ফেরা। অন্ধকার থেকে আলোতে। পুরো হেজাযজুড়ে তেমনি এক সময় শুরু হয়ে যায় অন্ধকার থেকে আলোতে ফেরার উৎসব। সৃষ্টির সেরা মানুষটি এলেন প্রতিপালকের মহান বার্তা নিয়ে। তাঁর কর্মের সাথে এ বার্তা মিশে একাকার হলো। তৈরি হলো নতুন জীবনপ্রবাহ। নতুন অচেনা মুখ। মানসভূমি। সাহাবী-সঙ্গী। এভাবে তাঁর তেষট্টি বছরের জীবনস্রোতে আবিষ্ট হলো অযুত-লক্ষ মানুষ; যাদের হৃদয়ের আলোর রশ্মি সবখানে জায়গা করে নিল।
দেড় হাজার বছর আগে, রাসূল সা.-এর সেই মহা আবির্ভাবে আলো আর তাপ দিগদিগন্তে দেশে-মহাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। তাওহীদের সুরভি ও নাবীজীর মানবিক বোধ আজও অনির্বাণ। এ নিয়েই আবদুল আযীয আল আমানের ‘শুদ্ধতম’ নির্মাণ—রৌদ্রময় নিখিল …
Copyright © 2024 Seanpublication.com
Arafat Shaheen –
বই: রৌদ্রময় নিখিল
আবদুল আযীয আল আমানের লেখার সঙ্গে পরিচয় আছে?
আমাদের প্রজন্মের কারও মুখে এর আগে আমি আমানের নাম শুনিনি। তবে যতটুকু জেনেছি, আমাদের এক দশক কিংবা দুই দশক আগের এবং যারা সিরাত সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন তাদের কাছে আমানের লেখা বেশ পরিচিত।
পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় ১৯৩২ সালের ১০ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন আবদুল আযীয আল আমান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন গার্ডেন রীচ কলেজ এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত কাজ হলো রাসূল (সা.)-এর জীবনী গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন। এই সিরিজে রয়েছে মোট ছয়টি বই; যা কিছুদিন আগে বাংলাদেশ থেকে বইকেন্দ্র পাবলিকেশনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৪ সালের পয়লা ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন সিরাত-সাহিত্যের অন্যতম এই দিকপাল।
•
বইটির নাম ‘রৌদ্রময় নিখিল’। বইটি কলকাতা থেকে ১৯৮৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। আমাদের আলোচ্য বইটিতে বিভিন্ন শিরোনামে মোট সতেরটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলোর শিরোনাম খুবই চমকপ্রদ- আলিঙ্গন, যখন প্রতিশ্রুতি, আলোর আবাবিল, আলোর পাখিরা, আলোকের দিকে, আর এক মানুষের জাগরণ, জরিপ না হওয়া নিখিলের ইতিবৃত্ত, কুসুম বনে, পরিচর্যা, নিখুঁত ওজনের মিযান, সাম্যের সম্রাট, সকালের দিকে, একটি বুরদার ইতিকথা, এই প্রথম, রূপান্তর, সংসারের ওই সোনার শিকল, নীরব রূপান্তর। পরিশিষ্ট অংশে ‘এক বিস্ময়কর মানুষের কথা’ ও ‘একটি সংগীতের ইতিবৃত্ত’ নামে দুটি গল্প রয়েছে যা হযরত ওমর (রা.)-এর জীবনের দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
আবদুল আযীয আল আমানের লেখার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে। তিনি উপমার প্রয়োগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। প্রতিটি লেখাতে উপমার ওপর উপমা। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে।
ক. তাঁর চঞ্চল পদক্ষেপে ততক্ষণে ভোরের আলো ফোটার মতো অনায়াস ছন্দ গতি পেয়েছে। ( আলিঙ্গন)
খ. কথা বলবেন কি তিনি কেঁপে উঠলেন, বসন্তের শান্ত হাওয়ায় যেমন কুসুম কলি কাঁপে। (আলিঙ্গন)
গ. ভোরের ফোটা শিউলির মতো একটা নীরব হাসি ছড়িয়ে গেল সবার মুখে। ( যখন প্রতিশ্রুতি)
ঘ. বর্ষার স্ফীত নদীর মতো আবদার আকণ্ঠ হয়ে ওঠে। ( আলোর আবাবিল)
ঙ. ক্ষমা পেল ইকরামা। রাহুমুক্ত চাঁদের কিরণমালা জ্যোৎস্না ফিরে পাবার মতো মালিন্য ঝেড়ে নতুন আলোকিত জীবন শুরু করল সে। (আর এক মানুষের জাগরণ)
পুরো বইজুড়ে এমন সুন্দর সুন্দর উপমা শিশির স্নিগ্ধ ভোরের মতো আপনার সামনে এসে হাজির হবে। যারা এমন গদ্য ভালোবাসেন তারা নিঃসন্দেহে দারুণ কিছুই পাবেন।
•
তিনি রাসূল (সা.)-এর জীবনের পবিত্র ঘটনাগুলো নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সংগ্রহ করেছেন। প্রতিটি বইয়ের শেষেই উৎসমূলসহ পুরো হাদীস কিংবা ইতিহাসটুকু বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটা গল্প লেখার পেছনে যে তিনি প্রচুর সময় ব্যয় করেছেন পড়তে গিয়ে অবশ্যই সেটা অনুভব করতে পারবেন।
আবদুল আযীয আল আমানের ভাষার ব্যবহার একান্তই নিজস্ব। বাংলাদেশ সংস্করণেও তাঁর বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। ফলে আমাদের দেখা স্বাভাবিক বানানরীতির চেয়ে কিছুটা ভিন্ন বানানরীতি পুরো বইজুড়ে দেখতে পাবেন।
যারা রাসূল (সা.)-এর জীবনী জানার পাশাপাশি উন্নত ভাষাশৈলীরও সান্নিধ্য পেতে চান, আমি তাদের জন্য আবদুল আযীয আল আমানের ‘রৌদ্রময় নিখিল’সহ পুরো সিরাত সিরিজটা একবার পড়ে দেখতে বলবো। আশা করা যায় আপনি ভিন্ন একটা কিছুর স্বাদ পেতে যাচ্ছেন।
আরেকটা কথা, গত মাসেই আমানের সিরাত সিরিজটি বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছে। আমি নিজে দেখেছি, সিরাতপ্রেমী মানুষেরা বইগুলো হাতে পেয়ে এবং পড়ে দারুণ উল্লসিত হয়েছেন। প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদই মনোমুগ্ধকর। হাতে নিলেই মনটা এমনিতেই ভরে ওঠে।