সুগুতের ছোট্ট জায়গিরটুকু একদিন হয়ে উঠল একটি সাম্রাজ্যের বীজতলা। অনেক কষ্টেও না-মনে-পড়া বিস্মৃত বা অখ্যাত কোনো সাম্রাজ্য নয়, এর স্থায়িত্বের শেকড় পোঁতা থাকবে ছয়শ বছরেরও অধিক সময়ের গভীরে! এক বিচক্ষণ ও দরদি নেতা স্বগোত্রের যাযাবর-জীবনে—তাঁবু স্থাপন আর তাঁবু গুটিয়ে অন্য আশ্রয় খোঁজার মধ্যে—দেখলেন, একটি স্থায়ী বসতির আকাঙ্ক্ষা-বেদনায় কতটা উদগ্র ও ব্যাকুল হয়ে থাকে তারা।
কিন্তু পৃথিবী জুড়ে তখন মোঙ্গলদের ত্রাস! মধ্য-এশিয়াও উথালপাতাল করে ফেলছে ওরা। ওদের ঠেকাবে, কারও সে সাধ্য নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পুরো পৃথিবী থেকে মুসলিমদের নাম-নিশানা মুছে যাবে; হারিয়ে যাবে খেলাফত। তখনই তিনি এলেন আনাতোলিয়ায়। পুঁতলেন—শুধু স্বগোত্রের ঠাঁই-ই নয়, খেলাফতরক্ষাকারী নতুন খেলাফত-ব্যবস্থার বীজও…
ভাবা যায়, খেলাফত-ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ার আরও ছয়শ বছর আগেই বিলুপ্ত হতে পারত খেলাফত! কে রুখে দিলেন সেই অশনিসম্পাত? কে সেলজুকদের ধুঁকে-ধুঁকে-চলা সাম্রাজ্যের রাশ টেনে ধরলেন? মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমান্তরক্ষার বরকতময় দায়িত্ব থেকে কার প্রাণনায় পত্তন হলো উসমানি সাম্রাজ্যের?
একজন বলিষ্ঠ নেতার ভূমিকায় জাতির জীবনের গতিপথ বদলে যায়। যাযাবরও বেছে নেয় রাজকীয় অভিমুখ। উসমানি সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা আরতুগরুল গাজি সেই মহান নেতা! তারই জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর আয়োজনে বিধৃত এই বই—তাকে নিয়ে বাংলা-ভাষার প্রথম প্রকাশনা।
Copyright © 2024 Seanpublication.com
Ruponti Shahrin –
বই : উসমানি সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টাঃ আরতুগরুল গাজি (পেপারব্যাক)
জনরা : নন-ফিকশন
লেখক : আইনুল হক কাসিমী
সম্পাদক : নেসারুদ্দীন রুম্মান
“আরতুগরুল গাজিঃ উসমানি সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা”
উসমানি সাম্রাজ্য- দীর্ঘ ছয় শতাধিক কাল এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত অত্যন্ত প্রতাপশালী একটি শাসনব্যবস্থা। যে সাম্রাজ্যের বীজ বপন করেছিলেন ইতিহাসের এক কিংবদন্তী পুরুষ; তিনিই আরতুগরুল গাজি।
উসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমান গাজি হলেও এই বিশাল যুগান্তকারী সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা নেতাই হলেন আমাদের আজকের গল্পের নায়ক।
১৪৫৩ সালের আগ পর্যন্ত এ সাম্রাজ্যের উত্থান নিয়ে বিশ্বে তেমন আলোড়ন আলোচনা ছিল না বললেই চলে। সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ এর কন্সটানটিনোপল বিজয়ের জয়ধ্বনি বেজে উঠতেই বিশ্ববাসী যেন একটু নড়েচড়ে বসল।
সুগুতের ছোট জায়গির। এটা সেই স্থান যেখান থেকে এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের বিকাশ। যার স্থায়িত্ব ছয়শত বছরের অধিক। তার ইতিহাস নেহাৎই চমকপ্রদ, রোমাঞ্চকর নয় তা কি হয়? যাযাবর কায়ি সম্প্রদায়ের তাবুর মধ্য থেকে এমন এক রোশনাই উদ্ভাসিত হবে তা-ই বা কে জানত!
মোঙ্গলদের বর্বরতা, উগ্রতা আর ত্রাসের রাজ্যে মুসলমানদের নাম ও নিশানা যখন মিটেই যাচ্ছিল, মুখ থুবড়ে পড়ছিল, একের পর এক মুসলমানদের সালতানাত ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ার যবনিকা প্রান্তরে, ঠিক তখনই আনাতোলিয়ার ছোট গ্রামে জেগে উঠলেন এক ক্ষিপ্র যুবক।
কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি? স্বগোত্রীয় তো বটেই, মুসলমানদের খিলাফত ব্যবস্থার ঝান্ডা ধরে রাখলেন যিনি সগৌরবে, সেলজুকদের রাশ টেনে ধরলেন যিনি সেই আরতুগরুল গাজিকে ইতিহাস কী বলে?
চলুন জেনে নেই বইয়ের সারসংক্ষেপ।
সংক্ষেপে বইয়ের বিষয়বস্তুঃ
ইতিহাসনির্ভর জীবনীগ্রন্থ যেহেতু তাই বইটির মূল কেন্দ্রবিন্দু আরতুগরুল গাজি। কায়ি গোত্রের সুগুত রাজ্য নিয়ে আগেই বলেছি। আর তা ছিল বর্তমান তুরস্কের বিলেচিক প্রদেশে। অর্থাৎ বিলেচিক প্রদেশকেই তৎকালীন সময়ের সুগুত বলে জানা যায়। যার নিদর্শন আজও বিদ্যমান।
একটি ভূমিকা, ছয়টি অধ্যায়, একটি পরিশিষ্ট ও একটি উপসংহারে সাজানো বইটির শেষ উপস্থাপন যথাযোগ্য।
কায়ি গোষ্ঠী ছিল যাযাবর। তারা ছিল যোদ্ধা জাতি। তাদের পতাকার প্রতীক IYI নির্দেশ করে তা। যেখানে Y চিহ্নিত করে ধনুক এবং II চিহ্নিত করে তীরকে। আর সেই জাতি গোষ্ঠীর লড়াকু সন্তান আরতুগরুল গাজি।
অবিশ্বাস্য রুপকথার গল্প মনে হলেও ইতিহাসের পাতার সোনালি রুপোলি আলোতে চোখ মেলে দেখেনি যে নতুন প্রজন্ম, তাদের দিগন্ত বিহারে মুসলিম সেনানির হারিয়ে যাওয়া দোর্দন্ড প্রতাপ স্বর্ণকেশর ঘোড়ায় চড়িয়ে ক্রুসেডারদের দুর্গে দাপিয়ে বেড়ানো এক টগবগে যুবকের গল্প। যা শোনাতেই বাংলা ভাষায় যার প্রথম প্রকাশ।
তুর্কি জাতির বর্ণনা থেকে কায়ি গোত্রের পরিচিতি, সেলজুক-গজনি-সামানি সাম্রাজ্য, আব্বাসি খেলাফাত, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, মধ্য এশিয়ায় মঙ্গল আক্রমণ, এরপর আরতুগরুল গাজির আলোচনা শেষে উসমান গাজির পরিচয় পর্ব দিয়ে উপসংহারের প্রাক্কালে এই সাম্রাজ্যের উত্থানের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে।
১২০০ সালের শেষের দিকে আব্বাসি খেলাফত মোঙ্গলদের মারমুখে পতনের দ্বারপ্রান্তে, সেলজুকরা যখন নামেমাত্র সিংহাসনে, তখন ইসলামিক সাম্রাজ্যের জন্য এশিয়া এক নরকের নাম। টিকে থাকার লড়াই তখন নিয়ে এলো বিধ্বংসী চ্যালেঞ্জ। অপ্রতিরোধ্য মোঙ্গলদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস জোগাতে হতবিহবল সকলে। দুর্দশায় ক্ষতিগ্রস্ত, পর্যদুস্ত সৈন্যহারা কায়ি গোষ্ঠী পেল এক টুকরো যমিন। যাযাবর জীবনের অবসান বদলে দিয়েছিল ইতিহাসের গতিপথ। নব শিশুর জন্মের সময় থেকে যুবক ছেড়ে প্রবীণ হওয়ার যাত্রাটা সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে আভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর জাল কেটে বের হয়ে আসার রোমাঞ্চকর আখ্যান। তাবুর কুপির নিংড়ানো আলো যখন প্রাসাদের দেয়ালে ঝাড়বাতির মত ঝলমলে তখন পেরিয়েছে বহু যুগ। আলোর মিছিল বয়ে নিয়ে এলো কোন মশাল? জানতে হলে বইটি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে।
নিজস্ব মতামতঃ
বইটি সাম্রাজ্যের মহান নেতা আরতুগরুল গাজির জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর আয়োজন। যদিও বইটি খুব অল্প পরিসরেই শেষ করা হয়েছে, এমনটাই লেখকের দাবী যে, ইতিহাস বিকৃতি না ঘটিয়ে এই অবিসংবাদিত নেতার জীবনকে তুলে আনতেই পরিসর ব্যপ্তি ঘটানো হয়নি। এছাড়া বইটি পড়লে নেতার জীবনের যা কিছু আমাদের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার সবটুকু ব্যখ্যা বিস্তারিত জানতে পারব। এবং বইটির শেষ অধ্যায় তা প্রমাণও করেছে।
মহান এই কিংবদন্তীর কথা যেখানে ইতিহাসে অপ্রতুল, সেখানে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা বেশ কষ্টসাধ্য। আরতুগরুল গাজিকে নিয়ে যা কিছু কিতাব লেখা হয়েছে তার সবই আরবী ও তুর্কি ভাষায় রচিত। সেদিক বিবেচনায় বাংলায় অনেক শব্দের ভাবানুবাদ ও দূরের কথা সঠিক উচ্চারণও খুঁজে পাওয়া কঠিন।
তুর্কি জাতি ও জনগোষ্ঠীর আলোচনা দিয়ে শুরু করে কায়ি গোত্রের যাযাবর জীবন। এরপর সেলজুক সামাজ্যের উদয়ের গান, গজনিদের উত্থান ও পতনের সুর, আব্বাসি খেলাফতের সূচনা; শিকড় থেকে শিখরে পদার্পণের যাত্রা, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের পদধ্বনি যেন মোঙ্গলদের আক্রমণের দামামা নিয়ে এলো। এভাবেই ৮৫ পৃষ্ঠা থেকে একটু বোধহয় দেরিতেই আরতুগরুল গাজির মঞ্চে পদধুলি পড়লো।
তার জীবনীকে আলোকপাত করতে হলে গোড়ার ইতিহাস টেনে আনতেই হতো। লেখক সে কাজে তথ্য দিয়েছেন পরিষ্কারভাবে। লেখক নিজেও স্বীকার করেছেন ইতিহাসের পাতায় খুব অল্পই এই নেতা সম্পর্কে জানা যায়। নাম, বংশ, জন্ম, শৈশব, পরিণয় গোষ্ঠীর মাঝে অবস্থান, নেতৃত্ব গ্রহণ, সিংহাসন, জীবনসায়াহ্ন ও চিরভাস্বর নেতার অনন্য হওয়ার পেছনের গল্পটা শেষ করা হয়েছে ৮৫-১০৬ পাতার মধ্যে। তারপরে আবার নতুন করে তার পুত্র উসমান গাজিকে নিয়ে আলোচনা করা হলেও আরতুগরুল গাজির অসামান্য অবদানের কথা উঠে এসেছে।
গুরুত্বপুর্ণ কথাটি হলো ‘দিরিলিস আরতুগরুল’ নামে যে সিরিজ দেখে আমরা আরতুগরুল গাজিকে চেনা ও জানার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছি, তার অনেকাংশেই চরিত্রের প্রয়োজনে সংযোজিত। বাস্তব ইতিহাসের সাথে বাহ্যিগত অনেক অমিল ও অসংগতিগুলো লেখক তুলে ধরেছেন। যারা সিরিজ দেখেছেন তারা এ অমিলগুলো ধরতে পারবেন। আর তা না হলেও সঠিক ইতিহাস জানতে বইটি একটি দৃষ্টান্তমুলক গাইড বই। দিরিলিস দেখা প্রসঙ্গেও লেখক দুটি মূল্যবান কথা বলেছেন।
বিশ্বের অসংখ্য ভাষায় ডাবিং করায় সকল উৎসুক জনতার মাঝে তাকে জানার হিড়িক পড়ে যায়। ঘটনা প্রবাহগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল না থাকায় মিথ্যাচার, কল্পনাপ্রসূত কাহিনিকে দর্শক যখন ইতিহাস হিসেবে গিলে খাচ্ছে তখন এমন একটি বইয়ের খুব প্রয়োজন ছিল। তুর্কি ও আরবি ভাষায় রচিত হয়েছে বই। তবে তা বাঙালি পাঠকের জন্য নয়। মাতৃভাষায় জীবনী পড়ে আরাম পাবেন পাঠককূল।
সব তথ্যের যোগসাজশ সাজাতে, ইতিহাসের পটভূমি ও আলোচ্য বিষয়সমূহকে ক্রমান্বয়ে তুলে ধরতে একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। উচ্চারণের তারতম্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আরবি ও তুর্কি ভাষার সাথে বাংলা উচ্চারণের অনেক পার্থক্য থাকায় সঠিক শব্দের উচ্চারণ পরিলক্ষিত হয় না। মানচিত্রে স্থানের বর্ণনা, দিন-তারিখ-সন, ব্যক্তিদের তালিকা, চরিত্রের গঠন সবকিছুর মাঝে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে তা লেখক অকপটে স্বীকার করেছেন। কারণ, তথ্যদাতাদের মাঝে ভিন্নমতের সম্ভার।আর এত বছর পিছিয়ে এসে সে তথ্যানুসন্ধান করা রীতিমত ধুম্রজাল।
সিনেমার নায়কের মত নয়, ইসলামের পতাকা শিখরে ধরে রাখার এই দিগ্বীজয়ী অধিনায়ককে জানার শেষ আছে বলে মনে হয় না। মনে হয় এ যেন নিতান্তই সূচীপত্র। তবু যেটুকু মুছে যায়নি, নতুন প্রজন্মের সামনে সেটুকু তুলে ধরা তাদের সামনে খোলা বইয়ের মত। জানার আগ্রহ থেকেই হয়ত ভবিষ্যতে আরও অজানাকে জানার পরিধি তৈরি হবে।