্য ভাষাতেও শামায়েল সম্পর্কিত যথাযথ গ্রন্থ খুব একটা নেই। সুতরাং বিষয়টির অভাব প্রকৃতপক্ষেই গুরুত্ব পাওয়ার মতো। একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে ” মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তি ও নবী ” গ্রন্থখানি সেই অভাব অনেকাংশে পূরণ করেছে। যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে লেখা কোন রচনাই পরিপূর্ণতার দাবি রাখে না। বইটি পড়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুবই উপকৃত হয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি আমার ভালোবাসা পূর্বের তুলনায় আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে শুধুমাত্র এই বইটির কল্যাণে। মন তো চায় বইটি সবার কাছে পৌঁছে দেই, কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য নেই।
ভালো ও মন্দ _
বইটির নাম অনুযায়ী প্রচ্ছদ মানানসই, একটা গাম্ভির্যপুর্ণ ভাব আছে বিধায় দেখতে আকর্ষণীয়। আমার কাছে লেখার প্রিন্ট, কাগজের মান, বাঁধাই সব ঠিকঠাক লেগেছে। বানান ভুল নেই বললেই চলে, ভুল বানান আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। অনুবাদ সাবলীল বিধায় বইটি সুখপাঠ্য লেগেছে। বইটির শেষ অধ্যায়ের তৃতীয় তথা শেষ পরিচ্ছেদে রাসুলের প্রতি দরূদ শিরোনামে দরূদ সংক্রান্ত আলোচনার মাধ্যমে বইটিকে সমাপ্ত করা হয়েছে যা প্রশংসাযোগ্য। সত্যি বলতে, মন্দ লাগার মতো কোন বিষয় আমার অনুভূতিতে আসেনি।
শেষ কথা _
শেষ করছি ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লার কথা দিয়ে। তিনি বলেছেন _ “যেহেতু উভয় জগতের সফলতা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পথনির্দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই প্রত্যেক কল্যাণকামী, সফলতা ও মুক্তিকামী মানুষের কর্তব্য হলো, নবির পথনির্দেশ, জীবন-চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানা ; যার মাধ্যমে সে অজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে নবিজির অনুসারি, অনুগামি ও দলভুক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে মানুষ কয়েক ধরনের হয় _ কেউ যৎসামান্য পারে, কেউ অনেক বেশি পারে, কেউ বঞ্চিত থাকে। অনুগ্রহের সবটুকু আল্লাহরই হাতে, যাকে খুশি তিঁনি দান করেন। আল্লাহ মহান অনুগ্রহশীল।” [যাদুল মা’আদ : খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৯ ]।
.
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ، وَأَنْزِلْهُ الْمَقْعَدَ الْمُقَرَّبَ عِنْدَكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন এবং কিয়ামতের দিন আপনার নিকটেই তাঁকে স্থান দিন। [মুসনাদ আহমাদ: ২/৩৫২, মাজমাউয যাওয়াইদ: ১৭৩০৪ ]
||সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম||