হুসাইন রা.। ভালোবাসার তাজমহল। শ্রদ্ধার রাজপুত্র। নাম শুনলেই অন্তরে ভালোবাসার জোয়ার ওঠে। সাইয়িদুল ইনসি ওয়াল জান নবি মুহাম্মাদ সাঃ-এর দৌহিত্র। জান্নাতি মহিলাগণের সরদার মা ফাতিমা রা.-এর কলিজার টুকরো সন্তান।
মদিনায় জন্ম। মদিনায় বেড়ে ওঠা। রাসুল সা.-এর আদর-সোহাগে শৈশব কাটানো জান্নাতি যুবকদের সরদার। কারবালায় মৃত্যু।
কারবালা! কারবালা শুনলেই বেদনাহত হৃদয় আরও বেদনাবিধুর হয়ে পড়ে। মর্মান্তিক দৃশ্য ভেসে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কারবালার আলোচনা শুনলে অশ্রু আপনাতেই গড়িয়ে পড়ে।
সোনার মদিনা থেকে কারবালার দূরত্ব প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার। পরিবার-পরিজন নিয়ে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে তিনি এ দীর্ঘ কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। মরুভূমির বালুসাগর পাড়ি দিয়ে কেন গিয়েছিলেন কারবালায়? মদিনায় কি তাঁর কোনো কিছুর অভাব ছিল? নানাজানের রওজায়ে আকদাস ছেড়ে কারবালায় কেন গিয়েছিলেন? গিয়েছিলেন জািলম শাসকের কবল থেকে উম্মাহকে উদ্ধারের জন্য, নানাজানের প্রিয় দীনের হিফাজতের জন্য, খিলাফত রক্ষার জন্য। দুনিয়াবি পরিণাম-পরিণতির পরোয়া না করে শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে িতনি প্রিয় মদিনা থেকে সুদূর কুফার উদ্দেশে রওনা হন।
তারপরের কাহিনি কী ছিল, কেমন ছিল জানতে হলে পড়ুন হালজামানার বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ ও ফকিহ ড. শায়খ আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি লিখিত এ গ্রন্থ।
কামরুননাহার মীম –
ভ্রান্তিবিলাসে জড়িয়ে গিয়ে যখন জীবন ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ হয়, তখন ইতিহাস জানা বোনাস পয়েন্ট নয় কেবল- তখন ইতিহাস জানা জরুরি, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেও কেও বলে, কিছু জিনিস জানা নিজের জন্য সুখকর। আমি ভাবি, কিছু জিনিস না জানলে অন্যের বিভ্রান্তির সমুদ্রে নিজের ও যে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে৷ বিভ্রান্ত উম্মাহর সামনে কেবল তাদের বিভ্রান্ত বললেই কি তারা ক্ষ্যান্ত হবে? বহু বছরের লালিত সংস্কৃতি ভুল- এটা মানতেই তো একটা দফারফা হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে যদি পরিপূর্ণ দলিল পেশ না করা যায় কিংবা সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা না করা যায়, তবে নিজেরই বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়।
“আশুরা” এই নামটি বেশ পরিচিত আমাদের মাঝে। অথচ কত বিদ’আত জড়িয়ে আছে এই ঘটনা জুড়ে। কারো কাছে আশুরা যেন আনন্দের মহাউৎসব, কারো লোকদেখানো কান্নার আর্তনাদে আশুরা যেন শোকের ছায়া। আর হকপন্থীদের কাছে এক সম্মানিত দিন। আশুরার যুক্তিখন্ডন করার পূর্বে জানা প্রয়োজন একটু পিছনের ঘটনা। আর তার জন্য জানতে হবে ইতিহাসের এক স্মরণীয় অধ্যায় আর জান্নাতের যুবকের সর্দারদের নিয়ে। বলছিলাম হুসাইন ইবনু আলি (রা.) এর কথা, ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই ” হুসাইন ইবনু আলি রা.” এর কথা।
উল্লেখিত এই বইটি মোট দুইটি অধ্যায়ে বিভক্ত৷ প্রথম অধ্যায় জুড়ে ছিল মূলত হুসাইন রা. এর বংশ, শৈশব এবং ফজিলত সম্পর্কিত কিছু হাদিস সংক্রান্ত। এছাড়া তার নামকরণ থেকে শুরু করে খতনা পর্যন্ত কিছু আনুষ্ঠানিকতার চিত্র বেশ সহজ-সাবলীল ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক৷ অত্যন্ত চমৎকারভাবে তার পরিচয় পর্বটা পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন লেখক। দ্বিতীয় অধ্যায়টি মোট তিনটি পরিচ্ছদ জুড়ে বিভক্ত হয়েছে। কারবালার সেই হৃদয়বিদারণ ঘটনা পাঠকের চোখ অশ্রুসিক্ত করে। একরাশ জানার কৌতুহল পাঠককে ঘটনার শেষ অব্দি নিয়ে যায়। আর সেখানেই পাঠকের চোখ হয়ে যায় ঝাপসা। এভাবে হারিয়ে ফেললাম আমরা রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় নাতিকে? উম্মাহর কল্যাণের কথা ভাবতে গিয়ে যিনি নিজের মৃত্যুর কথা পরোয়া করেননি, যিনি চাননি উম্মাহর বিভক্তি, যিনি দ্বীন সংরক্ষণের জন্য বস্তা বস্তা বহু চিঠিকেও প্রত্যাখ্যান করে পা বাঁড়িয়েছিলেন কুফার পথে৷ বিনিময়ে কুফা দিয়েছিলেন নির্মম এক মৃত্যু। নির্লজ্জ সেই হত্যাকারী মানুষ গুলোর মুখে ছিলনা এতটুকু অনুতাপ। উম্মাহ হারালো হুসাইন (রা.) কে। মুসলিমদের মাঝে বারংবার স্মরণ হয় তবুও সেই কান্নাজড়িত কারবালার স্মৃতি আর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর ভালবাসার হুসাইন (রা.)- কে। আর এরই রেশ ধরে উম্মাহর দল বিভক্ত হয় কয়েকভাগে। বহু বিদ’আতি আর নাজায়েজি কাজ চলে এই ঘটনা জুড়ে৷ আফসোস! কিভাবে এত মিথ্যাচারে ব্যস্ত তারা! আর এই বই সেই বিষয়গুলোর বিস্তারিত আলোচনা করে সত্যকে উদঘাটন করতে উম্মাহর জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। শুধুমাত্র শিয়া বা অন্যান্যদের ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডনই নয় কেবল – এছাড়াও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা রয়েছে এই বইয়ে।
বলা হয়, উম্মাতের ৭৩ দলের মাঝে এক দল জান্নাতে প্রবেশ করবে। একটি পথ থেকে একটু একটু করে সরে গিয়ে আমরা বেশ অনেকটা দূরে ভুলের সাগরে ডুবে যাচ্ছি। অথচ এই ভুল মানতে নারাজ আমরা। ফলস্বরূপ, কিয়ামতের দিন নিশ্চয়ই শূন্য হস্তে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সামনে অনুতাপ ছাড়া কিছুই হবেনা। অথচ সেদিন কি অনুতাপ করে আদৌ কিছু লাভ হবে? কিছু জিনিসে বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ি নিশ্চয়ই উম্মাহর বিপথগামীতার কারণ। ইতিহাসকেও নিজের জোর বা যুক্তিতর্কের দোহাই দিয়ে উপস্থাপন করা কোনো উম্মাহর বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। আমরা নির্ভরযোগ্য আলেমগণ, সালাফদের অনুসরণ করে সেসব বুঝব।
আজকাল প্রায়ই আশুরার এইসব ভ্রান্ত আর ইচ্ছামতন আনুষ্ঠানিকতা মনকে ব্যথিত করে। আমরা কোন পথে হাঁটছি! ভুলকে আঁকড়ে ধরে আল্লাহর অপ্রিয় হওয়ার স্পর্ধা আর গ্রহণযোগ্য নয়। সঠিককে জানতে হবে। আর তা কেবল জানাই নয় বরং এই ভ্রান্তির প্রসারের বিপক্ষে সত্যের প্রসার আরও বেশি হওয়া জরুরি। আর তাই উম্মাহর সামনে বারবার সত্যের প্রকাশ করতে হবে, জানাতে হবে। মিথ্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমি মনে করি, ১৫৬ পৃষ্ঠার বই নিশ্চয়ই ইতিহাসের সম্পূর্ণটা তুলে ধরতে অপারগ। তবে একজন সাধারণ ব্যক্তির জানার শুরুটা এই বইটা দিয়ে হতেই পারে। কারণ সহজভাবে বলতে গেলে, বইটি গুরুত্বপূর্ণ আর একইসাথে সহজ বোধগম্য।
প্রতিটি জিনিসই ভুলের উর্ধ্বে নয়। এই বইয়েও বানানে কিছু ভুল ছিল। আর একজন নতুন ইতিহাস পাঠক হিসেবে এতটুকুই চোখে পড়ছিল। পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলোর সংশোধন করার জন্য অনুরোধ রইলো।
বই: হুসাইন ইবনু আলি রা.
লেখক: ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি
অনুবাদ: আতাউল কারীম মাকসুদ
সম্পাদক: সালমান মোহাম্মদ
পৃষ্ঠা: ১৫৬
প্রচ্ছদ মূল্য: ২০০৳